বেদে গোমাংস ভক্ষণ অস্বীকৃত ও নিষিদ্ধ।।

 

★ বেদে কি গোমাংস ভক্ষনের প্রসঙ্গ আছে? 

বেদে গোমাংস ভক্ষণ বিষয়ক একাধিক লিখা আমাদের (SPS) ব্লগে উপলব্ধ আছে। সেগুলোর লিংক দিয়ে দেওয়া হলো।

1/ https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2021/05/blog-post.html?m=1 

2/ https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2021/05/blog-post_5.html?m=1

তবে এই বিষয়ে বেদাচার্য দুর্গাদাস লাহিড়ীর বক্তব্য আমরা অধিক মান্য করবো কারণ দুর্গাদাস লাহিড়ী একজন বাঙালী হিসেবে বাংলাভাষায় এই বিষয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন যা বাংলাভাষী হিসেবে আমাদের নিকট অধিক বোধগম্য। 

বর্তমানে ধর্মসচেতন হিন্দু সমাজে "বেদে গোমাংস ভক্ষণ" একটি আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়। যদিও হাজার বছরের বৈদিক পরম্পরায় মূল সনাতন সমাজ এই বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করে তথা গোমাংস ভক্ষণ ত দূর বরং গোমাতাকে দেবজ্ঞানে পূজা করে। উলটো দিকে একটি বিশেষ গোষ্ঠী বেদের এই বিতর্কিত অংশটি দেখিয়ে বা ভুলভাবে উপস্থাপন করে সাধারণ হিন্দুদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে নিজেদের হীনস্বার্থ (মূল উদ্দেশ্য বই বিক্রি ও নিজেদের দল ভারী করা) বাস্তবায়ন করে। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে অহিন্দু সমাজ এগুলোর ফায়দা নিচ্ছে এবং বেদে গোমাংস ভক্ষণ বৈধ প্রচার করে তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত শাস্ত্রীয় জ্ঞান ও শাস্ত্রচর্চার অভাবে সাধারণ হিন্দুরা (যারা গোমাংস ভক্ষণকে মহাপাপ ভোজন হিসেবেই দেখে) এই বিষয়গুলোর সঠিক জবাব দিতে পারে না এবং বিভ্রান্তকারীদের বক্তব্যকেই সত্য হিসেবে ধরে নেয়। 

অথচ বঙ্গের শ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ বেদাচার্য বেদবিশারদ দুর্গাদাস লাহিড়ী শতবর্ষ পূর্বেই এই শঙ্কার চমৎকার সমাধান করে দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গ সমাজ এই সত্য হতে বিস্মৃত হয়েছে বলেই অনাচারী অবৈদিকরা বেদ প্রচারের নামে বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে। আজ উনার লেখনীর উপর ভিত্তি করেই এই জটিল ও বিতর্কিত শঙ্কার সহজ ও সাবলীল সমাধান আপনাদের সামনে তুলে ধরবো বলে আশা করছি। 

"অস্মা ইদু প্র ভরা তৃতুজানো বৃত্রায় বজ্রমীশানঃ কিয়েধাঃ।
গোর্ন পৰ্ব্ব বি রদা তিরশ্চেষ্যন্নর্ণাংস্যপাং চরধ্যৈ।।" 

 ~ঋগ্বেদসংহিতা [১/৬১/১২]

🔸প্রচলিত অর্থঃ মাংসচ্ছেদক ব্যক্তিরা (কসাইরা) যেমন গো-পশুর অবয়ব সকল ছেদন করিয়া পৃথক করে, ইন্দ্র সেইরূপ তীর্যকভাবে বৃত্রাসুরের দেহগ্রন্থি সকলকে অথবা মেঘ মূহকে ছিন্নভিন্ন করিয়াছিলেন।

🔹 ব্যাখ্যাঃ এখানে 'গোর্ন' পদের সঠিক অর্থ নিয়ে বিস্তর ভ্রান্তি থাকায় ভাষ্যকার ও অনুবাদকগন সঠিক অর্থ নিরুপন করতে পারেনি বলেই ধারনা করা হয়। এর ফলাফলস্বরূপ এইরূপ গোমাংসপর্ক অর্থ নিরূপিত হয়েছে। 

