শ্রীকৃষ্ণ কি আসলেই ঈশ্বরের অবতার?

🔶 শ্রীকৃষ্ণ কি আসলেই ঈশ্বরের অবতার?


🔳 অনেক সনাতনী ভ্রাতার নিকট হইতে অবগত হইলাম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত অবস্থায় এবং যোগমুক্ত অবস্থায় গীতার বাণী দিয়েছেন। বক্তব্যের রেফারেন্স হিসেবে মহাভারতের একটি অংশকে তারা তুলে ধরেন যদিও মহাভারতের ৮৮০০ শ্লোকের গল্প বলে অনেক অংশই প্রক্ষিপ্ত করে দেন কিন্তু অনুগীতা নামক প্রক্ষিপ্ত অংশকে উর্ধে ধরিয়ে তুলেন। কৃষ্ণচরিত্র তে ঋষি বংকিমচন্দ্র অনুগীতা নামক অধ্যায় যে প্রক্ষিপ্ত তার প্রমাণ করেছেন। শ্রীরাধীকাকে মিথ্যা প্রমাণ হেতু তাহারা কিন্তু এই "কৃষ্ণচরিত্র" গ্রন্থকেই আঁকড়াইয়া ধরেন অথচ অনুগীতার প্রক্ষিপ্ততা তত্ত্বে পিছাইয়া থাকেন।

🔲 এখন আমার বক্তব্য হল, শ্রীকৃষ্ণ এর একটি বাণী আছে গীতায় সেখানে বলা আছে,

"হে অর্জুন,তোমার আমার বহুবার জন্ম হইয়াছে,তোমার মনে নেই আমার মনে আছে"

যদিও ইতিপূর্বে বলিয়াছিলাম তবুও প্রশ্ন হল, যেহেতু গীতার এই বাণী তাহাদের মতে ঈশ্বরের নয় এবং এই বাণীটি যোগমুক্ত অবস্থায় দিয়েছেন। কারণ হিসেবে তাহারা বলেন ঈশ্বরের জন্ম নাই মৃত্যু নাই তাই এই বাণীটি শ্রীকৃষ্ণ এর ঈশ্বরের নয়। তর্কের খাতিরে ইহাও মানিলাম। এখন মনে রাখবেন এই বাণী যদি মানেন তাহলে শ্রীকৃষ্ণ জাতিস্মর। বহু জন্মের কথা উনি জানিতেন ও মনে রাখিতে পারিতেন। যদি তাহা জানিতেন তাহলে অনুগীতার ঐ অংশ যে প্রক্ষিপ্ত তা অনায়াসেই বলা যায়।


🔹কিন্তু কেন ও কিভাবে ?


কারন হল যিনি বহু জন্মের কথা মনে রাখেন তিনি কি করে ৭০০ শ্লোক ভুলে যান? আর একথা সবার কাছেই স্পষ্ট যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সর্বদা ধর্ম পথে চলে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন এবং তাঁর পক্ষে মিথ্যা বলাও অসম্ভব। সুতরাং এই অংশ প্রক্ষিপ্ত অর্থাৎ কতিপয় অনুগীতাবাদীরা অনুগীতাকে মহাভারতে ঢোকানোর অপপ্রয়াস চালিয়েছেন মাত্র।

এছাড়াও ৭০ শ্লোকের গীতা যাহারা মানিয়া থাকেন তাহাদিগকের কাছেও আমার প্রশ্ন, ওহে বালক যিনি জাতিস্মর এবং বহুজন্মের কথা জানেন তিনি কি করে ৭০টা শ্লোক ভুলে যায়?

