বেদের ইতিহাস!


 বেদের ইতিহাস

"বেদ" শব্দটি "বিদ্" ধাতু হতে নিষ্পন্ন। বিদ্ + ঘঙ = বেদ। "বিদ্" ধাতুর অর্থ জানা, অবস্থান করা, লাভ করা ও বিচার করা। তাই বেদ শব্দের ধাতুগত অর্থ হলো জ্ঞান। 

স্বামী অরুণানন্দ লিখেছেন,

"যাহা পাঠ করিলে মানুষ সত্য বিদ্যা জানিতে পারে, প্রকৃত বিদ্বান হইতে পারে, সমস্ত সুখ ও আনন্দলাভ করিতে পারে এবং সত্যাসত্য বিচার করিতে পারে - তাহার নাম বেদ।"

                                 (রেফারেন্সঃ "হিন্দুশাস্ত্র পরিচয়"-স্বামী অরুণানন্দ, পৃঃ ৫) 

বেদই হিন্দুর ধর্ম, বেদই হিন্দুর কর্ম এবং বেদই হিন্দুর হিন্দুত্ব। 

বেদের বয়সকাল কতো? 

এই প্রশ্নটা আদর্শ হিন্দুর কাছে নিতান্তই হাস্যকর ঠেকবে। কারন হিন্দুমাত্রেই বিশ্বাস করে যে বেদ অপৌরুষেয় অর্থাৎ কোনো মনুষ্য কর্তৃক রচিত নয়। স্বয়ং ভগবান যেমন নিত্য, তেমনি তাঁর জ্ঞান এই বেদও নিত্যই। বেদও সনাতনেরই অংশ তাই বেদের কোন জন্মকাল নেই। 

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন,

"বেদ কোনো ব্যক্তিবিশেষের বাক্য নহে। বেদনিবদ্ধ ভাবরাশি ধীরে ধীরে বিকাশপ্রাপ্ত হইয়া পরিশেষে পুস্তকাকারে নিবদ্ধ হইয়াছে এবং তার পর সেই গ্রন্থ প্রামাণিক হইয়া দাঁড়াইয়াছে!"
(রেফারেন্সঃ "ভারতে বিবেকানন্দ" পৃঃ ৪৬৮)

মহাভারতে বলা হয়েছে,

"ঋষয়ো মন্ত্রদ্রষ্টারো ন তু বেদস্য কর্তারঃ।
ন কশ্চিদ্বেদ কর্তা চ বেদস্মর্তা চতুর্ভূজঃ ॥
যুগাস্তেহস্তর্হিতান্ বেদান্  সেতিহাসান্মহর্ষয়ঃ
লেভিরে তপসা পূর্বমনুজ্ঞাতাঃ স্বয়স্তূবা ॥"

(রেফারেন্সঃ মহাভারত - শান্তিপর্ব- ২১০/১৯) 

অনুবাদঃ ঋষিগণ মন্ত্রদ্রষ্টা মাত্র, বেদ রচনাকারী নহেন। বেদের রচয়িতা কেহ নাই। ভগবান চতুর্ভূজ ব্রহ্মা বেদষ্মরণকারী মাত্র। যুগান্তে (অর্থাৎ প্রলয়কালে) ইতিহাসাদি সহ বেদ অন্তর্হিত হইলে মহর্ষিগণ স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মা কর্তৃক পূর্ব্বে উপদিষ্ট সেই বেদজ্ঞান তপস্যা দ্বারা পুনরায় লাভ করেন।

 পরাশর সংহিতায়ও ঋষি পরাশর বলেছেন,

ন কশ্চিৎ বেদকর্তাস্তি বেদম্মর্তা চতুর্মুখঃ'
(রেফারেন্সঃ পরাশর সংহিতা - ১/২০)

অনুবাদঃ বেদের কর্তা কেহই নাই, চতুর্মুখ ব্রহ্মা বেদের স্মরণকর্তা মাত্র।

অর্থাৎ পরমাত্মার ন্যায় বেদও জন্মমৃত্যুরহিত৷ বেদের কোনো সৃষ্টি বা বিনাশ নেই। সৃষ্টির শুরুতে ব্রহ্মা (ঈশ্বরের রজোরূপ) ঋষিগণকে বেদের স্মরণ বা উপদেশ করেন মাত্র।

প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত সাংখ্যদর্শন, যে দর্শন এতোটা যুক্তিবাদী ছিলো যে স্বয়ং ঈশ্বরকেও স্বীকার করেনি (কারন তাঁদের যুক্তিতে ঈশ্বর অস্তিত্বহীন প্রতীয়মান হয়েছিলো), সেই দর্শনও অকাতরে বেদকে অপৌরুষেয় তথা সৃষ্টি-বিনাশ রহিত এবং কোনো ব্যক্তি কর্তৃক রচিত নয় বলে স্বীকার করেছে!

