পুরাণাদি শাস্ত্রের ভ্রূণতত্ত্ব সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক।।


 শাস্ত্রীয় ভ্রূণতত্ত্ব নিয়ে ম্লেচ্ছাচারের জবাব। 

সনাতন শাস্ত্র নিয়ে একজন অহিন্দুর অপপ্রচারের জবাবে SPS এর অফিশিয়াল ব্লগ থেকে "সনাতন শাস্ত্রে ভ্রূণতত্ত্ব" (https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2022/09/embryology.html) নিয়ে একটা লেখা প্রচার করা হয় যেখানে সনাতনী সকল শাস্ত্রের পাশাপাশি পুরাণোক্ত ভ্রূণতত্ত্ব নিয়েও লেখা হয়৷ পুরাণাদি শাস্ত্রে মানব ভ্রূণের জন্ম ও বিকাশ নিয়ে এতো চমৎকার ও নিখুঁত বর্ণনা দেওয়া হয় যা অন্যান্য শাস্ত্রে পাওয়া যায় না। ভ্রূণের সর্বশেষ অবস্থায় গর্ভাশয়ে যে ভ্রণের মাথা বাঁকানো থাকে যা আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া দেখা সম্ভব নয় সেটাও পুরাণাদি শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে। যাইহোক এতো চমৎকার বৈজ্ঞানিক বর্ণনা ঢুকে নি হিন্দু নামধারী কিছু অনার্যের মস্তিষ্কে। তারা আমাদের ব্লগের পুরাণোক্ত বৈজ্ঞানিক বর্ণনার বিপরীতে আমাদের উল্লেখিত অংশগুলোর বাইরে গিয়ে আরও কিছু নতুন কিন্তু অবান্তর আপত্তি খুঁজে নিয়ে এসেছে। এরা কিন্তু অন্তত এতটুকু ভাবতে পারতো যে পুরাণ যদি সত্যই অবৈজ্ঞানিক হতো তবে ভ্রূণের বিকাশ নিয়ে এতো সুন্দর ও নিখুঁত ধারাবাহিক বর্ণনা পুরাণে কিভাবে এলো! কিন্তু এরা এদের স্বভাবসিদ্ধ আচারে কেবল খুঁতই ধরবে সেটাই বরং স্বাভাবিক, এর বাইরে এদের থেকে কিছু প্রত্যাশা করাও বোকামি। সমস্যা নেই, তাদের নব উদঘাটিত আপত্তিগুলোরও খণ্ডন দিচ্ছি আমরা এই পর্বে। এই খণ্ডনের পর অন্তত বিজ্ঞান বিষয়ে যেকোনো আপত্তি তোলার আগে এরা যেন বিজ্ঞানটা একটু ভালোভাবে পড়ে নেয় এবং বেদ সংহিতার বিভিন্ন মন্ত্রে বিজ্ঞান দেখানোর আগেও যেন একটু ভেবে নেয় যে কোন শব্দ থেকে কি দেখাচ্ছে! 

এই খণ্ডন প্রবন্ধটি আমরা সাজিয়েছি দুইটি অংশে। প্রথম অংশে থাকবে পূর্বে আলোচিত পুরাণোক্ত ভ্রূণতত্ত্বের আলোচনাটুকু এবং দ্বিতীয় অংশে থাকবে তাদের উত্থাপিত নতুন আপত্তিগুলোর খণ্ডন। উল্লেখ্য যে আমাদের পূর্বে আলোচিত অংশগুলো নিয়ে যদি স্পেসিফিক কোন আপত্তি থাকে তবে সে অনার্যরা যেন তাদের পুরাতন ব্লগ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন না করে নতুনভাবে উপস্থাপন করে। আর চাইলে আমাদের পূর্বের ও এই পর্বের স্পেসিফিক ব্যাখ্যাগুলোর আধারে যেকোনো উন্মুক্ত আলোচনায় লাইভে অংশ নিতে পারে এবং সে আলোচনায় উভয়পক্ষ থেকে অবশ্যই দুইজন রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসক রাখা বাধ্যতামূলক। নাহলে এরা এদের স্বভাবসিদ্ধ অপপ্রচার অব্যাহত রাখবে। 