 এখানে আরো একটা জিনিস এড করে দেই, সেটি হল যাহারা বলবেন ঈশ্বরের ভাষা সংস্কৃত আর ইহা যোগযুক্ত অবস্থায় ঈশ্বর বলিয়া থাকেন তাদের কাছে আমার কথা হল, শ্রীকৃষ্ণ বেদজ্ঞ ছিলেন এবং সংস্কৃত ভাষা জানিতেন ইহা সকলে জানেন। আর এছাড়াও গীতার কথোপকথনে অর্জুন ও সংস্কৃত জানতেন। এখন দয়াকরে এটা বলিয়েন না যে অর্জুনও যোগযুক্ত অবস্থায় ছিলেন।

এবার গীতার বিশ্বরূপ দর্শন যোগ অধ্যায়ে আসি। এই অধ্যায়ে যেভাবে অর্জুন বিশ্বরূপ দেখেছেন সেরকমভাবে কোন যোগী অন্য কোন সাধারণ মনুষ্য কে দেখাতে পেরেছেন কি?

🔸এখন উদাহরণ হিসেবে ভ্রাতাগন পুরাণের গনেশ কিংবা অমুক তমুক এর কথা বলিয়া থাকেন। যদিও ওনারা পুরাণ মানেন না কিন্তু ক্ষেত্রে বিশেষে নিজেদের প্রয়োজনে সুবিধামতো ঠিকই পুরাণ নিয়ে আসেন। আচ্ছা মানিলাম পুরাণের বিশ্বরূপ গুলোও প্রকৃত। কিন্তু ঐ সব বিশ্বরূপের সাথে গীতার বিশ্বরূপ এর মিল কোথায়? যদি মিল হয় তাহলে স্বয়ং বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ মিথ্যাবাদী অথবা স্বয়ং ঈশ্বর মিথ্যাবাদী (যাহারা মনে করেন যোগযুক্ত অবস্থায় ঈশ্বর কথা বলেন)। কেননা তিনি নিজেই গীতায় বলেছেন আমার এ বিশ্বরূপ আগে কেউ দেখেনি। আর বৈদিক কোন শাস্ত্রেও কোন ঋষি অন্য ঋষিকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন এরকম কোন প্রমাণ নেই। সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার এজন্যই তিনি এরকম বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন।

আরও একটা জিনিস অ্যাড করছি। যোগযুক্ত আর যোগমুক্ত শব্দদ্বয় কিন্তু কেবল অনুগীতার ঐ অংশেই পাওয়া যায় যা প্রক্ষিপ্ত আমি গীতা দিয়েই প্রমাণ করেছি। আবার প্রমাণ করব যে এটা প্রক্ষিপ্ত। এই প্রসংগে বলি, আমার ভ্রাতাগনসহ আমিও বেদ কে ঈশ্বরের বাণী মানিয়া থাকি।এখন বেদ ঋষি মুখ হতে নিঃসৃত হলেও উহা ঋষিগণের যোগযুক্ত অবস্থার বাণী, নিজেদের বানী নয়। আর যখন যে ঋষি কোন সুক্ত দর্শন করিতেন তখন নিশ্চয়ই তাহার আশেপাশে কেহই তাহা রেকর্ড করিয়া রাখিতেন না। তাই তাহাদের যোগযুক্ত অবস্থার সমাপ্তির পরও বেদের মন্ত্রগুলি কিভাবে মনে রাখিতেন?
সুতরাং যোগযুক্ত অবস্থায় প্রাপ্ত বানী যোগমুক্ত অবস্থায় ভুলে যাওয়াটা কেমন দেখায়? বৈদিক ঋষিরা তাহলে পরবর্তীতে কিভাবে বেদের মন্ত্রসকল মনে রেখেছেন। এসব যুক্তিতর্ক মূর্খতা নয় কি? যেহেতু শ্রীকৃষ্ণকে পুরুষোত্তম মানা হয় সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ অবশ্যই সেইসব মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। কারণ হিসেবে বলা যায় শ্রীকৃষ্ণ ৬০০- এর উপরে বাণীর দ্রষ্টা (যাহারা যোগযুক্ত মনে করেন তাদের ভাষ্যমতে)
সুতরাং যোগমুক্ত অবস্থায় যোগযুক্ত গীতার বানী ভুলে যাওয়া এরকম মনে করা মূর্খতা নাহলে হঠকারী অপপ্রচার মাত্র।

