আমরা মূর্তি পূজক ছিলাম, আছি, থাকবো




 

আমাদের ধর্মের নাম সনাতন ধর্ম। সনাতন অর্থ চিরন্তন অর্থাৎ যা পূর্বে ছিলো, বর্তমানে আছে ভবিষ্যতেও থাকবে।

এক্ষেত্রে গীতায় এই সনাতন ধর্মের কথার উল্লেখ পাওয়া যায়ঃ-
কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্মাঃ সনাতনাঃ।
ধর্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্মোহভিভব ত্যুত।।
(গীতা-১/৪০)
অর্থঃ- নিজেদের কুলকে বিনাশ করলে আমাদের কুলধর্ম সনাতন নষ্ট হয়ে যাবে। তখন আমাদের সম্পূর্ণ কুলে বহুপ্রকারে পাপ প্রবেশ করবে।
**এখানে অর্জুন কুলধর্মকে সনাতন ধর্ম বলে উল্লেখ করেছেন।
ত্বমক্ষরং পরমং বেদিতব্যং
ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্৷
ত্বমব্যয়ঃ শাশ্বতধর্মগোপ্তা
সনাতনস্ত্বং পুরুষো মতো মে৷৷ (গীতা১১/১৮)
অর্থ: তুমি পরম ব্রহ্ম এবং একমাত্র জ্ঞাতব্য। তুমি বিশ্বের পরম আশ্রয় ও সনাতন ধর্মের রক্ষক, তুমিই সনাতন এই আমার অভিমত।
**এখানে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে সনাতন ধর্মের রক্ষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
মনুসংহিতাতেও সনাতন ধর্ম শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়ঃ-
সত্যং ব্রুয়াৎ প্রিয়ং ব্রুয়ান্নব্রুয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্।
প্রিয়ং চ নানৃতং ব্রুয়াদেষ ধর্ম্মঃ সনাতনঃ।।
.
অনুবাদ: অপরের হিতকর প্রিয় সত্য কথা বলিবে, অপ্রিয় সত্য
কথা কখনো বলিবেনা যাহা লোকের মর্মভেদ করে,
অপরকে প্রসন্ন করার সহিতে মিথ্যা বলিবে না, ইহাই বেদবিহিত
সনাতন ধর্ম। (মনুসংহিতা ৪/১৩৮)
** এখানে বেদবিহিত ধর্মইযে মূলত সনাতন ধর্ম এরূপ পাওয়া যায়।
এই সনাতন ধর্মের উল্লেখ আরো বিভিন্ন গ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায়। সনাতন ধর্মকে স্বামী বিবেকানন্দ বৈদিক সনাতন ধর্ম, বৈদিক ধর্ম, বেদান্ত ধর্ম বলেও উল্লেখ করেছেন। সনাতনীদের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদ হওয়ায় সে হিসেবে বৈদিক ধর্ম বলা হয়ে থাকে। আবার সনাতন ধর্মের অনুসারীদের আর্য বলা হয়। সে হিসেবে একে আর্য ধর্মও বলা হয়ে থাকে। আর্য শব্দের উল্লেখ বেদ সহ নানান ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়ঃ-
আর্যা ব্রতা বিসৃজন্তো অধি ক্ষমি। (ঋগ্বেদ ১০/৬৫/১১)
কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম্।(ঋগ্বেদ ৯/৬৩/৫)
বি জানীহ্যার্যান্যে চ দস্যবো বর্হিষ্মতে রন্ধয়া শাসদব্রতান্। (ঋগ্বেদ ১/৫১/৮)
**উক্ত মন্ত্রসমূহে সত্য, অহিংসা, পবিত্রতাদি উত্তম ব্রতধারী ব্যক্তিদের ‘আর্য’ বলা হয়েছে এবং বিশ্বের নর-নারী সকলকে এইরূপ ‘আর্য’ করার উপদেশ দেয়া হয়েছে।
নিরুক্ত অনুযায়ী আর্য শব্দের উৎপত্তি "আরি" থেকে যার অর্থ ঈশ্বর। সেই হিসেবে আর্য মানে ঈশ্বর পুত্র।
ঈশ্বরোহপিআরি(নিরুক্ত৫/৭)
সুতরাং উক্ত আলোচনা থেকে এটুকু বোঝা যায় আমাদের ধর্মকে সনাতনধর্ম, বৈদিক সনাতন ধর্ম, বৈদিক ধর্ম, আর্য ধর্ম হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে আমরা যে শব্দটি বেশি ব্যবহার করি "হিন্দুধর্ম" এই শব্দের উৎপত্তি কোথা থেকে?
>>> হিন্দুধর্ম কথাটি এসেছে হিন্দু শব্দ থেকে।
"New Encyclopedia Britannica" (20:581) -এ আছে উনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজরা সিন্ধুনদের তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে "Hinduism" বলে উল্লেখ করেন। এই হিন্দুইজম থেকে হিন্দু এবং তাদের ধর্ম হিন্দুধর্ম।
আবার এমনও বলা হয়, হিন্দু শব্দটি এসেছে (পার্সিয়ান হয়ে) সংস্কৃত শব্দ সিন্ধু থেকে।
এই সিন্ধু নদের সাথে আর্যদের বিশেষ সংযোগ থাকায় সেই সনাতন ধর্ম বা বৈদিক ধর্ম বা আর্য ধর্ম, হিন্দু ধর্ম হিসেবেই অধিক পরিচিতি পায়। আর্যদের আদি নিবাস যে ভারতবর্ষেই ছিলো তার বিস্তর প্রমাণ পাওয়া যায়। এবং এক সময় আর্যরা পুরো পৃথিবীর চক্রবর্তী সম্রাটও ছিলো তা আমাদের ইতিহাস গ্রন্থগুলিতে দেখা যায়। এমনকি বর্তমানে আর্যরা যে এ ভূমিরই সন্তান বহিরাগত নয় তাও বিভিন্ন গবেষণার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। কারণ আজকের মূল আলোচ্য বিষয় তা নয়। এ বিষয়ে ইন্টারনেটে ইউটিউবে এবং বিভিন্ন বইয়ে প্রচুর তথ্য পাবেন। আগ্রহীরা দেখে নিবেন।
আদি আর্যদের সভ্যতার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতবর্ষে বিশেষ করে সিন্ধু নদের আশেপাশের এলাকায়।
এসব সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে পাওয়া বিশেষ যে জিনিসগুলি পাওয়া যায় তা হলো দেবদেবী মূর্তি ও স্বস্তি চিহ্ন। আজকের আলোচনার মূল বিষয় এটা নিয়েই।
প্রথমেই শুরু করা যাক মেহেরগড় সভ্যতা দিয়ে,
মেহেরগড় সভ্যতায় (৭০০০-৩৩০০ খ্রিঃপূঃ) পাওয়া দেবমূর্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য "Seated Mother Goddess" (আসন উপবিষ্ট দেবীমাতা)। এটা কেন দেবীমাতারই বিগ্রহ সাধারণ কোনো পুতুল নয় তার সম্পর্কেও বিশেষ যুক্তি ও গবেষণা পত্র পাওয়া যায়। এছাড়াও প্রাপ্ত বিভিন্ন সামগ্রী প্রমাণ করে যে মেহেরগড় সভ্যতায় মূর্তি পূজা তথা দেবদেবী বিগ্রহ পূজা প্রথার প্রচলন ছিলো।



