🔳 মাতা সীতার বনবাস নিয়ে শ্রীরামচন্দ্রের উপর মিথ্যা অপবাদ খন্ডন।।


রামায়ণের উত্তরকান্ডকে ঢালাওভাবে প্রক্ষিপ্ত বলে দিয়ে ইতিহাসের যৌক্তিক সত্য থেকে পালায়ন করা কোন যুক্তিপূর্ণ বিষয় নয়। আমরা এখানে মাতা সীতার বনবাস নিয়ে শ্রীরামচন্দ্রের উপর মিথ্যা অপবাদ যুক্তি দিয়েই খন্ডন করার চেষ্টা করব এবং সেটা ইতিহাসেরও সত্য।।

মাতা সীতার অগ্নি-পরীক্ষা শেষে দেবী সীতাকে সাথে নিয়ে শ্রীরামচন্দ্র অযােধ্যায় ফিরে এলেন। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর পর রামকে ফিরে পেয়ে তাঁর তিন মাতা, দুই ভাই, রাজপুরবাসী এবং রাজ্যের সকল প্রজাদের মধ্যে আর আনন্দের সীমা রইলো না। চারিদিকে মহা ধুমধাম, অযোধ্যায় যেন মহােৎসব চলছে। ফিরে এসে শ্রীরামচন্দ্র অযােধ্যায় রাজপদে অভিষিক্ত হলেন। কিছুদিন রামরাজ্যে থেকে সুগ্রীব, বিভীষণ প্রমুখ সকলেই নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন। রাম-সীতা-লক্ষ্মণসহ সকলেই মহাসুখে কালযাপন করছেন।

একদিনের ঘটনা—মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র বিজয়, মধুমত্ত, কাশ্যপ, মঙ্গল, কুল, সুরাজি, কালিয়, ভদ্র, দন্তবক্তৃ ও সুমাগধ তাঁর এই দশ বন্ধুর সঙ্গে নানারকম বিষয়ে আলােচনা করছেন। তাঁরা পরিহাস করে রাঘবের নিকট নানা রকমের কথাও বলছেন। তারপর কোন এক কথার প্রসঙ্গ ধরে শ্রীরামচন্দ্র ভদ্রকে জিজ্ঞাস করলেন-

"এখন এই নগরের নগরবাসীরা কোন কোন বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব সহ আলােচনা করছেন? বিশেষ করে প্রজারা আমার বিষয়ে কিছু আলােচনা করছে কী-না বা ভরত, লক্ষ্মণ, সীতা এবং বিমাতা কৈকেয়ীকে নিয়েও কোনও আলােচনা করছে কী-না?”

[এখানে একটা বিষয় লক্ষনীয় যে একজন মহারাজ তাঁর রাজ্যের প্রজাদের ভাবনাকেও কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং সেটা তিনি তাঁর প্রিয় বন্ধুর মাধ্যমে অবগত হতে চাইছেন।]

শ্রীরামের জিজ্ঞাসার উত্তরে ভদ্র বললেন, -

"পুরবাসীরা আপনার শুভ কথাই আলােচনা করে। রাবণ বধ করার পর আপনার যেসব বিরাট কীর্তি তা নিয়ে তারা নিজেদের বাড়ীতে আলােচনা করে।”


তখন রামচন্দ্র বিশেষভাবে জানতে আগ্রহী হন - "তারা শুভ এবং অশুভ যে সব কথা আলােচনা করে তা বিস্তৃতভাবে আমাকে বল। আমি তা শুনে অশুভ কিছু না করে শুভই করব। পুরবাসীরা নগরে যে-সব পাপ কথা বলে, কোনরকম দ্বিধা না করে, ভয় না পেয়ে, বিশ্বাস করে আমায় বল।"

[এখানে লক্ষনীয় যে রাজা তাঁর প্রজাদের কাছ থেকে নিজের সমালোচনাও মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত। অর্থাৎ রাজা সর্বতপক্ষে রাজ্য ও প্রজাদের জন্য হিতকর কার্যই করতে চান।]

তাঁর অভয় পেয়ে ভদ্র বলেন,

"আপনি সমুদ্রে সেতু তৈরী করেছেন, রাবণকে বধ করেছেন, বানর, ভল্লুক ও রাক্ষসদের নিজের বশে এনেছেন, এসবের জন্য তারা আপনার খুবই প্রশংসা করে। এবং আপনার শক্তিতে তারা বিস্মিত!"

[এখানে স্পষ্ট যে শ্রীরামচন্দ্র তাঁর মধ্যেকার অনন্য গুণের দ্বারা বানরদের উদ্ভুদ্ধ করে বিশাল সাগরের বুকে পাথরের সেতু বানিয়ে ত্রিলোকে অপ্রতিরোধ্য পরাক্রমশালী রাবণকে হত্যা করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি মানব হয়েও সকল মানবের চেয়ে ছিলেন ভিন্ন ও অনন্য এবং অযোধ্যাবাসীও তাদের রাজাকে নিয়ে ছিলেন গর্বিত।]

অতঃপর ভদ্র বললেন,

"কিন্তু তারা এমনও বলে যে রাবণ সীতাকে স্পর্শ করেছিল, তাকে কোলে করে নিজ পুরী লঙ্কায় নিয়ে গিয়েছিল, যে সীতা রাক্ষসগণের বশীভূতা হয়ে লঙ্কার অশােকবনে বহুদিন থেকেছেন, সেই সীতাকে তিনি আবার অযােধ্যায় নিজ ঘরে নিয়ে এলেন। সেই তাঁকেই নিয়ে ঘর করছেন। এইজন্য রামের সীতার প্রতি একটুকুওঁ ঘৃণা হল না!”