প্রথম অংশঃ 
পুরাণাদি শাস্ত্রে ভ্রূণের উৎপত্তি ও বিকাশঃ

নবজাতকের আগমনী বার্তায় যখন সকলের মন আনন্দে ভরে উঠে তার পর থেকে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার অপেক্ষায় চলতে থাকে কত প্রতীক্ষা। সে ছেলে না মেয়ে, সে এখন কী করছে, এখন কতটা বেড়ে উঠলো এগুলো নিয়ে পরিবারের বিশেষত পিতামাতার কত না জল্পনা চলতে থাকে। এখন আধুনিক যান্ত্রিক বিজ্ঞানের যুগে আমরা গর্ভস্থ শিশু কোন সময় কোন পর্যায়ে আছে তা জানতে পারি, কিন্তু হাজার বছর পূর্বেও আমাদের সনাতন শাস্ত্র বিশেষত পুরাণে ভ্রূণের উৎপত্তি ও ভ্রূণের ধারাবাহিক বিকাশের স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে যা নিচে তুলে ধরা হলো।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের ১১শ অধ্যায়, শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের ৩য় স্কন্ধের ৩১তম অধ্যায় ও শিব পুরাণের ধর্ম সংহিতায় ৪২তম অধ্যায়ে ভ্রণের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে চমৎকার বর্ণনা রয়েছে যা আধুনিক বিজ্ঞানের নিরীক্ষণের সাথে হুবহু মিলে যায়।
ভ্রূণের উৎপত্তি নিয়ে মার্কণ্ডেয় পুরাণের ১১শ অধ্যায়ের ১ং শ্লোকে বলা হয়েছে,
"মনুষ্য তার স্ত্রীর রজঃতে যে বীজ নিক্ষেপ করে, স্বর্গ বা নরক থেকে বিমুক্তমাত্র জীব তাকে আশ্রয় করে।"
পুরাণের এই তথ্যটি ঐতেরেয় উপনিষদের মন্ত্রের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে।
ভাগবত পুরাণেও একই কথা বলা আছে। ভাগবত পুরাণের ৩য় স্কন্ধের ৩১তম অধ্যায়ের ১নং শ্লোকে রয়েছে,
"ঈশ্বরের অধীনস্থ জীব তার নিজ কর্মের দ্বারা তাড়িত হয়, সে স্থুল দেহ ধারণের জন্য পুরুষের শুক্রাণুকে আশ্রয় করে স্ত্রীর গর্ভের দিকে গমন করে।"
শিব পুরাণে বলা হয়েছে,
"সঙ্গমকালে যখন পুরুষের শুক্রক্ষয় হয় তখন জীবগণ স্ব স্ব কর্মের বশীভূত হয়ে সুক্ষ্ম ইন্দ্রিয় পরিবৃত হয়ে শুক্রকে আশ্রয় করে স্ত্রী অঙ্গে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়।"
অর্থাৎ এই তিন পুরাণের শ্লোক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে ভ্রূণতত্ত্বের প্রাথমিক ধাপটিই এখানে স্পষ্ট হচ্ছে।
অতঃপর শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনে হয় নিষেক হয় যা আধুনিক বিজ্ঞানে ভ্রূনতত্ত্বের দ্বিতীয় ধাপ সেটাও আছে পুরাণে। নিষেককালে সঙ্গমের নিমিত্তে ছুটে আসা পুরুষদের শুক্রের (বীজ) সাথে স্ত্রীদের ক্ষেত্রস্থ রজের (ডিম্বাণু) মিলন হয়।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে বলা হয়েছে,
"জীবাত্মার প্রবেশ ঘটে বলে ঐ বীজদ্বয় স্থিরভাব প্রাপ্ত হয়ে যথাক্রমে বিন্দু, বুদবুদ ও পেশির আকার ধারণ করে"



