ঋগ্বেদ সংহিতার শাকল শাখার ১০ম মণ্ডলের ১৭৭ তম সূক্তের দ্রষ্টা প্রজাপতির পুত্র পতঙ্গ ঋষি। সেখানে “মায়াবাদ" প্রতিপাদিত হয়েছে। এ কারণে এই সুক্তের দেবতা মায়া। সেই পতঙ্গসুক্তে বা মায়াসুক্তে তিনটি মন্ত্র রয়েছে।
"পতঙ্গমক্তমসুরস্য মায়য়া হৃদা পশ্যন্তি মনসা বিপশ্চিতঃ।
পতঙ্গো বাচং মনসা বিভতি তাং গন্ধর্বোহবদদ গর্ভে অন্তঃ।
তাং দ্যোতমানাং স্বর্যং মনীষা-মৃতস্য পদে কবয়ে নিপন্তি।। ২
অপশ্যং গােপামনিপদ্যমানম্ আ চ পরা চ পথিভিশ্চরন্তম্।
স সধ্রীচী বিষ্ণুচীর্বসানঃ আ চরীবর্তি ভুবনেস্বন্তঃ।।"৩
ঋগ্বেদ সংহিতা, শাকল শাখা, ১০/১৭৭/১-৩
এই মন্ত্র তিনটি অন্যত্রও অনূদিত হয়েছে
[ ১.তৈত্তিরীয় আরণ্যক ৩।১১।১০-১১( প্রথম দুই মন্ত্র ; ১ম মন্ত্রের বিপশ্চিতঃ স্থলে মনীষিণঃ পাঠান্তরে); ৪।৭।১ ( তৃতীয় মন্ত্র ); ২. জৈমিনীয়োপনিষদব্রাহ্মণ, ৩।৩৫।১, ৩।৩৬।১, ৩।৩৭।১]
তৃতীয় মন্ত্র দীর্ঘতমা ঋষিও দর্শন করেছিলেন (ঋগ্বেদ সংহিতা ১/১৬৪/৩১) । এটি অপর সংহিতাদিতেও পাওয়া যায়।
যেমন-
বাজসনেয়ী সংহিতা ( মধ্য ), ৩৭।১৭,
কাণ্বসংহিতা, ৪।৭।৩।৪;
অথর্ববেদ সংহিতা, ৯।১৫।১১ ও
মৈত্ৰায়নী সংহিতা, ৪।৯।৬
ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থে এই মন্ত্র তিনটি বা এদের কোন কোনটি, কোথাও প্রাণ পক্ষে আবার কোথাও আদিত্য পক্ষে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
যেমন-
জৈমিনীয়ােপনিষদ্ব্রাহ্মণে উপরে উল্লিখিত তিনটি মন্ত্রই প্রাণের পক্ষে ব্যাখ্যাত হইয়াছ। (৩/৩৫/২-৭; ৩/৩৬/২-৬ ও ৩/৩৭ ২-৬)।
তৃতীয় মন্ত্রের ব্যাখ্যা তিনটি বিভিন্ন অর্থে করা হয়েছে। যথা-
(১) প্রাণ পক্ষে, ঐতরেয় আরণ্যকে- ২/১/৬ এবং তৈত্তিরীয় আরণ্যকে- ৫/৬/১০।
(২) আদিত্য পক্ষে,
শতপথ ব্ৰাহ্মণে (মাধ্যন্দিন শাখা)- ১৪/১/৪/৯-১০; তৈত্তিরীয় আরণ্যক- ৫/৬/১১
(৩) জীবভুত পরমাত্মা পক্ষে নিরুক্তে
এই সূক্ত সম্বন্ধে শৌনক লিখিয়াছেন, “তৎ সৌর্য্যামকে মন্যস্ত মায়াদদ্বং তথাহপরে।” (বৃহদ্দেবতা- ৮/৭৫)।
তাঁর মতে, দ্বিতীয় মন্ত্রে বাক্ দেবীর স্তুতি করা হয়েছে (বৃহদ্দেবতা- ৮/৭৬)।
এছাড়াও, ভাষ্যকার সায়ন এই মন্ত্রগুলোর ব্যাখ্যায় কোথাও কোথাও জীব এবং পরমাত্মা পক্ষেও ব্যাখ্যা করেছেন।
যথা-
আদিত্য পক্ষে-
ঋগ্বেদ সংহিতা ভাষ্য- ১/১৬৪/৩১;
তৈত্তিরীয় আরণ্যক ভাষ্য- ৩ /১১/১০-১১; ৪/৭/১ (আদিত্যরূপে মহাবীর)।
সূৰ্য্য এবং জীবভুত পরমাত্ম পক্ষে-
ঋগ্বেদ সংহিতা ভাষ্য- ১০/১৭৭/১-২।
বিশেষ প্রণিধান করলে দেখা যায়,
দীর্ঘতম ঋষি কর্তৃক দৃষ্ট ‘বামীয় সূক্তে' (ঋগ্বেদ সংহিতা, ১/১৬৪ ) "অপশ্যং গােপাং" এই মন্ত্রের পূর্বের এবং পরের মন্ত্র জীববিষয়ক।