"পর্ব্ব বি রদা তিরশ্চা" -এই বাক্যাংশের সাথে 'গোর্ন' উপমার পদ সংযুক্ত থাকায়, মন্ত্রের সঠিক ভাবার্থে রয়েছে বিস্তর মতবিরোধ। এই কারনে বেশকিছু অনুবাদকপাঠী, সংস্কৃতজ্ঞ ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষকগন এই ধরনের মন্ত্রের বিভিন্ন অনুবাদ বা ভাষ্য দেখিয়ে প্রাচীন আর্য্য-সমাজে গোমাংস ব্যবহার প্রচলিত ছিল বলে দাবি করেন। আসলে অনেক সময় এসব ক্ষেত্রে ভাষান্তরের কারণে ভাবান্তর হওয়ার বিষয়টাও মুখ্য হয়ে যায়। 

এরপর পণ্ডিত দুর্গাদাস লাহিড়ী এই মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ নিরূপণ করতে গিয়ে বলেন

“এই মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ এই মন্ত্রের অন্তর্গত 'গোর্ন' উপমা উপলক্ষে.......। কেননা, এখানে ঐ দুই পদের অর্থই অন্যরূপ। ‘গোর্ন' পদে কেন গো-গণকে হনন করার ভাব গ্রহণ করিব? উপমার শব্দগত অর্থ— 'গো-র ন্যায়'। তাহা হইতে ‘গোকে যেমন’ এই ভাবও গ্রহণ করা যায়, আবার 'গো যেমন' এই ভাবও গ্রহণ করিতে পারি। আমরা শেষোক্ত ভাবেরই সঙ্গতি দেখি। বিশেষতঃ, মন্ত্রের অন্তর্গত ঐ যে 'তিরশ্চা' পদ উহার দ্বারাই উপমায় রশ্মির বা আলোক-রেখার সম্বন্ধ খ্যাপন করিতেছে। আলোক রশ্মিই তির্য্যগভাবে গমন করে; আলোক-রশ্মির দ্বারাই অন্ধকার তীর্যকভাবে বিদীর্ণ হয়। 

'অপাং' প্রভৃতি পদে পূর্ব্বাপর আমরা যে ভাব গ্রহণ করিয়া আসিয়াছি, এখানেও তাহারই সঙ্গতি দেখি। অজ্ঞানতা-রূপ শত্রুর যে আশ্রয়-স্থল, তাহার যে সন্ধিক্ষেত্র, আমাতে, জ্ঞান-রূপ অস্ত্রের সংযোগ করিয়া তাহাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেন,    —ইহাই এই মন্ত্রের প্রার্থনা।”

🚩 ভাষ্যকার প্রসঙ্গঃ 

এবার আসি ভাষ্যকারদের প্রসঙ্গে। পণ্ডিত দুর্গাদাস লাহিড়ী এই প্রসঙ্গটিও এড়িয়ে যাননি। তিনি ভাষ্যকারদের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, "মন্ত্রে এই ভাব ব্যক্ত আছে বলিয়া আমরা মনে করিলেও, ভাষ্যকারগণ কেহই কিন্তু তাহা বলেন নাই ।"  

আমরা উক্ত মন্ত্রের সায়নভাষ্যানুবাদে দেখতে পাই, 

‘তুতজান'— এই পদ ক্ষিপ্রনাম মধ্যে গণ্য। তুতজান অর্থাৎ ত্বরমাণ অথবা শত্রুর হিংসাকারী। 'ঈশানঃ' অর্থাৎ ঈশ্বর, সকলের ‘কিয়েধাঃ' অর্থাৎ কাহারও পরিজ্ঞাত নহে এতাদৃশ বলের ধারণকৰ্ত্তা, অথবা ক্রমমাণ শত্রুবলকে ধারণ করিয়া অবস্থান করেন -এই অর্থে 'কিয়েধাঃ' পদ প্রযুক্ত হয়। 