"ন পৌরুষেয়ত্বং তৎবর্ত্তুঃ পুরুষস্যাভাবাৎ"
(রেফারেন্সঃ সাংখ্যপ্রবচণসূত্র - ৫/৪৬)

অনুবাদঃ যদি নিত্য না বল (যারা বেদকে নিত্য বলে মানেনা, তাদের উদ্দেশ্যে বলা), তাহা হইলেও তাহা পৌরুষেয় (কোনো প্রাণী কর্তৃক রচিত) নহে। কারন বেদের কর্ত্তৃ-পুরুষ নাই। বেদ অমুক কর্ত্তৃক রচিত হইয়াছে, এরূপ স্থির-সংবাদ প্রদানে কেহই সমর্থ নয়। 

"মুক্তামুক্তয়োরযোগ্যত্বাৎ"
(রেফারেন্সঃ সাংখ্যপ্রবচণসূত্র - (৫/৪৭)

অনুবাদঃ মুক্তাত্মা ও অমুক্তাত্মা উভয়ের কেহই বেদরচনায় উপযুক্ত নহেন। বীতরাগিতা বিধায় মুক্তাত্মা ও অসর্ব্বজ্ঞতা বিধায় অমুক্তাত্মাও বেদ করণের অযোগ্য।

অর্থাৎ স্বয়ং কোনো প্রাণী তো দূরে থাক, স্বয়ং মুক্তাত্মা মহাজ্ঞানী বা পরমেশ্বরও বেদের রচনা করেননি। 

এ বিষয়টি আরও সুন্দরভাবে এবং চমৎকার যুক্তি দ্বারা ড. যোগীরাজ বসু প্রতিপন্ন করেছেন।।

"পরমেশ্বর বেদের আধার কিন্তু রচয়িতা নহেন। নিত্যসিদ্ধ যে বেদ তাহা তিনি প্রতিকল্পে স্মরণ করেন। তাঁহাকে বেদের রচনাকর্তা বলিলে দুটি দোষ হয়। প্রথমত: বেদ অনিত্য হইয়া পড়ে। দ্বিতীয়তঃ পরমেশ্বরের সর্বজ্ঞত্বের হানি ঘটে। কি করিয়া তাঁহার সর্বজ্ঞতার হানি ঘটে তাহা আলোচনা করিয়া দেখা যাউক। আমরা যখন কোনও কাব্য রচনা করি বা কোনও শ্লোক যখন মনে প্রথম সৃষ্টি হয়, সেই সময়ের পূর্বে সেই কাব্য বা সেই শ্লোক আমাদের অজ্ঞাত ছিল, কিন্তু পরমেশ্বর সর্বজ্ঞ ও ত্রিকাল দর্শী সুতরাং কোনও কালে তাঁহার নিকট কোনও বিষয় অজ্ঞাত থাকিতে পারে না। তিনি কোন এক বিশেষ কালে বেদ রচনা করিয়াছিলেন বলিলে সেই কালের পূর্বে বেদ তাঁহার অজ্ঞাত ছিল এই আপত্তি আসিয়া পড়ে। তিনি সর্বজ্ঞ বলিয়া কোনও কালে বেদ তাঁহার অজ্ঞাত থাকিতে পারে না; অতএব বেদ নিত্য এবং বেদ তাঁহার রচিত নহে। বেদ নিত্য একরূপ ; কল্পভেদে তাহার রূপভেদ হয় না। প্রতিকল্পে পূর্ব পূর্ব কল্পের ঠিক অনুরূপ বেদ পরমেশ্বর স্মরণ করেন।

যাহা পুরুষের রচিত, রচনার পূর্বে তাহার অস্তিত্ব থাকে না। প্রথম রচনায় ও প্রথম উচ্চারণে সেই কাব্য বা শ্লোক সম্পূর্ণ নূতন; তাহার সজাতীয় বা অবিকলরূপ তৎপূর্বে থাকে না, থাকিতে পারে না;- ইহা পৌরুষেয় রচনার ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য। প্রতিকল্পে বেদের স্মরণ বলা হইয়াছে, প্রথম উচ্চারণ বলা হয় নাই কারণ তাহা পূর্বকল্পের বেদের সজাতীয় উচ্চারণ। এইরূপ অনাদি অনন্ত বেদের প্রবাহ চলিতেছে ; তজ্জন্ন বেদ পৌরুষেয় হইতে পারে না, তাহা অপৌরুষেয়। পৌরুষেয় রচনার আদি আছে, আরম্ভ আছে,— অপৌরুষেয় বেদের আদি নাই, অতএব অন্তও নাই, তাহা অনাদি অনন্ত  ও নিত্যবর্তমান। ঈশ্বরের সহিত বেদের সম্বন্ধও অনাদি অনন্ত।"

(রেফারেন্সঃ "বেদের পরিচয়" - ড. যোগীরাজ বসু, পৃঃ ১৬৪)

এক্ষেত্রে পাঠক একটু গভীরভাবে বিচার করুন যে কেন বারবার আমি বেদকে অপৌরুষেয় প্রমান করছি। কারন আমি একটু আগেই বলেছি যে "বেদের রচনাকাল কত?" এটা হিন্দুদের নিকট এক হাস্যকর অপপ্রশ্ন। কারন কোনো কিছুর রচয়িতা থাকলেই কেবল তার রচনাকাল নির্নয় করা সম্ভব। কিন্তু যে বেদ অপৌরুষেয় অর্থাৎ যে বেদের রচয়িতায় নেই, সেই বেদের রচনাকালও থাকতে পারেনা।