এখানে ভ্রূণের পরিস্ফুটনের স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। তারপর আসে ভ্রূণের বিকাশের বিষয়টা।
ভ্রূণের পরিস্ফুটন ও বিকাশের বর্ণনায় শিব পুরাণে বলা হয়েছে,
"সেই মিশ্রণ (শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নিষেক) একদিনে আলোড়িত ও স্ফীত হয়ে পঞ্চ দিবসে বুদবুদ আকার ধারণ করে, এরপর একমাসের মধ্যে গ্রীবা, মস্তক, স্কন্দ, উদর, পৃষ্ঠ প্রভৃতি ক্রমশ প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়, দ্বিতীয় মাসে ক্রমে হৃদস্পন্দন শুরু হতে থাকে। পরের মাস থেকে হাত, পা, কটিদেশ সংঘটিত হতে থাকে, এইসময়ই ভ্রূণ মোটামুটি মানুষ আকারে আসে, তিনমাসে শরীর সন্ধি, চারমাসে অঙ্গুলি আর ক্রমে পঞ্চম মাসে মুখ, নাসিকা, কর্ণ, গুহ্য, ছয় মাসে কর্ণছিদ্র, সপ্তম মাসে পায়ু, উপস্থ, নাভি সুদৃঢ় হতে থাকে, অষ্টম মাসে কেশ, সমস্ত অঙ্গ, অবয়ব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর মাতৃনালিকা (Umbilical Chord) দ্বারা ষড় বিধু খাদ্যরস দ্বারা পরিপুষ্ট হয়ে ক্রমশ পরিবর্ধিত হতে থাকে। ভ্রূন পূর্ণ অবস্থা প্রাপ্ত হলে তার পূর্বজন্মের স্মৃতি প্রাপ্ত হয় এবং নিদ্রা ও স্বপ্নের মাধ্যমে পুনঃ পুনঃ জন্ম-মৃত্যু চক্রে ভ্রমণের কথা তার মনে পড়ে, মনে মনে ভাবে এই জন্মে নিশ্চয়ই সংস্কার লাভ করে আমি মুক্ত হবো।"

ভাগবত পুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণেও অনুরূপ ব্যাখাই রয়েছে।
অতঃপর শিশু ভুমিষ্ট হওয়ার ব্যাপারে ভাগবত পুরাণের ৩য় স্কন্দের ৩১তম অধ্যায়ের ৮ ও ২২ং বলা হয়েছে,
"অষ্টম মাস থেকে শিশু গর্ভের বাইরে বেরুনোর জন্য মায়ের তলপেটে মাথাকে ঘোরাতে থাকে, এই সময় ঘাড় বাঁকানো অবস্থায় থাকে।"
পুরাণ শাস্ত্রের বর্ণনায় একাধিক বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

১/ পুরাণাদি শাস্ত্রে বলছে দ্বিতীয় মাসে ভ্রূণে হৃদস্পন্দ শুরু হয়। আধুনিক বিজ্ঞানেও বলা হচ্ছে ষষ্ঠ সপ্তাহে বা দ্বিতীয় মাসের শেষ দিকে ভ্রূণের হৃদস্পন্দন শুরু হয়।

২/ এছাড়া পুরাণে বলা হচ্ছে অষ্টম মাসে শিশু স্বপ্নালু অবস্থায় থাকে, যা বিজ্ঞান দ্বারা স্বীকৃত। বিজ্ঞান বলছে ৩৩তম (৮ম মাসে) সপ্তাহে ভ্রূণ মাতৃগর্ভে স্বপ্নালু অবস্থায় থাকে।

এই বিষয়ে আর‌ও জানতে এই ভিডিওটা দেখতে পারেন।

তখন স্বপালু অবস্থায় শিশুর কি হয় এই ব্যাপারে সনাতন শাস্ত্র সিদ্ধান্ত দিচ্ছে যে, এইসময় তার পূর্ব পূর্ব জন্মের কর্ম সকল মনে পরে, আর নিদারুণ গর্ভযন্ত্রণা ভোগ করে ভাবে এইবার জন্ম নিয়ে মুক্তির জন্য দৃঢ় সংকল্পে কর্ম করবে।

পূর্ব জন্মের কথা মনে করতে পারে না?
স্বপ্ন সবসময় পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা হয়। একটি শিশু ভ্রূণাবস্থায় যার কোনও অভিজ্ঞতাই নেই সে কীভাবে স্বপ্ন দেখে? অর্থাৎ সে পূর্ব জন্মের অভিজ্ঞতা থেকেই স্বপ্ন দেখে। এখানে কিন্তু জন্মান্তরবাদও প্রমাণ হয়ে যায়।
তাহলে জন্মানোর পর সে আর কিছু মনে করতে পারে না কেন?
এর উত্তরে মার্কণ্ডেয় পুরাণ বলছে, "জন্মের পর সে বৈষ্ণবী মায়ার সংস্পর্শে আসে আর পূর্বের সব কিছু ভুলে যায়।"

৩/ তাছাড়া ষষ্ঠ মাসে কর্ণছিদ্রের উল্লেখ রয়েছে পুরাণে। বিজ্ঞানও বলেছে যে শিশু ছষ্ঠ মাস থেকে শুনতে পায়।

তারা দাবী করেছিলো আমরা নাকি ভাগবতের একটা শ্লোক দিয়েই ভ্রূণতত্ত্বের বৈজ্ঞানিকতা দেখিয়েছি কিন্তু উপরের আলোচনা পড়ে আপনারাই বিবেচনা করবেন যে অনার্যরা কতোবড় মিথ্যাচার করেছে! 