এই মন্ত্রের পূর্বের মন্ত্র (ঋগ্বেদ সংহিতা- ১/১৬৪/৩০) জীবের জন্মমৃত্যু বিষয়ে। আবার,এটির অব্যবহিত পরের মন্ত্রে (ঋগ্বেদ সংহিতা- ১/১৬৪/৩২ ) জীবের গর্ভস্থ ক্লেশ এবং সন্তান জন্মদানে পিতামাতার অজ্ঞানতা বর্ণিত হয়েছে। তারপরের মন্ত্রে (ঋগ্বেদ সংহিতা- ১/১৬৪/৩৩ ) ঋষির আপন জন্ম সম্বন্ধে বলা হয়েছে।
এমনকি, অথর্ববেদেও এ প্রকার দেখা যায়। যথা-
অথর্ববেদ সংহিতা = ঋগ্বেদ সংহিতা
৯/১৫/৮ = ১/১৬৪/৩০
৯/১৫/৯ = ১০/৫৫/৫ (জীবের যৌবন, জরা, মৃত্যু ও পুনর্জন্ম বিষয়ক)
৯/১৫/১০= ১/১৬৪/৩২
৯/১৫/১১= ১/১৬৪/৩১
৯/১৫/১২= ১/১৬৪ /৩৩
(সমান চিহ্ন দ্বারা একই মন্ত্র দুই বেদে -এটি বোঝানো হয়েছে)
তাই এই আলোচনা থেকে বোঝা যায়, দীর্ঘতমার সূক্তে ৩য় মন্ত্রটি (১/১৬৪/৩১) অবশ্যই জীববিষয়ক। সুতরাং মায়াসুক্তেও এই মন্ত্রটিকে সেই অর্থে গ্রহণ করা যায়।
ভগবান যাঙ্ক বস্তুতই এটিকে জীবভূত পরমাত্মা পক্ষে গ্রহণ করেছেন। তাই এর পূর্বের দুইটি মন্ত্রকেও এবং সমগ্র মায়াসুক্তকে জীব বিষয়ক বলা যেতে পারে।
সায়নাচাৰ্য্য ঐ দুই মন্ত্রকে জীবপক্ষেই ব্যাখ্যা করেছেন,
‘অসুরের মায়া ( অর্থাৎ পরব্রহ্ম সম্বন্ধী ত্রিগুণাত্মিকা মায়া) দ্বারা জীবরূপে অভিব্যক্ত পতঙ্গ বা পরমাত্মাকে পণ্ডিতগণ মন দ্বারা (অর্থাৎ মানসচক্ষে ) হৃদয় ভ্যন্তরে দর্শন করেন। ক্রান্তদর্শিগণ সমুদ্র বা পরমাত্মার মধ্যে (অর্থাৎ অধিষ্ঠানভূত তাহাতে সমস্ত জগৎপ্রপঞ্চ অধ্যস্তরূপে ) দেখেন। পণ্ডিতগণ ( বৃত্তিজ্ঞানরূপ ) কিরণসমূহের অধিষ্ঠানকে (পরব্রহ্মকে) লাভ করতে ইচ্ছা করেন।' ১
‘পতঙ্গ বা পরমাত্মা মনে মনে বাক্য ধারণ করেন (অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে তিনি মনে মনে স্রষ্টব্য বিষয় পর্যালােচনা করেন)। গর্ভ বা হিরন্ময় ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে গন্ধর্ব (হিরণ্যগর্ভ ) সেই বাণী বলেছেন। সেই দৈববাণী দিব্য এবং স্বর্গদায়ী। কবিগণ অমৃতের স্থানে তাকে রক্ষা করেন। ২
অথচ তৃতীয় মন্ত্রের ব্যাখ্যা তিনি জীবপক্ষে করেননি। এটি করাই তাহার বিশেষ উচিত ছিল।
যাই হোক, ৩য় মন্ত্রটির অর্থ হওয়া উচিত ছিল এরূপ,
“গােপা বা ইন্দ্রিয়াধিষ্ঠাতাকে (অর্থাৎ জীবভূত পরমাত্মাকে) দেখলাম। তার পতন বা বিনাশ নেই। সে নিকটে ও দূরে ( অর্থাৎ ইহলােকে এবং পরলােকে, ও জীবনকালে ইন্দ্রিয়মার্গে ইতস্তত ) নানা পথে বিচরণ করিতেছে। সে দিক-বিদিক আচ্ছাদন করে অবস্থিত অর্থাৎ সর্বব্যাপী। (তথাপি) এইরূপে সে ভুবন মধ্যে পুনঃপুনঃ আবর্তন করছে।"