বেদের যে রচয়িতা নেই, এরপক্ষে এক অখন্ডনীয় এবং সর্বমান্য যুক্তি দেখিয়েছেন বিশ্বনন্দিত দার্শনিক স্বামী বিবেকানন্দ৷ তিনি বলেছেন,

"আপ্তবাক্য বেদ হইতে হিন্দুগণ তাঁহাদের ধর্মলাভ করিয়াছেন। তাঁহারা বেদসমূহকে অনাদি ও অনন্ত বলিয়া বিশ্বাস করেন । একখানি পুস্তককে অনাদি ও অনন্ত বলিলে এই শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে তাহা হাস্যকর বলিয়া মনে হইতে পারে বটে, কিন্তু 'বেদ' শব্দদ্বারা কোন পুস্তকবিশেষ বুঝায় না । ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে যে আধ্যাত্মিক সত্যসমূহ আবিষ্কার করিয়া গিয়াছেন, বেদ সেই সকলের সঞ্চিত ভাঙারস্বরূপ। আবিষ্কৃত হইবার পূর্বেও মাধ্যাকর্ষণের নিয়মাবলী যেমন সর্বত্রই বিদ্যমান ছিল এবং সমুদয় মনুষ্য সমাজ ভুলিয়া গেলেও যেমন ঐগুলি বিদ্যমান থাকিবে, আধ্যাত্মিক জগতের নিয়মাবলীও সেইরূপ। আত্মার সহিত আত্মার যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ, প্রত্যেক জীবাত্মার সহিত সকলের পিতাস্বরূপ পরমাত্মার যে দিব্য সম্বন্ধ, আবিষ্কৃত হইবার পূর্বেও এগুলি ছিল এবং সকলে বিস্মৃত হইয়া গেলেও থাকিবে।

এই আধ্যাত্মিক সত্যগুলির আবিষ্কারকগণের নাম ‘ঋষি’ । আমরা তাঁহাদিগকে পূর্ণ বা মুক্ত বলিয়া ভক্তি করি ও মান্য করি ।"

(রেফারেন্সঃ "চিকাগো বক্তৃতা" - পৃঃ ১১, প্রকাশকঃ স্বামী অমেয়ানন্দ)

এই যুক্তির সারকথা হলো, বেদ শব্দের অর্থই হলো জ্ঞান আর জ্ঞানের কোনো সৃষ্টি বা ধ্বংস থাকতে পারেনা। যেমন মহাকর্ষ জ্ঞান। বিজ্ঞানী নিউটন এই মহাকর্ষ জ্ঞানের আবিষ্কর্তা (যদিও তাঁরও বহু পূর্ব হতেই ভারতীয়দের এই জ্ঞান ছিলো কিন্তু আলোচনার খাতিরে বাকি সবার মতো তাঁকেই মহাকর্ষ জ্ঞানের আবিষ্কর্তা মানছি)। কিন্তু নিউটনের পূর্বে কি এই মহাকর্ষ ছিলো না? আর পৃথিবীর সবাই এই মহাকর্ষ জ্ঞানকে বিস্মরণ করলেও কি এই মহাকর্ষ জ্ঞানের ধ্বংস হবে? নিশ্চয়ই না।।

অর্থাৎ জ্ঞানকে কখনো সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায়না, জ্ঞান হলো নিত্য এবং জ্ঞানী ঐ জ্ঞানকে অব্যক্ত হতে ব্যক্ত করেন মাত্র!

একইভাবে যেহেতু বেদ হলো ঐশ্বরিক জ্ঞানের সমষ্টি, তাই এর কোনো সৃষ্টি বা ধ্বংস থাকতে পারেনা। ঋষিগণ এই বেদ নামক অব্যক্ত জ্ঞানকে জগতের সামনে ব্যক্ত করেছেন মাত্র এবং পৃথিবীর সকল বেদের পাণ্ডুলিপি ধ্বংস করে ফেলা তথা সকলে বেদ ভুলে গেলেও বেদের ধ্বংস সম্ভব নয়।

এইতো গেলো দার্শনিক কথাবার্তা! কিন্তু প্রগতিশীলেরা এইসমস্ত কথায় সন্তুষ্ট হতে পারেন না। তাঁরা প্রশ্ন তুলবেন,

"আপনি যে বলছেন বেদ অপৌরুষেয় এবং তাই এর রচনাকাল নির্নয় সম্ভব নয় তথা অন্ততকাল যাবত বেদ প্রবাহিত হয়ে আসছে৷ কিন্তু এগুলো তো সবই আপনাদের ব্যক্তিগত মতামত। আপনি নিজস্ব বিশ্বাসের কারনে বেদকে অপৌরুষেয় মানতে পারেন কিন্তু আমরা তা মানবো কেন? যদিও এই যুক্তি সঠিক যে জ্ঞানের সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই। কিন্তু বেদকে আমরা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সমষ্টি বলেই বা মানবো কেন? যেহেতু বেদের অপৌরুষেয়ত্বের পক্ষে বস্তুবাদী প্রত্যক্ষ প্রমান আপনি দিতে পারবেন না তাই আমাদের মতে বেদ মনুষ্যরচিত দার্শনিক গ্রন্থ মাত্র এবং তাই এর রচনাকালও থাকবে।"