দ্বিতীয় অংশঃ
দ্বিতীয় অংশের আপত্তি খণ্ডনে আমরা আলোচনা করবো যেসব বিষয় নিয়ে সেগুলো হলোঃ

১/ শুক্রাণু ও শোণিত নিয়ে আপত্তি
২/ ভ্রূণের বিকাশ বিষয়ক ভাগবতের বর্ণনার সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ নিয়ে আপত্তি
৩/ নিষেকের পূর্বে ও নিষেকে সময় শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর সংখ্যা নিয়ে আপত্তি
৪/ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণোক্ত শ্লোক নিয়ে আপত্তি
৫/ সুরক্ষিত প্লাসেন্টায় ভ্রূণের উপর কৃমি বা কীটাণুর আক্রমণ নিয়ে আপত্তি
৬/ আপ্যায়নী নাড়ীর সংযুক্তি নিয়ে আপত্তি।

এবার তাহলে সরাসরি মূল বিষয়ে চলে যাওয়া যাক।

প্রথম আপত্তিঃ তারা ভাগবতের একটি শ্লোকে আপত্তি তুলেছে যে শুক্রাণু ও শোণিতের মিলনে নিষেক হচ্ছে। শোণিত অর্থ যেহেতু রক্ত তাই এই অর্থ এখানে অবৈজ্ঞানিক কারণ রক্ত নয় বরং ডিম্বাণুর সাথে নিষেক হয়। 

আপত্তির খণ্ডনঃ ”শোণিত” শব্দের  অর্থ রক্ত এতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এর অন্যকোনো অর্থ হতে পারে না বা অন্যকোনো অর্থে এর প্রয়োগ হতে পারবে না এমন কোন লিখিত চুক্তি আছে কি? ”বীর্য” অর্থ পুরুষাঙ্গ হতে নির্গত একধরনের তরল পদার্থ বুঝায় আবার বীর্য অর্থ শৌর্য, যশ বা তেজও হতে পারে। একটি শব্দের যেমন আভিধানিক অর্থে প্রয়োগ হতে পারে তেমন আক্ষরিক বা রূপক অর্থেও প্রয়োগ হতে পারে এমন উদাহরণ অসংখ্য আছে বৈদিক শাস্ত্রে। 

বীর্য অর্থ

”শোণিত” অর্থও ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রয়োগ হতে পারে। 

যাইহোক মূল শ্লোকে কিন্তু শোণিত শব্দটি নেই। ওখানে আছে ”রেতঃ” শব্দটি। রেতঃ অর্থ বীর্য বা শুক্র (শুক্রাণু) যা স্ত্রীদেহে সিঞ্চিত হয়৷ এক্ষেত্রে স্ত্রীজননকোষ বুঝাতেই বাংলা অনুবাদে শোণিত শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। অর্থাৎ শব্দটির প্রয়োগ অবশ্যই রূপক অর্থে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের ৩য় স্কন্ধের ৩১তম অধ্যায়ের ১-৪নং শ্লোকগুলোর ধারাবাহিক বিশ্লেষণ করলে। যারা অপপ্রচার করে তারা মূলত মাঝখান থেকে কাটপিস নিয়ে করে। তারা হয়তো সম্পূর্ণ অধ্যয়ন করে না অথবা ইচ্ছেকৃত সম্পূর্ণ প্রকাশ করে না৷ 

শ্রীমদ্ভাগবত, ৩য় স্কন্ধ, ৩১ অধ্যায়, ১-৪ শ্লোক

দেখুন মূল শ্লোকে কি আছে? এখান থেকে আমরা আরও একটি নিখুঁত বৈজ্ঞানিক তথ্য দিবো আপনাদের যা অনার্যদের চোখে পরে নি। এই তথ্য কেবলমাত্র পুরাণ শাস্ত্রেই পাওয়া যাবে।