ভদ্র আরও বলেন প্রজারা বলছে,

"অস্মাকমপি দারেষু সহনীয়ং ভবিষ্যতি।
যথা হি কুরুতে রাজা প্রজান্তমনুবর্ততে।।"
[উত্তরকাণ্ড-৪৩/১৯]

অর্থঃ রাজা যা করেন, প্রজারা তারই অনুসরণ করে। অতএব আমাদের স্ত্রীদের এ-রকম দোষ হলেও তা আমাদের সহ্য করতে হবে।

[এখানে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে প্রজাসাধারণ মাতা সীতাকে মন থেকে গ্রহণ করে নি এবং নিজেদের নারীদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রয়োগের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। তারা রাজার এহেন কার্যকে ব্যাভিচার হিসেবে নিন্দা করতেন এবং রাজার উপর অসন্তোষ ছিলেন।]

রাজা রামচন্দ্র ওই সংবাদে ভীষণ মর্মাহত হলেন। তারপর অন্যান্য নয়জন বন্ধুকেই জিজ্ঞাসা করলেন-“ভদ্র যা যা বলছে—তা কী সত্য?"

সকলেই একবাক্যে সম্মতি দিলেন—“হা”

[লক্ষনীয় যে শ্রীরামচন্দ্র এক মহা ধর্মসঙ্কটে পড়লেন। আমরা সকলে জানি তিনি তাঁর পত্নী সীতাকে কতটা ভালোবাসতেন! স্ত্রীকে উদ্ধার করার জন্য অজানা জঙ্গল পথে সহস্র মাইল হেটে গিয়েছেন এবং পরাক্রমশালী রাবণের বিশাল সেনাবাহিনীর সাথে সামান্য বানর সেনা নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। অন্যদিকে একজন রাজার কাছে নিজ পরিবারের চেয়েও প্রজার মূল্যায়ন অধিক। প্রজাদের অসন্তোষ নিয়ে কোন রাজ্যেরই অগ্রগতি সম্ভব নয়।]

শ্রীরামচন্দ্রের বন্ধুরা চলে গেলে রামচন্দ্র ডাকলেন তাঁর তিন ভাইকে। তাদের কাছে ওই দুঃসংবাদের বিষয়ে সব কথা বললেন। তারপর অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি বললেন-

"আমার জন্ম বিখ্যাত সূর্যবংশে, আর সীতা জন্মেছেন মহাত্মা জনকের বংশে অর্থাৎ উভয় বংশই জনসাধারণের জন্য আদর্শ স্থাপন করবে। জনক তনয়া সীতাকে রাবণ চুরি করে যিনি একাধারে সূর্য বংশীয় গৃহবধু এবং সীতাকে দীর্ঘদিন রাবণ বন্দী করে রেখেছিলেন। আমি সেই রাবণকে বধ করেছি এবং সীতাকে অযোধ্যায় নিয়ে আসার সময়ই আমার মনে সন্দেহ জেগেছিল যে, এই সীতাকে আমি অযােধ্যায় কী ভাবে নিয়ে যাব! সেজন্য তাঁর পাতিব্রত্য-ধর্মের পরীক্ষা চেয়েছিলাম। তিনি তােমার (লক্ষ্মণকে দেখিয়ে) সামনেই অগ্নি-পরীক্ষা দিয়ে নিজেকে নিষ্পাপ প্রমাণিত করেছেন। তাছাড়া বায়ু, চন্দ্র, সূর্য দেবতা, ঋষিগণ সকলেই সীতাকে বলেছেন পবিত্ৰ-চরিত্রা এবং সুরপতি মহেন্দ্র ও গন্ধর্বদের সাক্ষাতে আমার হাতে বিশুদ্ধচরিত্রা সীতাকে তুলে দেন এবং আমি নিজেও জানি যশস্বিনী সীতা সম্পূর্ণ শুদ্ধচরিত্রা। সেই জন্য আমি তাকে অযােধ্যায় নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখানে নগরবাসী ও প্রজাগণ যেভাবে আমার নিন্দা করছেন, তাতে আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে। এই সংসারে যদি কোন প্রাণী কারও অপকীর্তির নিন্দা করে এবং সেই নিন্দা যতদিন চলতে থাকে ততদিন সেই অকীর্তিমান পুরুষ অধম লােকে পতিত হয়ে থাকে। স্বয়ং দেবতারাও অকীর্তির নিন্দা এবং কীর্তির প্রশংসা করেন।"