ঠিকাছে, এই যদি আপনাদের মন্তব্য হয়, তবে আমি আপাতভাবে বেদকে পৌরুষেয় বিবেচনা করে এর রচনাকাল সম্পর্কে ঐতিহাসিক প্রমানাদি উপস্থাপন করছি।

বেদ যে পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ, তা বিশ্বনন্দিত পণ্ডিতবর্গই মেনে নিয়েছেন।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন,,

"উহার (হিন্দুদের) শাস্ত্র 'বেদ' জগতের সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ"
(রেফারেন্সঃ "ভারতে বিবেকানন্দ" - পৃঃ ৪৯৩)

এখন সমালোচকগণ বলতে পারেন যে বিবেকানন্দের কথা মান্য নয়, কারন বিবেকানন্দ ইতিহাসে দক্ষ হলেও ইতিহাসবিদ বলতে যা বোঝায়, তা নন। এবং তিনি হিন্দু বলেই এমনটা বলছেন। বেশ! তাহলে একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী ইতিহাসবিদের গ্রন্থ হতে উদ্ধৃতি দেখাই,,,

"ঋগ্বেদকে বিশ্বের আদিগ্রন্থ বলা হয়ে থাকে।"
(রেফারেন্সঃ "ভারতের প্রাচীন সভ্যতার ইতিবৃত্ত" - অমলেশ মিশ্র, পৃঃ ১৯)

"ঋগ্বেদ শুধুমাত্র ভারতের নয়, সমগ্র জগতের আদি বা প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ।"
(রেফারেন্সঃ ঐ, পৃঃ ২১)

(বিঃদ্রঃ অমলেশ মিশ্র পিএইচডি ডিগ্রিধারী কোনো ইতিহাসবিদ নন। কিন্তু তাও তাঁর গ্রন্থের উদ্ধৃতিকে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ইতিহাসবিদের উদ্ধৃতি বলছি কারন বইটির ভূমিকা অংশে তিনি লিখেছেন,,

"মুখবন্ধে বলে নিতে চাই যে, ড. প্রফুল্ল কুমার ঘোষ (১৮৯১-১৯৮৩) দমদম জেলে বসে ১৯৩৩ সালে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস শিরোনামে একটি বই লিখতে শুরু করেন। বছরখানিক পরে তিনি কারামুক্ত হন এবং নানারকম রাজনৈতিক কাজেকর্মে বই লেখা বন্ধ হয়ে যায়। আবার ১৯৪০ সালে তিনি কারারুদ্ধ হন এবং আমেদ নগর ফোর্টে বন্দী থাকেন। বইটি আবার লেখা শুরু করেন এবং ১৯৪৩ সালে শেষ করেন। আমি আমার এই পুস্তিকার শিরোনাম, তাঁর পুস্তকের শিরোনাম থেকে পৃথক করলেও মূলত তাঁর লিখিত পুস্তকের বিষয় বস্তুই আমার এই পুস্তিকার মূল বিষয়বস্তু। তাঁর লেখা পুস্তকটি প্রায় ২৬০ পৃষ্ঠার। বিস্তৃত বিবরণ আছে। আমি ইচ্ছা করেই ছোট করে লিখলাম যাতে মূল কথাগুলি বলা যায় এবং আমাদের নব প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ও শিক্ষক শিক্ষিকারা কম মূল্যে কম সময় ব্যয় করে ভারতের গৌরব বিষয়ে সামান্য সংবাদ সংগ্রহ করেন।"

অর্থাৎ তাঁর বইটা মূলত ড. প্রফুল্লকুমার ঘোষজীর রচিত বইয়ের সারসংক্ষেপ। প্রফুল্লবাবুর বইটি এই মুহূর্তে দূর্লভ বিধায় আমি অমলেশ বাবুর বইয়ের সাহায্য নিয়েছি)

জানি, প্রফুল্লবাবুর রেফারেন্স দিয়ে সমালোচকদের "প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস গবেষকদের উদ্ধৃতি চাই" দাবিটি মানা হলে "হিন্দু বিধায় এমনটা বলেছেন" দাবিটি মানা হয়নি। এই সাহেবী বাবুদের আবার আরেকটা রোগ আছে৷ ভারতীয় বিদ্বানরা যদি বলে যে "সূর্য পূর্বে উদয় হয়" তাহলে তাতে বিশ্বাস না করে কোনো পশ্চিমা বিদ্বান যদি বলেন যে "সূর্য পশ্চিমে উদয় হয়" এইবাক্যে বিশ্বাস করবে! কারন ইংরেজদের গোলামো করার স্বভাব বাবুদের এখনো যায়নি।।

অসুবিধা নেই। আমি এখানে অহিন্দু পশ্চিমা পণ্ডিতগণেরও বক্তব্য তুলে ধরছি।।

আলফ্রেড ম্যাক্সমূলর, যিনি তৎকালীন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রাচ্য বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন এবং বিশ্বখ্যাত ইতিহাস গবেষক, তিনিই লিখেছেন,,

"One thing is certain: there is nothing more ancient and primitive, not only in India, but in the whole Aryan world, than the hymns of the Rig-Veda."