অনুবাদঃ 

১/ ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত হয়ে প্রারব্ধ কর্ম বশতঃ জন্তু পুরুষের রেতঃকণাকে আশ্রয় করে স্ত্রীর উদরে (জননাঙ্গে) প্রবেশ করে। 

ব্যাখ্যাঃ এখানে স্পষ্টই বলা হচ্ছে রেতঃ কণা স্ত্রী উদরে প্রবেশ করছে। একই রকম তথ্য আমরা পাই ঋগবেদীয় ঐতরেয় উপনিষদের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম খণ্ডের প্রথম মন্ত্রে (২/১/১)। 

২/ সেখানে এক রাত্রিতে শুক্র ও শোণিতের (ডিম্বাণুর) মিলনে যে অতিসূক্ষ্ম পিণ্ড তৈরি হয় তাকে কলল অবস্থা বলে। পাঁচ রাত্রিতে সেই কলল বুদ্বুদ অবস্থাকে প্রাপ্ত করে। দশ দিন পরে সেই বুদ্বুদ কর্কন্ধু বা পেশ্যণ্ডে রূপান্তরিত হয়। 

ব্যাখ্যাঃ এখানে শোণিত শব্দটি ডিম্বাণু অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে কারণ গীতায় শুক্রাণুকে বীজ বলা হয়েছে
("আমি বীজ প্রদানকারী পিতা", গীতা- ১৪/৪)। এই শ্লোকে একটি চমৎকার বৈজ্ঞানিক তথ্য চলে আসে যা আধুনিক গবেষণা ছাড়া জানা সম্ভব নয়৷ কারণ এখানে যে কলল অবস্থার কথা বলা হচ্ছে তা শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনেই হয় যার বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য এর পরের লাইনেই রয়েছে৷ শ্লোকে বলা হচ্ছে পাঁচ রাত্রিতে এই কলল অবস্থা থেকে বুদবুদ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। এই তথ্য কেবল আধুনিক বিজ্ঞানেই সম্ভব। 

Blastocyst

এখানে বলা হচ্ছে কলল অবস্থা থেকে বুদবুদ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। আধুনিক বিজ্ঞানও বলছে শুক্রাণু স্ত্রী যোনীতে প্রবেশের ৫ দিন পর বুদবুদ অবস্থা বা blastocyst  তৈরি হয়। 

এই শ্লোকে এতো চমৎকার বৈজ্ঞানিক তথ্য থাকার পরও মানুষ কতটা হীনমন্যতায় ভুগলে কেবল সমালোচনার নিমিত্তে একটি রূপক শব্দ নিয়ে পরে থাকে! 

আমরা কথায় কথায় বলি "রক্তের সম্পর্ক"। কিন্তু রক্ত বলতে কি এখানে রক্তকেই নির্দেশ করে নাকি ডিএনএ বা জিনের বিষয়কে ইংগিত করে? এখন ডিএনএকে রক্ত ভাবলে ত হবে না। 

৩/ এক মাসে তার মাথা তৈরি হয়। দুই মাস পরে হস্তপদাদি অঙ্গ বিকশিত হয়। তিন মাস পরে নখ, লোম, অস্থি, চর্ম, জননাঙ্গ, বিবিধ ছিদ্র নির্মিত হয়। 

৪/ চতুর্থ মাসে সপ্ত ধাতু নির্মিত হয়। রস-রক্ত-মাংস-অস্থি-মজ্জা-মেদ-শুক্রশোণিতাদি সপ্ত ধাতু নির্মিত হয়। পাঁচ মাসে তার ক্ষুধা, তৃষ্ণার বিকাশ ঘটে। ছয় মাসে জরায়ুতে ভ্রমণ করে।

দ্বিতীয় আপত্তিঃ ভ্রূণের বিকাশ বিষয়ক ভাগবতের বর্ণনার সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ নিয়ে আপত্তি তুলেছে তারা এবং একটি ওয়েবসাইটের লিংক যুক্ত করেছে। 


তাদের দেওয়া লিংকঃ 

https://www.mayoclinic.org/healthy-lifestyle/pregnancy-week-by-week/in-depth/prenatal-care/art-20045302?pg=2

আপত্তির খণ্ডনঃ আমরা আমাদের ১ম পর্বে ভ্রূণের বিকাশ নিয়ে আলোকপাত করেছিলাম এবং আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যও দেখিয়েছিলাম কিন্তু তারা সেগুলো বিবেচনায় না নিয়ে কেবল বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করতে নতুন কিছু অবান্তর তথ্য এনেছে যা এখনই তাদের দেওয়া লিংক থেকেই দেখিয়ে দিচ্ছি। এক্ষেত্রে আমরা ভাগবতের (৩/৩১/৩-৪) শ্লোক দুইটি বিবেচনায় নিবো৷