হে ইন্দ্ৰ! এবম্ভূত আপনি সেই বৃত্তের নিমিত্ত বজ্রকে ‘প্রভর’ অর্থাৎ সেই বৃত্রকে বজ্রের দ্বারা প্রহার করুন। প্রহার করিয়া, 'অর্ণাংসি' অর্থাৎ বৃষ্টির জল - সমূহকে 'ইষ্যান্' অর্থাৎ সেই বৃত্র হইতে নির্গত করিয়া, জলসমূহকে ভূপ্রদেশে প্রতিগমনের জন্য, সেই বৃত্তের মেঘরূপ অবয়ব-সম্বন্ধি পর্ব্বকে আপনি তির্য্যগভাবে অবস্থিত বজ্রের দ্বারা ছেদন করুন। তদ্বিষয়ে দৃষ্টান্ত: 'গোর্ন'। অর্থাৎ, মাংসের ছেদনকারী লৌকিক পুরুষগণ পশুর অবয়ব-সমূহ তাহা হইতে যেমন বিচ্ছিন্ন করে, তদ্বৎ। 

এ বিষয়ে নিরুক্ত আছে, – 'অস্ম প্রহর.....চরণায়'। নিরুক্ত ৬।২০।।

কিন্তু এখানেও আচার্য সায়নকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। কেননা  তিনিও এই মন্ত্রের নিরুক্ত অনুসারে ভাষ্য করতে গিয়ে দুর্গাচার্য্য বৃত্তির সহায়তা গ্রহন করেন। আর দুর্গাচার্য্য স্বয়ং এইরূপ অর্থ গ্রহন করেছিলেন। এবার পণ্ডিত দুর্গাদাস লাহিড়ী দাবি করেন দুর্গাচার্য্যের উক্তমত তাঁহার নিজস্ব, কেননা পূর্বতন ঋষি ও আচার্যগন কোথাও 'গোর্ন' অর্থ 'গো-হনন' অর্থ গ্রহন করেন নাই। তিনি আরো বলেন, “সেখানে 'কিয়েধাঃ' পদের অর্থ উপলক্ষে পূর্ব্বোক্ত মন্ত্রটাই উদ্ধৃত হইয়াছে বটে; কিন্তু 'গোর্ন' পদের প্রতিবাক্যে 'গোরিব' মাত্র ব্যবহৃত। তাহা হইতে গো-গণকে ছেদনের ভাব গ্রহণ করা যাইতে পারে না। সুতরাং ভাষ্যের ও ব্যাখ্যাদির অনুসরণে মন্ত্রটীকে আমরা সে দৃষ্টিতে দেখিতেছি না।”

🔹মর্ম্মানুসারিনী ব্যাখ্যাঃ

দুর্গাদাস লাহিড়ী কর্তৃক প্রদত্ত উক্ত মন্ত্রের মর্ম্মানুসারিনী ব্যাখ্যার বঙ্গানুবাদ:- 

“হে ভগবন্ ! শত্রুহননকারী, পরমৈশ্বর্য্যশালী, অসীমবলসম্পন্ন আপনি, সেই ব্যাপক প্রসিদ্ধ অজ্ঞানতারূপ অসুরের প্রতি জ্ঞান-রূপ অস্ত্র নিক্ষেপ করুন; (অর্থাৎ, সেই অজ্ঞানতা-রূপ শত্রুকে জ্ঞান-রূপ অস্ত্রের দ্বারা ছেদন করুন)। আলোক রশ্মি যেমন অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে অথবা জ্ঞানজ্যোতির দ্বারা অজ্ঞানতা যেমন বিচ্ছিন্ন হয়, সেইরূপ, হে ভগবন্! আপনি শত্রুর সন্ধিস্থলকে (তাহার আশ্রয়কে বা শক্তিকে) অস্ত্র দ্বারা অর্থাৎ সরল সৎকর্ম্মের বা শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে, সৰ্ব্বতোভাবে বিচ্ছিন্ন করুন। আর সত্ত্বাভিলাষী আমাকে লক্ষ্য করিয়া, এই ভূপ্রদেশের প্রতি আগমনের জন্য, সর প্রবাহ সমূহকে সঞ্চালিত করুন। 

(ভাব এই যে, – 'হে ভগবন্! আমাদিগকে সংকপিরায়ণ সত্ত্বভাবান্বিত করুন এবং আমাদিগের অজ্ঞানতাকে দূর করিয়া দিন।)।”