**মেহেগড় সভ্যতা ও আসন উপবিষ্ট দেবীমাতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতেঃ-

এরপর আসে আদি হরপ্পা সভ্যতার কথা,
আদি হরপ্পা সভ্যতা(৩৩০০-২৬০০খ্রিঃপূঃ)। হরপ্পা সভ্যতায় স্বস্তিকা চিহ্ন সহ বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়।


**বিস্তারিতঃ-

এরপর মহেঞ্জোদাড়ো (২৬০০-১৯০০ খ্রিঃপূঃ)সভ্যতায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃষ্টান্ত গুলি পাওয়া যায়। মূর্তি পূজার বিশেষ নিদর্শন এখানে বেশি মেলে।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় নিদর্শন,
Pashupati Seal অর্থাৎ পশুপতি সীল অর্থাৎ শিবের বিশেষ রূপ পশুপতি অঙ্কিত সীল। এটা দেখে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় তখন দেবতা মূর্তি পূজনীয় ছিলো। যদিও পশুপতি সীলের তিনধরনের ইন্টারপ্রেটেনশন পাওয়া যায়, কেউ বলেন ইহা পশুপতি শিব, কেউ বলেন ইহা অগ্নিদেব, কেউ বলেন এটা মহিষাসুরের ছবি। তবে পশুপতি মতটাই বেশি গ্রহনযোগ্যতা পাওয়ায় একে পশুপতি সীল নামে অভিহিত করা হয়।
ধারণা করা হয় সীলটি ২৩৫০-২০০০ খ্রিষ্টপূর্বের।