অনুবাদঃ একটি বিষয় সুনিশ্চিত। ঋগ্বেদ শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সমগ্র সভ্য বিশ্বের প্রথম গ্রন্থ।

(রেফারেন্সঃ "Lectures on the origin and growth of religion", page- 153)

আমেরিকান ভাষাতাত্ত্বিক Leonard Bloomfield বলেছেন,,

"বেদ কেবল ‘ইন্দো-ইউরোপীয়' জনগণের সব থেকে প্রাচীন শিক্ষা-বিষয়ক স্মৃতিস্তম্ভ নয়, এটি 'ইন্দো-ইউরোপীয়' জনগণের সব চেয়ে প্রাচীন শিক্ষা-বিষয়ক প্রমাণপত্রও বটে।"

(রেফারেন্সঃ "The religion of the Veda" page-17)

 Russian-American author Zénaïde Alexeïevna Ragozin লিখেছেন,,

"ঋগ্বেদ হল আর্য জাতি-গোষ্ঠীর পরিবারের প্রাচীনতমগ্রন্থ।"
(রেফারেন্সঃ "Vedic India" (1895) page-114)

 Charles University in Prague, Univerzita Karlova v Praze এর প্রফেসর Maurice Winternitz লিখেছেন,,

"আমরা যদি আমাদের নিজ সংস্কৃতির আদি সম্বন্ধে বুঝতে শিখতে চাই, আমরা যদি প্রাচীনতম ইন্দো-ইউরোপীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে বুঝতে চাই, আমাদের অবশ্যই ভারতবর্ষে যেতে হবে—যেখানে একটি ইন্দো-ইয়োরোপীয় গোষ্ঠীর প্রাচীনতম সাহিত্য রক্ষিত আছে। কারণ, ভারতীয় সাহিত্যের প্রাচীনত্ব নিয়ে সমস্যা সম্বন্ধে আমাদের যে দৃষ্টিভঙ্গিই হোক, আমরা নিরাপদে বলতে পারি যে, ভারতীয়গণের সাহিত্যের প্রাচীনতম স্মৃতিস্তম্ভ আর আমাদের ইন্দো-ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রাচীনতম স্মৃতিস্তম্ভ একই বস্তু।"

(রেফারেন্সঃ "A History of Indian Literature”, Eng. transl. (1927), Vol. 1, page-6)

সাহেবী বাবুদের নিকট বেদ যে পৃথিবীর প্রথম গ্রন্থ এরপক্ষে পণ্ডিতবর্গের বক্তব্য উপস্থাপনের পর এবার আসছি বক্তব্যগুলো সত্যতা প্রমান তথা বেদের বয়সকাল নির্নয়ে।।

ড. যোগীরাজ বসু তাঁর "বেদের পরিচয়" গ্রন্থে বেদের বয়স সম্পর্কিত প্রাচ্য ও প্রতীচ্য বিদ্বানগণের গবেষণা এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণসমূহ তুলে ধরেছেন। চলুন তা দেখে নেওয়া যাক।

"পণ্ডিতগণ বেদরচনার কাল সম্বন্ধে একমত নহেন; এক একজন এক এক মত পোষণ করেন। কেহ সুপ্রাচীনকাল, কেহ অদূরবর্তীকাল নির্ণয় করিয়াছেন; একদল আবার মধ্যবর্তী পথ ধরিয়াছেন। ভারতবর্ষে স্বনামধন্য বালগঙ্গাধর তিলক, নারায়ণরাও পাভ্গী, বেটকার, বৈদ্য (C. V. Vaidya), অবিনাশচন্দ্র দাস প্রভৃতি, এবং পাশ্চাত্যে মহামতি ম্যাক্সমূলর, মনীষী যাকোবি (Jacobi ), বেবর (Weber) হুইটনি, ম্যাক্‌ডোনেল, ভিন্টারনিৎস, গ্রাসমান, বূলার, ওলডেনবারগ্  প্রভৃতি বিদ্বন্মগুলী বেদের রচনাকাল নির্ণয় করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। কেহ কেহ খ্রীষ্টপূর্ব ৬০০০ (ছয় হাজার) বৎসর পর্যন্ত ঊর্ধ্বে— গিয়াছেন, কেহ কেহ আবার খ্রীষ্টপূর্ব ১০০০ (এক হাজার ) অবধি নিম্নতম সীমারেখা টানিয়াছেন।

খ্রীষ্টধর্মের বাইবেল, ইসলামধর্মের কুরান; বা ইহুদীধর্মের 'তালমুদ' ( Talmud ) বলিতে একখানি মাত্র ধর্মগ্রন্থ বুঝায় এবং তাহার কাল নির্ণয় করা সহজ ও সম্ভব; কিন্তু সনাতন ধর্মের 'বেদ' বলিতে একটি মাত্র গ্রন্থ নহে, একটি গ্রন্থাগার বুঝায় বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। বেদ বলিতে সংহিতা চতুষ্টয়, প্রতিবেদের ব্রাহ্মণ গ্রন্থরাজি, আরণ্যকসমূহ ও উপনিষদরাশি প্রতিবোধ্য সুতরাং বেদের একটি বিশিষ্ট কাল ( One particular point of time) হইতে পারে না। মন্ত্র, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদের উৎপত্তির ভিন্ন ভিন্ন কাল হইবে। এইজন্যই সমগ্র বেদের কাল নির্ণয় করা অতি দুঃসাধ্য ব্যাপার, এবং এইজন্যই ম্যাক্সমূলর বলিয়াছেন, 'Whether the Vedic hymns were composed in 1000, or 1500, or 2000, or 3000 B. C. no power on earth will ever determine' (Griffith lectures on physical Religion 1889 ), অর্থাৎ 'বেদমন্ত্ররাজি খ্রীষ্টপূর্ব ১০০০ অথবা ১৫০০ অথবা ২০০০ বা ৩০০০ বৎসর কোন সময়ে রচিত হইয়াছিল তাহা পার্থিব কোনও শক্তিই কখনও নির্ণয় করিতে পারিবে না।' 