তাহলে উক্ত মন্ত্রের ভাবানুবাদ এমন হয় যে, হে ভগবন্! সরল সৎকর্মের দ্বারা আমরা যেন অজ্ঞানতাকে দূর করিতে পারি।

দেখতেই পাচ্ছি যে, 'গোর্ন' পদের মূল অর্থ নিয়ে বেদজ্ঞদের মধ্যে গবেষণার শেষ নাই। অনেকেই এই পদসমূহের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দিয়ে দাবি করেন প্রাচীন আর্য্য সভ্যতায় গোমাংসের প্রচলন ছিল। শুধু তাই নয়, অনেকে তো ইহা অব্দি দাবি করেছেন যে পূর্বে গৃহে অতিথি আসলে গোমাংস রন্ধন করে খাওয়ানো হতো। কিন্তু এসব মত নিতান্তই পাশ্চাত্য কল্পনাপ্রসূত। 

অবশেষে পণ্ডিত দুর্গাদাস লাহিড়ী বলেন, অশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে অশ্বমেধ বা পুরুষমেধ যজ্ঞের প্রকরনে কোথাও গোহননের কথা নাই। আর যেসব ব্যাখ্যাকার এইরূপ অর্থ গ্রহন করেছেন তা ভ্রমসঙ্কূল। অর্থাৎ, ব্যাখ্যাকারগনের এইরূপ ব্যাখ্যার জন্য শাস্ত্রকে দোষারোপ করা যায় না। আচার্য দুর্গাদাসের এই নিখুঁত বিশ্লেষণের পর আশা করি কারো সন্দেহ থাকবে না যে বেদে গোমাংস ভক্ষণ সমর্থন রয়েছে। বেদাচার্য যেরূপ এই মন্ত্রের মূল অর্থ নিরূপণ করে গোহহনের দাবি খণ্ডন করেছেন সেরূপ বাকি মন্ত্রগুলোরও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দ্বারা বিভ্রান্তিমূলক দাবিগুলো খণ্ডন করা সম্ভব। 

🔸 আপত্তি নিরসনঃ

অনেকেই  যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতায় একটি শ্লোক দ্বারা প্রাচীন কালে গোমাংসের ব্যবহার সিদ্ধ করার চেষ্টা করেন। শ্লোকটি হলো, 

"মহোক্ষন বা মহাজং বা শ্রোত্রিয়ায়োপকল্পয়েৎ।
সংক্রিয়াম্বাসনং স্বাদুভোজনং সুনৃতং বচঃ॥"

এখানে কেউ কেউ 'শ্রোত্রিয়োপকল্পয়েৎ' এর স্থানে 'শ্রোত্রিয়ায় প্রকল্পয়েৎ' লেখেন। এখানে 'উপকল্পয়েৎ' বা 'প্রকল্পয়েৎ' শ্লোকার্থেই ভ্রান্তি দৃষ্ট হয়। এর ভীষম ব্যাখ্যাই কিছু অসাধু ব্যাক্তিদের এই শ্লোকে গো-মাংস ভক্ষন সমর্থিত ভাবার্থ খুজে পেতে সাহায্য করে। কিন্তু বাস্তবে এর মর্মার্থ সম্পুর্ণ আলাদা। 

পণ্ডিত দুর্গাদাস লাহিড়ী মহোদয় এই শ্লোকের অর্থ নিরূপণ করে বলেন, 

'শ্রোত্রিয়ায়' (সৰ্ব্ববেদাধ্যায়ী সুপণ্ডিত সাধু অতিথিকে) 'মহোক্ষং' (পাপবিধৌতকারী অভীষ্টপূরক পরমধনপ্রদাতা) অথবা ‘মহাজং’ (মহাত্মা মুক্তপুরুষ) জ্ঞানে সংবন্ধর্না করিবে এবং উপযুক্ত আসন ও স্বাদু ভোজ্যাদি-দানে প্রিয় সত্য-বাক্যে পরিতুষ্ট করিবে । 