তারা একটি লিংক দিয়ে বলতে চাচ্ছে যে ভাগবত পুরাণে মস্তক গঠন ১ মাসে দেখাচ্ছে কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান নাকি বলছে ১ মাস তিন সপ্তাহ (৭ সপ্তাহ)। কিন্তু তারা যে লিংক দিয়েছে সেখানেই দেখাচ্ছে মস্তক গঠন হচ্ছে ৫ সপ্তাহে (৩৫ দিন) তথা ১ মাসে।

আসলে সমস্যা হয়েছে তারা যে লিংক দিয়েছে সেটা তারাই ভালো করে পড়ে নি। তারা প্রথম দুই সপ্তাহের এই হিসেবটা বিবেচনায় নেয় নি।

একইভাবে ভাগবত পুরাণের শ্লোকের ২য় মাস, ৩য় মাস ও চতুর্থ মাসের হিসেবও আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। পরবর্তীতে মাসের হিসেবগুলো আমাদের প্রথম অংশে দেখানো হয়েছে।

মন্তব্যঃ পাঠকরা বিবেচনা করুন ভাগবত পুরাণে এতো নিখুঁত আলোচনা থাকার পরও কিভাবে পুরাণের ভ্রূণতত্ত্ব অবৈজ্ঞানিক হতে পারে!

৩য় আপত্তিঃ অতঃপর তারা ভাগবত পুরাণ থেকে সরে গিয়ে বায়ু পুরাণের রেফারেন্স দিয়ে নিষেকের পূর্বে ও নিষেকে সময় শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর সংখ্যা তথা আনুপাতিক অংশগ্রহণ  নিয়ে আপত্তি তুলে।

আপত্তির খণ্ডনঃ এই বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। এই বিষয়টি আমরা এই পর্বে পরিস্কার করবো না৷ আমরা তাদের থেকে এই বিষয়ে আরও কিছু আপত্তি চাই তাহলে আমাদের জন্য বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে সুবিধা হবে। তবে আমরা এখানে একটা টুইস্ট রাখব। নিষেকের পূর্বে অংশগ্রহণকারী শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর সংখ্যা নিয়ে সামান্য তথ্য নিচে দিয়ে রাখলাম।

চতুর্থ আপত্তিঃ তারা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণোক্ত একটি শ্লোক নিয়ে আপত্তি তুলে, বিশেষত শ্লোকের ”শোণিত” শব্দ নিয়ে।

আপত্তির খণ্ডনঃ শোণিত শব্দ নিয়ে আবারও আলোচনা করা অনাবশ্যকীয় কারণ এই বিষয়টি ইতোমধ্যে উপরে পরিস্কার করা হয়েছে তবে তারা যে কাটপিসটি দিয়েছে সেখানে আমাদের চোখে পড়েছে একটি চমৎকার তথ্য। 

"শোণিত অধিক হইলে মাতৃ আকার এবং শুক্র অধিক হইলে উৎপন্ন জীব পিতার আকার প্রাপ্ত হয়।" 

তারা বেদ মন্ত্রে যেভাবে বিজ্ঞান খুঁজে আনে আমরাও একটু এই শ্লোকে চেষ্টা করে দেখলাম। অথর্ববেদ ১/১২/১-২ মন্ত্রে তারা যে বৈজ্ঞানিক তথ্যটি (সেক্স ক্রোমোজম) দেখিয়েছে আমরাও একই তথ্য এই অংশ থেকে দেখাবো।

এখানে খেয়াল করুন, শোণিত বেশি হলে মাতৃকার অর্থাৎ কন্যাশিশু। শুক্র বেশি হলে পিতার আকার অর্থাৎ পুত্রশিশু। আমরা জানি দুইজোড়া ক্রোমোজম নিষেকে অংশ নেয়। এর মধ্যে XX হলো নারীর এবং XY হলো পুরুষের। এখন এখানে X করছে নারীর প্রতিনিধিত্ব ও Y করছে পুরুষের প্রতিনিধিত্ব। যার প্রতিনিধিত্ব বেশি জন্ম নেওয়া সন্তান সে আকার পাবে। অর্থাৎ XX হলে কন্যাশিশু, XY হলে পুত্রশিশু। 