এই একই কারণে প্রখ্যাত জার্মাণ দেশীয় পণ্ডিত ভিন্টারনিৎস্ বলিয়াছেন, — It is foolish to ascer tain a definite date for both the Samhita period and the Brahmana period of the Veda (History of Indian Literature, Vol I. ). 'বেদের সংহিতাও ও ব্রাহ্মণখণ্ডের জন্য একই কাল নির্ণয় করিলে তাহা মূর্খামির পরিচায়ক হইবে।' 

বেদের কাল কেহ জ্যোতিষতত্ত্ব ধরিয়া, কেহ ভাষাতত্ত্ব ধরিয়া, কেহ উদ্ভিদত্তত্ত্ব ও প্রাণিতত্ত্ব, কেহ ভূতত্ত্ব, কেহ বা আবার অভ্যন্তর প্রমাণ ধরিয়া নির্ণয় করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। বালগঙ্গাধর তিলক, কেট্কার, বূলার ( Buhler) প্রভৃতি জ্যোতিষের উপর প্রধানতঃ নির্ভর করিয়াছেন। তিলক তাঁহার 'Arctic Home' ও 'Orion' নামে বিদ্রুত গ্রন্থ দুইটিতে বেদে জ্যোতিষের যে সকল তথ্য পাওয়া যায়, কৃত্তিকা, মৃগশিরা প্রভৃতি নক্ষত্রের স্থান বিচার করিয়া স্থির সিদ্ধান্তে আসিয়াছেন যে বেদের প্রাচীন সংহিতার কাল ৬০০০ খ্রীঃ পূঃ হইতে 2000 খ্রীঃ পূঃ পর্যন্ত ; এবং পরবর্তী সংহিতা ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থাদির কাল 5000 খ্রীঃ পূঃ হইতে ২০০০ খ্রীঃ পূঃ পর্যন্ত। পণ্ডিত কামেশ্বর আয়ারের মতে ২৩০০ খ্রী: পৃঃ হইতে ২০০০ খ্রীঃ পূঃ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ গ্রন্থরাজির রচনাকাল।

তিলক এবং যাকেবি (Jacobi) উভয় মনীষী পরস্পর আলোচনা না করিয়া স্বতন্ত্রভাবে সংহিতার ও ব্রাহ্মণের জ্যোতিষসংক্রান্ত তথ্যের গবেষণা করিয়াছেন এবং আশ্চর্যরূপে দুইজনেই এক সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন। তাঁহারা বলেন সংহিতার কালে বসন্তকালীন বিষুবসংক্রান্তির ( Vernal Equinox ) মৃগশিরা ( Orion ) নক্ষত্রে হইয়াছিল এবং গণনা করিলে তাহার কাল ৪৫০০ খ্রীষ্টপূর্ব পাওয়া যায়; অতএব সংহিতার রচনা আরও পূর্বে হইয়াছিল। আবার ব্রাহ্মণগ্রন্থের আভ্যন্তরীণ প্রমাণে পাওয়া যায়-বসন্ত কালীন বিষুবসংক্রান্তি কৃত্তিবানক্ষত্রে (Pleaids ) ; জ্যোতির্গননামতে ইহার কাল ২৫০০ খ্রীঃ পূঃ এই ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ্ রচনার কাল তিলক ২৫০০ খ্রঃ পৃঃ হইতে ১৪০০ খ্রীঃ পূঃ ধরিয়াছেন। ডাঃ রাধাকৃষ্ণন বলেন প্রাচীন উপনিষৎসমূহ ১৪০০ খ্রীঃ পূঃ মধ্যেই রচিত হইয়াছিল। ব্রাহ্মণ গ্রন্থের জ্যোতিষতথ্য বলিতে তিলক ও যাকোবি (Jacobi ) প্রধানত শতপথ  ব্রাহ্মণের নিম্নোদ্ধৃত বচনটি ধরিয়াছেন,