🔸আমার কথায় বার-বার স্পষ্ট হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ এর যোগযুক্ত আর যোগমুক্ত অবস্থার ধারণা মিথ্যা বানোয়াট এবং বিশেষ অপপ্রচারেই অংশমাত্র।

 শেষ আরেকটা প্রমাণ করব, বেদের মন্ত্রকে কিন্তু মন্ত্র বলা হয় শ্লোক নয়। কারন মন্ত্র হচ্ছে সেই জিনিস যাহা যোগযুক্ত অবস্থায় মনন করে উৎপাদিত। আর শ্লোক হল ব্যাক্তি বিশেষের রচিত কথা বা বাণী। সুতরাং যাহারা গীতার যোগযুক্ত তত্ত্ব মানেন তাহাদের অবশ্যই বলিতে হবে, গীতার শ্লোকসমুহ মন্ত্রই। কারণ শ্লোক বলিলেই তাকে মানিতে হইবে সকলই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বানী। পরমাত্মার সাথে সংযুক্তির অর্থাৎ যোগযুক্ত অবস্থার কথা কখনো শ্লোক হতে পারেনা ইহা কেবলই মন্ত্র। তাই গীতার শ্লোক বলিলেও উহা শ্রীকৃষ্ণ এর বাণী হিসেবেই গ্রাহ্য হইবে।

🔘 যাইহোক অনেক কথা বলিলাম। শ্রীকৃষ্ণ যে ঈশ্বরের অবতার ইহা নিসন্দেহে প্রমাণিত। তারপরও যাহারা মানিতে চান না তাহাদের নিয়ে আমাদের সমস্যা নেই। আর যাহারা শ্রীকৃষ্ণ কে ঈশ্বর মানেন তাহাদিগকেও বলছি শ্রীকৃষ্ণ কে শুধু পূজা করলেই হবেনা। শ্রীকৃষ্ণ এর সত্যিকারের পূজা হবে তখনই যখন আমরা তাহার আদর্শ নিজ জীবনে প্রস্ফুটিত করিতে পারব। কেননা গীতায় স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেন, যদিও তাঁহার কর্ম করার প্রয়োজন নেই, তবুও লোকশিক্ষার্থে তিনি কর্ম করেন। সুতরাং একবার ভাবুন স্বয়ং ঈশ্বর অবতার হয়ে আমাদের মত মূর্খ মানুষ দের শিক্ষার পথ দেখিয়েছেন। আর তা যদি আমরা নিজ জীবনে প্রস্ফুটিত না করি তাহলে তাঁহার অবতরনের উদ্দেশ্যই বৃথা। তাই শুধু ঘরে শ্রীকৃষ্ণের ছবি টাংগিয়ে কীর্তন করে পুজা করেই লাভ হবেনা, লাভ হবে তখনই যখন আপনি তাহাকে নিজ আচরণে প্রস্ফুটিত করিয়া তাহাকে পুজা করিবেন। অন্যদিকে যারা বেদ বেদ বলিয়া গলা ফাটাইয়া কুতর্কে লিপ্ত হচ্ছেন তাহারাও বেদোক্ত মন্ত্রসকলকে নিজের মধ্যে ধারণ করিয়া জীবন অতিবাহিত করুন তবে আর এসব কুতর্ক করারর জন্য অবসর পাইবেন না। আজ সনাতন ধর্মের অধঃপতন কারণ হচ্ছে আমরা শ্রীকৃষ্ণ এর পূজা করছি কিন্তু তাহাকে মনন করিনা। সেদিনই সুদিন আসিবে যেদিন আমরা সবাই আচরণে কর্মে তাহার আদর্শ ফুটিয়া তুলিয়া তাহার পূজা করিব।

ওঁ পরমাত্মনে নমঃ
জয় শ্রীকৃষ্ণ জয় সত্য সনাতন

অংকন ভট্টাচার্য 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