মন্তব্যঃ আমরা দেখলাম ইচ্ছে করলে এখানে একটি সাধারণ বাক্য দিয়েও বিজ্ঞানের গুহ্যতত্ত্বকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে৷ এখন অনার্যরা চাইলে এখান থেকেও সমালোচনার উপাদান খুঁজে নিতে পারে। 

পঞ্চম আপত্তিঃ তারা সুরক্ষিত প্লাসেন্টায় ভ্রূণের উপর কৃমি বা কীটাণুর আক্রমণ নিয়ে আপত্তি তুলেছে। 

আপত্তির খণ্ডনঃ এটি আসলেই আপত্তিজনক কিন্তু তারা যদি কেবল খুঁত ধরতে ব্যস্ত না হয়ে একটু মন দিয়ে পুরাণচর্চা করতো তাহলে পুরাণেইে এর সমাধান পেয়ে যেত কিন্তু তারা এটা করবে না, তারা বেদমন্ত্র থেকে ঠিকই মহাবিশ্বের সময়কাল খুঁজে বের করবে৷ 

সমস্যা নেই, আমরা খুঁজে দিচ্ছি। তারা যদি ভাগবত পুরাণের ৩য় স্কন্ধের ৩১তম অধ্যায় সম্পূর্ণ অধ্যয়ন করত তবে নিজেরাও এর উত্তর পেয়ে যেত। তাছাড়া এর সমাধান মার্কণ্ডেয় পুরাণেও আছে৷ আমরা জানি যে সকল শিশু মাতৃগর্ভ হতে স্বাভাবিকভাবে ভূমিষ্ঠ হয় না৷ পূর্ব জন্মের কর্মফল হেতু অনেক শিশুই নানারকম জটিলতা নিয়ে জন্ম নেয় এটা ত আমাদের সনাতন শাস্ত্রের জন্মান্তরবাদেরই সিদ্ধান্ত। এই যে ভ্রূণাবস্থায় ভ্রূণের উপর কীটাণু তথা কৃমির আক্রমণ এটাও কিন্তু সকল শিশুর জন্য নয়। যেমনঃ মার্কণ্ডেয় পুরাণের ১১শ অধ্যায়ের ১১নং শ্লোকে বলা হচ্ছে, 

"যে যেমন পাপ-পূন্য করে তদানুসারেই তার গর্ভাবস্তা সংঘটিত হয়।" 

অর্থাৎ গর্ভাবস্থায় ভ্রূণ কি কি যন্ত্রণার সম্মুখীন হবে সেটা তার পূর্ব জন্মের পাপ কর্মের উপর নির্ভর করছে। 

এখন প্রশ্ন আসতে পারে সুরক্ষিত প্লাসেন্টায় কীটাণু তথা কৃমি কিভাবে প্রবেশ করে? এই বিষয়ে আমরা কোন মন্তব্য করবো না কিন্তু এটা যে সম্ভব তার কিছু রেফারেন্স আমরা দিচ্ছি আগ্রহীরা মিলিয়ে নিবেন। 

Acta Tropica (Volume 121, Issue 2, February 2012, Pages 55–70),

Congenital parasitic infections: A review
 Yves Carliera, Carine Truyensa, Philippe Deloronc, François Peyrond,

“This review defines the concepts of maternal–fetal (congenital) and vertical transmissions (mother-to-child) of pathogens and specifies the human parasites susceptible to be congenitally transferred. It highlights the epidemiological features of this transmission mode for the three main congenitalparasiticinfections due to Toxoplasma gondii, Trypanosoma cruzi and Plasmodium sp. Information on the possible maternal–fetal routes of transmission, the placental responses to infection and timing of parasite transmission are synthesized and compared.”

মন্তব্যঃ এখানে ত্রুটি না খুঁজে বরং এটা ভাবা উচিত যে কোনরকম কোন আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া হাজার হাজার বছর পূর্বে এই তথ্য পুরাণে কিভাবে এলো?