‘এতা হ বৈ প্ৰাচ্যৈ দিশোন চ্যবন্তে' (২-১-১-৩) ;–'এতা' অর্থাৎ কৃত্তিকা নক্ষত্র কখনও পূর্বদিক হইতে স্খলিত হয় না; অর্থাৎ বসন্তকালীন বিষুব সংক্রান্তি কৃত্তিকানক্ষত্রে সংঘটিত হইয়াছিল।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী কেট্কার ( V. B. Ketkar) তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের একটি বচনকে সূত্ররূপে ধরিয়া (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩-১-৫) গবেষণা করিয়াছেন। তথায় বলা আছে—'তিষ্য' (পুনর্বসু) নক্ষত্রকে প্রায় আচ্ছাদন করার সময় (গ্রহণের সময়) বৃহস্পতিগ্রহ আবিস্কৃত হইয়াছিল। কেট্কার গণনা করিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন ৪৬০০ খ্রীষ্টপূর্বে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল। অতএব সংহিতার রচনা ইহার পূর্ববর্তী। প্রসঙ্গক্রমে জানাইতেছি এই মহারাষ্ট্রীপণ্ডিত কেট্কারের জার্মাণদেশীয়া পত্নী শ্রীযুক্তা কেট্‌কারই সর্বপ্রথম ভিন্টারনিৎসের (Winternitz) জার্মান্ ভাষায় বিরচিত ‘ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস' গ্রন্থের প্রথম খণ্ড ইংরাজীতে অনুবাদ করেন; কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছে। স্বনামধন্য বেদজ্ঞ মার্কিনদেশীয় পণ্ডিত ব্লুমুফিল্‌ড, ৪৫০০ খ্রীঃ পূঃ বৈদিক যুগের প্রারম্ভকাল বলিয়া ধরিয়াছেন।

ঋগ্‌বেদের কয়েকটি মন্ত্রে বর্ষাকালে বৎসর আরম্ভের কথা বলা আছে, বিশেষ করিয়া মণ্ডূকসূক্তে এই তত্ত্ব সুপ্রমাণিত। ভাষাতত্ত্ববিদ্ কেহ কেহ বলেন বর্ষাকালে বৎসর আরম্ভ হইত বলিয়া বৎসরের একটি নাম ‘বর্ষ’ হইয়াছে। কয়েকজন জ্যোতির্বিজ্ঞানবিদ গণনা করিয়া বলিয়াছেন ৩০০০ খ্রীঃ পূর্বের আগে এই ঘটনা অর্থাৎ বর্ষাকালে বৎসর আরম্ভ সম্ভব ; অতএব ঋগ্‌বেদের রচনাকাল তাহার পূর্ববর্তী।

ডাঃ বূলার, তিলক ও যাকোবির সিদ্ধান্ত পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন এবং সমর্থন করিয়াছেন। ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দে 'Indian Antiquary ( ২৮ পৃষ্ঠা ) পুস্তিকায় একটি প্রবন্ধে তিনি ( বূলার) বলিয়াছেন, অধ্যাপক যাকোবি ও তিলকের সিদ্ধান্ত আমি অবিশ্বাস্য বলিয়া মনে করি না। মৃগশিরা নক্ষত্রের যে প্রমাণ তাঁহারা দিয়াছেন আমিও তাহা অতিশয় মূল্যবান বলিয়া মনে করি।'

অধ্যাপক বৈদ্য (C. V. Vaidya ) সম্পূর্ণ বৈদিক যুগ ৪৫০০ খ্রীঃ পূঃ হইতে ৮০০ খ্রীঃ পূঃ পর্যন্ত ধরিয়াছেন। জাপানের কাকাসু ওকাকুরা ( Kakasu Okakura) তাঁহার 'The Ideals of the East 6000 খ্রীঃ পূঃ বৈদিকযুগের সূচনা এবং ৭০০ খ্রীঃ পূঃ বৈদিক যুগের সমাপ্তিকাল ধরিয়াছেন। তাঁহার মতে উপনিষদরাজি ২০০০ খ্রীঃ পূঃ হইতে ৭০০ খ্রীঃ পূঃ কালের মধ্যে রচিত।

ঋগবেদে যে সকল নদীর নাম আছে তন্মধ্যে সরস্বতী নদীর নাম বহুবার পাওয়া যায়। সরস্বতীকে নদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ, দেবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও জননীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ('অন্বিতমে নদীতমে দেবিতমে সরস্বতি ) বলা হইয়াছে। একটি মন্ত্রে (ঋক্‌সংহিতা ৭-৯৫-২) সরস্বতীর পর্বত হইতে উৎপত্তি ও সমুদ্রে পড়ার কথা স্পষ্ট বলা আছে,

"একা চেতৎ সরস্বতী নদীনাং শুচির্ষতী গিরিভ্য আসমুদ্রাৎ' - নদীসমূহের মধ্যে একমাত্র সরস্বতী ইহা জানেন, সরস্বতী অর্থাৎ যে পুণ্যতোয়া নদী গিরি হইতে সমুদ্র পর্যন্ত বহিয়া গিয়াছে। সরস্বতী নদী হিমালয় হইতে উৎপন্ন হইয়াছে কিন্তু সমুদ্র বহুদূরে সরিয়া যাওয়ায় অধুনা সরস্বতী রাজস্থানের বিকানীর অঞ্চলের মরুভূমিতে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে ; ভূতত্ত্ববিদ কেই কেচ বলেন পঞ্জাবের পাতিয়াল রাজ্যের নিকট উহা লুপ্ত হইয়াছে। কোন সুপ্রাচীন যুগে সরস্বতী সমুদ্র পর্যন্ত প্রবাহিত ছিল তাহার গবেষণা বিশেষভাবে কেউকার করিয়াছেন। তিনি পুরাতত্ত্বের বিবিধ দিক হইতে আলোচনা করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে ৭৫০০ খ্রীঃ পূঃ সময়ে সরস্বতী নদী মরুভূমিতে বিলুপ্ত হইয়াছে; তৎপূর্বে সমুদ্র পর্যন্ত প্রবহমানা ছিল এবং সমুদ্র রাজস্থানের অভ্যন্তর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কেট্কারের এই গবেষণামতে ঋগ্‌বেদের ঐ মন্ত্রের রচনার কাল ৭৫০০ খ্রীঃ পূর্বের পূর্ববর্তী। প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ প্রাচ্যবিদ্যানিষ্ণাত প্রাচীনভারতের ইতিহাসের প্রমাণস্বরূপ পণ্ডিতদের অন্যতম অবিনাশ চন্দ্র দাস মহাশয়ও তাঁহার মৌলিকগবেষণাপ্রসূত পাণ্ডিত্যপূর্ণ 'Rigvedic India' নামক গ্রন্থে এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করিয়াছেন, ( দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৮)।