বেদের সিদ্ধান্ত অনুসারে ব্রহ্ম বা প্রাণ দেবতাই আদিত্য মণ্ডলে হিরন্ময় পুরুষ রূপে এবং শরীর মধ্যে জীবাত্মারূপে বা মুখ্য প্রাণরূপে অবস্থিত। তাই আদিত্য পুরুষ এবং শরীর পুরুষ বস্তুত সম্পূর্ণ অভিন্নই। “অপশ্যং গোপ” -এই মন্ত্রটি তৈত্তিরীয়ারণ্যকে (৪/৭/১) মহাবীরের পক্ষে কথিত হইয়াছে। প্রকরণ থেকে তাই জানা যায়। এমনকি কল্পসূত্রেও তা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আবার পরে এটি প্রাণ ও আদিত্য পক্ষে ব্যাখ্যাত হইয়াছে।
তাই এটি খুব সহজেই বোঝা যায়, মহাবীরই প্রাণরূপ এবং আদিত্যরূপ। সায়ণাচার্যও তাই বলেছেন।
জগৎপ্রপঞ্চ প্রাণেরই মহিমা, প্রাণই তাকে রক্ষা করছে এবং এর দ্বারা প্রাণ আছন্ন -এই সিদ্ধান্তের প্রমাণরুপে ঐতরেয়ারণ্যকে (২/১/৬) এই মন্ত্র উল্লেখিত হয়েছে।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, মায়াসুক্তের মন্ত্রকে যে ব্রাহ্মণাদিতে কোথাও আদিত্য পক্ষে, কোথাও প্রাণ আবার কোথাও জীব পক্ষে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাতে কোন অসামঞ্জস্য হয় নাই।
এছাড়া ‘নিরুক্তে'র পরিশিষ্টে যাস্কাচাৰ্য দেখিয়েছেন যে, “অপত্য গোপ” ইত্যাদি মন্ত্র ব্যতীত বেদের আরো অনেক মন্ত্রকে অধিদৈবত এবং অধ্যাত্ম দৃষ্টিতে আদিত্য এবং আত্মা পক্ষে ব্যাখ্যা করা যায়।
তার মানে ঐ সমস্ত মন্ত্র বস্তুত পরমাত্মা প্রতিপাদক।
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, ব্ৰহ্মই “অসুরের মায়া দ্বারা”('অসুরস্য মায়য়া') মুখ্য প্রাণ, আদিত্য জীবরূপ পতঙ্গ হয়েছেন। প্রথম মন্ত্রে স্পষ্টতই তা বলা হয়েছে । সুতরাং এটি গর্গ ঋষির “ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরুরূপমীয়তে" বাণীর মতই।
অতএব, মায়াসূক্তে মায়াবাদই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং মায়াবাদ বেদসম্মত।
আমরা জানলামঃ
মায়া সুক্তের ১ম ও ২য় মন্ত্রে জীবাত্মার বর্ণনা থাকায়
৩য় মন্ত্রের অর্থও জীবাত্মা অর্থাৎ জীবপক্ষে হওয়া সমীচিন যেটি সায়নাচার্য করেননি।
৩য় মন্ত্রটিও তৈত্তিরীয় আরণ্যকের ৪/৭/১ এ মহাবীর অর্থাৎ প্রাণপক্ষে বলা হয়েছে। নিরুক্তেও এটি জীবভূত পরমাত্মা পক্ষেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
তাই, পরমাত্মাই জীবের স্বরূপ এবং মায়াদ্বারা জীবজগত রূপে প্রতীত হন - এই বিষয়টিই মায়াসুক্তের প্রতিপাদ্য।
(বিঃদ্রঃ বিভিন্ন সোর্স থেকে সংগ্রহীত)
প্রচারেঃ
SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
সনাতন শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।।
0 মন্তব্যসমূহ