**বিস্তারিতঃ-
মহেঞ্জোদাড়োর আরেকটা উল্লেখযোগ্য মূ্র্তি হচ্ছে,
"Mother Goddess Idol"(দেবীমাতার বিগ্রহ)। লক্ষ্য করলে দেখবেন সভ্যতাগুলোয় প্রাপ্ত বিগ্রহগুলির বেশির ভাগই মাতৃদেবীমূ্র্তি। এথেকে এটাও বুঝা যায় যে প্রাচীন আর্যগণ বিশেষ ভাবে মাতৃশক্তির উপাসক ছিলো। এজন্যই হয়তো বেদের গায়ত্রী মন্ত্রে ঈশ্বরকে
" সবিতা" বলা হয়েছে অর্থাৎ এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রসবিতা, সে অর্থে মাতৃস্থানীয়।


মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতা ও দেবীমাতা বিগ্রহ সম্পর্কে বিস্তারিতঃ-


সুতরাং ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায় যে আর্যরা বা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বহু পূর্ব থেকেই মূর্তিপূজা করে আসছে। অর্থাৎ আমাদের পূর্বপুরুষগণ মূর্তি পূজারীই ছিলেন।


এটা গেল মূর্তিপূজার প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক প্রমাণ।
এবার আমাদের সনাতন ধর্মগ্রন্থের ইতিহাস শাস্ত্রে মূর্তিপূজার কি কি উল্লেখ পাওয়া যায় তা অবলোকন করিঃ
প্রথমেই আলোচনা রামায়ণ নিয়েঃ-
রামায়ণে স্বয়ং রামচন্দ্র বিষ্ণু মন্দিরে বিষ্ণু বা নারায়ণের পূজা ও ব্রতাদি পালন করেছিলেন। যা পাওয়া যায় বাল্মিকী রামায়ণের অযোধ্যাকান্ডের, ষষ্ঠ সর্গের, চতুর্থ স্লোকে (২/৬/৪)।






এছাড়াও রামায়ণের ২/৩/১৮, ২/৬/১১, ২/১৭/১৬, ২/৭/৪ নং স্লোকে দেবমন্দিরের উল্লেখ ও দেব বিগ্রহের উল্লেখ পাওয়া যায়।







সুতরাং এ থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে রামচন্দ্রের সময়ও মূর্তিপূজা বেশ প্রচলিত ছিলো। প্রচুর দেব মন্দির ছিলো সে সময়। আর শ্রীরামচন্দ্রও নিজে মূর্তিপূজা করেছিলেন।


এবার আসি মহাভারতেঃ-
মহাভারতের বনপর্বের৩৫/৬৫ স্লোকে অর্জুন মৃন্ময় শিব অর্থাৎ মাটি নির্মিত শিব বিগ্রহ পূজা করেন পাওয়া যায়।



তারপর মহাভারতের পরিশিষ্ট হরিবংশের অধ্যায় -১৩৩ এ পাওয়া যায় যে প্রস্তর অর্থাৎ পাথর দিয়ে দেববিগ্রহ নির্মাণ করে পূজা করার নির্দেশ দেওয়া আছে।


সবশেষে মনুসংহিতা থেকে বলি,
মনুসংহিতার-৪/১৫৩ এ মনু স্বয়ং দেবপ্রতিমা দর্শন ও নমস্কারের আদেশ দিয়েছেন।


সুতরাং উপরের পুরো আলোচনা থেকে এটুকু প্রমাণিত যে, সনাতনধর্মাবলম্বীরা তথা আর্যগণ বহু পূর্ব থেকেই মূর্তিপূজা করে আসছে। মূর্তিপূজা আামাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির একটা মূল অংশ।
আমরা সনাতনধর্মাবলম্বী আর্যরা পূর্বপুরুষের ধারায় মূর্তিপূজক ছিলাম, বর্তমানেও মূর্তিপূজা করছি, ভবিষ্যতেও করবো।

শ্রী প্রান্ত সাহা