এভাবে বেদসংহিতা হতে মন্ত্রের অনুবাদ দেখিয়ে যারা প্রাচীনযুগে গোমাংস ভক্ষন প্রমাণ করতে চান আমাদের বেদাচার্য পণ্ডিতদিগের ব্যাখ্যার মাধ্যমে তাদের অনায়াসে খণ্ডন করা সম্ভব। বেদের মন্ত্রসমূহ কখনো একটি স্পেসিফিক অর্থ নির্দেশ করে না। বেদের প্রতিটি মন্ত্রই Multilayered। এখানে কোন সিদ্ধান্তই আল্টিমেট নয়। 

নিরুক্তেই বেদমন্ত্র ব্যাখ্যার নয়টি পক্ষের কথা পাওয়া যায়। যথা: অধিদৈবত, অধ্যাত্ম, আধ্যানসময়, ঐতিহাসিক, নৈদান, নৈরুক্ত, পরিব্রাজক, পূর্বযাজ্ঞিক ও যাজ্ঞিক। ইতিহাস কি বলে তা আমাদের এখানে আলোচ্য বিষয় নয়, কিন্তু যারা বেদমন্ত্রের অনুবাদ দেখিয়ে সর্বশাস্ত্র ও সর্বাচার্য নিষিদ্ধ গোমাংস ভক্ষনের সিদ্ধতা প্রমাণে ব্যস্ত তাদের বিবিধ পক্ষের ব্যাখ্যা দেখিয়েই তাদের দাবির বালখিল্যতা প্রমাণ করা সম্ভব। 

সম্ভাব্য প্রশ্নোত্তরঃ

❓পণ্ডিত দুর্গাদাস কি সায়ণাচার্যের চেয়ে বেশি বুঝতেন?

✅ বেদাচার্য বেদবিশারদ পণ্ডিত দুর্গাদাস লাহিড়ীর জীবনী অধ্যয়ন করলে তাঁর পাণ্ডিত্য নিয়ে এই প্রসঙ্গ আসবে না। দুর্গাদাস লাহিড়ী অসম্ভব পণ্ডিত ছিলেন এবং বঙ্গের শ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ বললেও অত্যুক্তি হবে না। তাই তিনি আচার্য সায়ণকৃত কোন ব্যাখ্যার যৌক্তিক আলোচনা করতেই পারেন। এখানে তিনি ব্যক্তিগত অপছন্দের কারনে সায়ণাচার্যের মত গ্রহন করেননি তা কিন্তু নয়। তিনি প্রবল যুক্তি দ্বারাই সায়ণাচার্যের মত অতিক্রম করে নিজের মত পেশ করেছেন। 

❓ সায়ণের ভাষ্যে সমস্যা থাকলে আপনারা সায়ণার্যের ভাষ্য মানেন কেন?

✅ যিনি বেদের সংহিতা ভাগ (৫ খানা সংহিতা) এবং বেদের ব্রাহ্মণ ও আরণ্যকের (১৩ খানা) হাজার হাজার মন্ত্রের ভাষ্য ও ব্যাখ্যা দিয়ে পরম্পরাগত বেদচর্চার পথকে আরও সুগম করে দিয়ে গিয়েছেন কেবলমাত্র একটি বা দুইটি মন্ত্রের ভাষ্যে মতবিরোধের কারণে আমরা তাঁর সম্পূর্ণ ভাষ্যকেই জলে ফেলে দিবো এমন জ্ঞানপাপী তথা স্বঘোষিত বেদজ্ঞ আমরা নই। অবশ্য দুই বছরের স্বঘোষিত বেদজ্ঞ হয়ে যাওয়া বা হিন্দি পাতলা চটিবই টুকে বিশাল বড় বেদজ্ঞ পণ্ডিত সাজা অবৈদিক কদাচারীরা অনেক কিছুই বলবে যা পণ্ডিত সমাজে গুরুত্বহীন তাই সেই স্বঘোষিত সমাজের মন্তব্য আমাদের কাছেও অর্থহীন। বেদাচার্য দুর্গাদাস লাহিড়ী কর্তৃক আচার্য সায়ণের কতিপয় বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যা গ্রহণ না করার পেছনে তিনি পরম্পরাগত নিয়ম অনুযায়ী যথার্থ বিশ্লেষণ করেই দেখিয়েছেন। স্বঘোষিত বেদজ্ঞদের মতন "পছন্দ হচ্ছে না, তাই নিচ্ছি না" এই প্রকারের স্বেচ্ছাচারী পথ তিনি অবলম্বন করেন নি।

❓দুর্গাদাস লাহিড়ীর গোমাংস ভক্ষনপর্ক অনুবাদের বিরুদ্ধে হলে অক্ষয় লাইব্রেরির অনুবাদে গোমাংস ভক্ষনমূলক অনুবাদ কিভাবে এসেছে ?