১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে এশিয়া মাইনর অন্তর্গত বোঘাৎসকোই (Boghazkoi ) নগরে হুগো ভিনক্লার্ (Hugo Winckler) কতকগুলি মৃত্তিকানিৰ্মিত ফলক আবিষ্কার করেন। প্রাচীন হিটীরাজ্যের রাজার সহিত মিতানী দেশের রাজার সন্ধিপত্র এই মৃন্ময়ফলকে লিপিবদ্ধ আছে। এই সন্ধিপত্র খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত। সন্ধির রক্ষকরূপে উভয় দেশের দেবতাগণকে আহ্বান করা হইয়াছে; বাবিলন দেশীয় এবং হিটীদেশীয় বহু দেবতার নাম তো আছেই, অধিকন্তু মিতানীদেশের দেবগণের মধ্যে বৈদিক দেবতা মিত্র, বরুণ, ইন্দ্র ও নাসত্যৌ! দেবতাগণের নামও লিখিত আছে। এশিয়া মাইনরে মিতানীদেশে কিরূপে এই বৈদিকদেবতাগণের নাম ও পূজা পৌঁছিয়াছিল এ সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন গবেষকদের ভিন্ন ভিন্ন মত। ঐতিহাসিক মেয়ার (Meyer) মনে করেন আর্য ও ইরানীয়গণ যখন একত্রে বসবাস করিত তখন এই সকল বৈদিক দেবতা উভয়ধর্মে বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে ইরান হইতে পশ্চিম ভূখণ্ডে ইহার প্রভাব বিস্তৃত হয়। ওল্‌ডেনবার্গ মনে করেন বৈদিক আর্যগণের এই সকল দেবতা ও উত্তর পশ্চিম অঞ্চলনিবাসী জনগণের সমসংজ্ঞক এই সকল দেবতারা একটি প্রাচীন সাধারণ উৎস হইতে আসিয়াছে; কিন্তু সেই সাধারণ উৎসটি কোন স্থানে ছিল বা কোন্ যুগের সে সম্বন্ধে ওল্ ডেনবার্গ কিছু বলেন নাই। যাকোবি (Jacobi ), স্টাইন কোনো (Stein Konow), হিলেব্রানভ্ট্, ভিন্টারনিৎস প্রভৃতি প্রাচ্য তত্ত্ববিৎ পণ্ডিতগণ বিশেষ বিচার বিবেচনা করিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে মিত্র এবং বরুণ, ইন্দ্র এবং নাসভ্যৌ( অগ্নিযুগল ) এই দেবতাদের এভাবে বর্গীকরণ করিয়া উল্লেখ করায় ইহারা ভারতীয় বৈদিক দেবতা। ওল্‌ডেনবার্গের প্রাচীন সাধারণ উৎসনিষ্ঠ মতবাদ তাঁহারা খণ্ডন করিয়াছেন। ভিন্টারনিৎস দ্বিধাহীন স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেন, – I agree with Jacobi, Konow and Hillebrandt in considering these gods to be Indian, Vedic deities and that there is no possible justification for any other view.' 'যাকোবি, কোনো ও হিলেব্রানভ্ট্ সঙ্গে আমি একমত যে এই সকল দেবতা ভারতীয় এবং বৈদিক। এছাড়া অন্য মতের কোনও সম্ভাব্য যুক্তি নেই।' যাকোবি প্রভৃতির মতে খ্রীষ্ট পূর্ব দুই সহস্র কালে কতিপয় বৈদিক দেবতার প্রভাব ও পূজা পশ্চিম এশিয়ায় ব্যাপ্ত হইয়াছিল।

(রেফারেন্সঃ "বেদের পরিচয়"- ড. যোগীরাজ বসু, পৃঃ ১৬৯-১৭৩)

অর্থাৎ গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে বেদের রচনাকাল হোক না কেন, তা কমপক্ষে ৭৫০০ খ্রীস্টপূর্বের আগে হবে।। অতএব, পাঠক বুঝতেই পারছেন যে এই বেদকে সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ বলা হয়েছে! 

পরিশেষে বলতে চাই হে হিন্দু, ইতিহাসমুখী হও, কোথায় তোমার গর্ব, তা জানো এবং সকলকে জানাও।

অগ্নিপুত্র

প্রচারেঃ
SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