ষষ্ঠ আপত্তিঃ তারা আপ্যায়নী নাড়ীর সংযুক্তি নিয়ে একটি অবান্তর আপত্তি তুলেছে। তারা আরও বলতে চেয়েছে যে বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হবার পর এমনিতেই আপ্যায়নী নাড়ী (Umbilical Cord) দেখা যায় তাই পুরাণে এটার উল্লেখ থাকলেও এখানে তেমন বিজ্ঞান নেই। 

আপত্তির খণ্ডনঃ তারা মার্কণ্ডেয় পুরাণের একটা স্ক্রিনশট দিয়ে দাবী করেছে যে পুরাণে আছে আপ্যায়নী নাড়ী অন্ত্রগহ্বরের সাথে যুক্ত যা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক কারণ আপ্যায়নী নাড়ী মূলত যুক্ত থাকে জরায়ুর সাথে। 

আসলে পুরাণ এরা কেনে ও পড়ে কেবল ত্রুটি খুঁজতে কিন্তু এরা যদি প্রকৃতই সত্য সন্ধানী হতো তবে অবশ্যই কোন বিষয়ে প্রশ্ন তোলার আগে ভালো করে বিশ্লেষণ করে নিতো৷ 

যাইহোক কাজটা আমরা করে দিচ্ছি। তাদের দেওয়া স্ক্রিনশট ও মূল শ্লোক থেকে দেখা যাচ্ছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের ১১/১২-১৩ শ্লোকে আছে,

"গর্ভস্থ শিশুর নাভীতে আপ্যায়নী নামে একটি নাড়ী নিবদ্ধ থাকে। স্ত্রীদিগের অন্ত্রগহ্বরের সাথে সংবদ্ধ থাকিয়া এই নাড়ীর উৎপত্তি৷ এই নাড়ী দ্বারা প্রসূতির ভুক্তপীত অন্নরসাদি গর্ভস্থ জীবের উদরস্থ হয়।"

কি চমৎকার বৈজ্ঞানিক তথ্য! কোন রকম আধুনিক গবেষণা ছাড়া এই ধরনের নিখুঁত তথ্য দেওয়া সম্ভব! আমরা এখানে একটি ভিডিও সংযুক্ত করলাম সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি প্রত্যক্ষ করার জন্য। 

তবে অনার্যরা এই চমৎকার বৈজ্ঞানিক তথ্যটি এড়িয়ে গিয়ে ফোকাস করলো একটা শব্দে সেটা হলো "সংবদ্ধ"। এরা বুঝাতে চেয়েছে যে, শ্লোকে বলা হয়েছে আপ্যায়নী নাড়ীর উৎপত্তি অন্ত্রগহ্বর হতে কিন্তু ইহা সত্য নয়।

এবার আপনারাই পড়ে দেখুন ত যে এমন কিছু কি আদৌ বলা হয়েছে শ্লোকে! সংবদ্ধ এখানে Connected নয় বরং Affix অর্থে। যাইহোক বাক্যটি এবার একটু বিশ্লেষণ করি। এখানে বলা হচ্ছে আপ্যায়নী নাড়ী অন্ত্রগহ্বরের সাথে সংবদ্ধ থাকিয়া উৎপন্ন হয়। এখানে এটা বলা হয় নি যে আপ্যায়নী নাড়ী অন্ত্রগহ্বর থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। সংবদ্ধ থাকিয়া উৎপন্ন হওয়া অর্থ সংলগ্ন থাকিয়া বা পাশাপাশি অবস্থান করিয়া উৎপন্ন হওয়া। নিচের চিত্রে দেখুন, অন্ত্র (Intestine) ও প্লাসেন্টার মধ্যে কোন গ্যাপ নেই। 

মন্তব্যঃ এই যে অন্ত্রগহ্বর সংলগ্ন প্লাসেন্টা এর অর্থই কিন্তু সংবদ্ধ থাকা। আর সংবদ্ধ আছে বলেই কিন্তু অন্ত্রগহ্বর থেকে অন্নরসাদি এই পথেই প্লাসেন্টায় আসে যা চমৎকারভাবে পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু অনার্যরা এগুলো চোখে দেখলো না বরং আটকে থাকলে "সংবদ্ধ" শব্দে।

সবশেষে বলতে চাই যে অনার্যদের মিথ্যাচার নিয়ে আমাদের দুঃখ নেই কিন্তু যেসকল সনাতনী তরুণরা বিন্দুমাত্র যাচাই না করে কেবল অনার্যদেরকে অন্ধ বিশ্বাস করে নিজেদের শাস্ত্র নিয়েই সংশয় প্রকাশ করে তাদের লজ্জা হওয়া উচিত।

© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি
🖋️ শ্রী অনিক কুমার সাহা
Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