✅ অক্ষয় লাইব্রেরি হতে প্রকাশিত বেদসংহিতা মূলত দিলিপ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনা। ঐ পুস্তকের প্রথমেই বলা আছে 

"মূল-গেয় গান, বঙ্গানুবাদ, টীপ্পনী ও মর্মার্থ সহ মূল ব্যাখ্যাতা পূজনীয় স্বর্গীয় দুর্গাদাস লাহিড়ী, সায়ণাচার্যকৃত সামবেদভাষ্যানুক্রমনিকা সহ সমগ্র গ্রন্থটির সম্পাদনা ও নবরূপদাতা শ্রী দিলীপ মুখোপাধ্যায়।"   

অর্থাৎ এটি পুরোপুরি দুর্গাদাস লাহিড়ীর অনুসরণে নয়। দুর্গাদাস লাহিড়ীর ব্যাখ্যাকে নিজের মতন করে ব্যাখ্যা করেছেন শ্রী দিলীপ মুখোপাধ্যায় বাবু। 

আপনার যদি অধিক সন্দেহ থাকে তবে archive.org হতে দুর্গাদাস লাহিড়ীর ঋগ্বেদের ১ম খন্ড ডাউনলোড করে তার সাথে অক্ষয় লাইব্রেরির অনুবাদ মিলিয়ে নিন। 

এছাড়াও পণ্ডিত দুর্গাদাস লাহিড়ী সব ঋকমন্ত্রের অনুবাদ করতে পারেননি। তিনি যেসব মন্ত্রের পূর্ন অনুবাদ করতে পারেননি সেইসব মন্ত্রের অনুবাদেই এই প্রকার বিভ্রান্তিমূলক গোমাংস ভক্ষণের স্বপক্ষে অনুবাদ পাওয়া যায়। 

❓ আপনারা বললেন যে এক পক্ষের ব্যাখ্যা দেখিয়ে গোমাংস ভক্ষণের দাবিকে খণ্ডন করা সম্ভব। তাহলে আপনারা এক অনুবাদ দেখিয়ে অন্য অনুবাদ খণ্ডন করলে তা মানেন না কেন? 

✅ এর কারন হলো একটা অনুবাদের ভুল প্রমাণিত না হলে তাকে অমান্য করা যায় না। আগেই বলা হয়েছে বেদমন্ত্রের কোন ব্যাখ্যাই Ultimate নয়। তাই কোন একটি অনুবাদকে নিয়ে, তাকে Ultimate মনে করে ইতিহাসের সাথে মেলানো অযৌক্তিক। এটাও মনে রাখা দরকার গোহনন এবং গোমাংস ভক্ষণ যেখানে সর্বশাস্ত্রেই নিষিদ্ধ সেখানে এর বিশ্লেষণপূর্বক পক্ষ নির্ধারণ সহজেই সম্ভব। কিন্তু অন্যদিকে পরম্পরাহীন এক কদাচারী অবৈদিক সমাজের "এটা মানি ত, ওটা মানি না" টাইপের আব্রাহামিক ভাবনার ব্যাখ্যা হাজার বছরের সনাতনী পরম্পরার উত্তরাধিকারী হয়ে আমরা গ্রহণ করতে পারি না।

©️গৌরব চৌধুরী
সহযোগীতা:- অনিক সাহা

তথ্যসূত্র:
১) জ্ঞানবেদ, দুর্গাদাস লাহিড়ী

প্রচারেঃ SPS – শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
সনাতনী দর্শন ও শাস্ত্র প্রচারে বদ্ধপরিকর।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