শ্রীরামচন্দ্র আরও বলেন -

"আমি লােকনিন্দার পরিত্রাণে নিজের জীবন, এমন-কি তােমাদেরও ত্যাগ করতে পারি সেক্ষেত্রে সীতাকেও ত্যাগ করতে পারি। সেজন্য আমি এখন দুঃখের সাগরে পড়েছি। তাই লক্ষ্মণ তুমি আগামী কালই সীতাদেবীকে তমসা নদীর তীরে মহাত্মা বাল্মীকির স্বর্গতুল্য পবিত্র আশ্রমের নির্জন স্থানে রেখে আসো। আর সীতা আমাকে আগেও বলেছিলেন, তিনি গঙ্গাতীরস্থ মুনিদের আশ্রম দর্শন করতে চান। সুতরাং তুমি তার ইচ্ছাপূরণ কর।”

[এখানে স্পষ্ট যে, শ্রীরামচন্দ্র নিজে মাতা সীতাকে অপবিত্র মনে করেন নি এবং সকল দেবতা ও ঋষিদিগকে স্বাক্ষী রেখে সীতাদেবীকে অযোধ্যায় নিয়ে এসেছিলেন। তবে রাজা হয়ে তিনি নিজ রাজ্যের প্রজাদের নিন্দাও সহ্য করতে পারছিলেন না কারণ নিন্দা অব্যাহত থাকলে রাজার প্রতি প্রজাদের মান্যতা হারিয়ে যেত এবং সীতাদেবী নিজেও ক্ষণে ক্ষণে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেন। শ্রীরামচন্দ্র এই ধর্মসঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য সীতাদেবীকে মহর্ষি বাল্মিকীর পবিত্র তপোবনে সুরক্ষিত রেখে আসার আদেশ দিয়েছিলেন এবং সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন প্রিয় ভ্রাতা লক্ষ্মণকে। তিনি যদি সত্যই সীতাদেবীকে ত্যাগ করতেন তবে সাধারণ সৈন্য দিয়ে নির্জন জঙ্গলে অরক্ষিত রেখে আসতেন। অন্যদিকে মহর্ষি বাল্মিকী মুনির আশ্রম মাতা সীতার খুব পছন্দের জায়গাও বটে]

এই মর্মান্তিক আদেশ করার পরই রামচন্দ্রের দু'চোখ অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে গেল। নিরুপায় লক্ষ্মণ মাতা সীতাকে বাল্মীকি মুনির আশ্রমের প্রান্তভাগে রেখে এলেন।

সীতাকে ত্যাগ করতে গিয়ে লক্ষ্মণ অত্যন্ত শােককাতর হয়ে পড়েন। সীতাকে তিনি সেকথা বলতেই পারছিলেন না। অনেক কষ্ট করেই ওই মর্মান্তিক কথাটি তিনি সীতাদেবীকে বলেছিলেন। স্বভাবতঃ শােকাহত সীতা সে সময় অনেক কথাই বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন-

"তুমি রাজাকে বলবে;- রঘুনন্দন! সীতা শুদ্ধচরিত্রা, আপনার প্রতি পরম ভক্তিমতী এবং সর্বদা আপনার কিরূপ হিতাকাঙ্খিনী তা আপনি বিশেষভাবেই জানেন।"

মাতা সীতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লক্ষ্মণ ফিরলেন অযােধ্যায়। ওদিকে বাল্মীকি মুনি বালকদের কাছে সংবাদ পেয়ে সীতাদেবীকে নিজের আশ্রমে নিয়ে এসে থাকার সু-ব্যবস্থা করলেন।

-এই হল মাতা সীতার বনবাসের তথা বাল্মিকী মুনির পবিত্র তপোবনে রেখে আসার কাহিনি।

মাতা সীতার বনবাস প্রসঙ্গে কতকগুলি প্রশ্ন যুক্তিবাদীরা করে থাকেন।

প্রশ্ন করা হয় রাম যখন সীতাদেবীকে নিয়ে অযােধ্যায় এলেন, তখনই সীতা-চরিত্রের সমালােচনা না হয়ে পরে কেন হল!

ঘটনাটা অবশ্যই বাস্তবেও তাই-ই। কেন না, রামচন্দ্র অযােধ্যায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে পেয়ে সকল প্রজাসাধারণ উৎসবে, আনন্দে মেতে ছিল। তখন তাঁর কীর্তি ও গুণই ছিল সকলের মূল আলােচ্য বিষয়। তারপর সেই আনন্দ ও উত্তেজনা এক সময় কমে যায়। তখন প্রজাদের মধ্যে শুরু হয় কাঁনাঘোষা এবং রাজার ভূল-ত্রুটি অন্বেষণ।  

প্রশ্ন আসতে পারে, শ্রীরাম ত দেবী সীতাকে অগ্নি-পরীক্ষা করে বিশুদ্ধতা প্রমাণ করেই অযোধ্যায় নিয়ে এসেছিলেন তাহলে আবার কেন কেবলমাত্র লােকমুখে নিন্দা ও অপবাদ শুনে দেবী সীতাকে বনবাসে পাঠাতে হলো?
শ্রীরামচন্দ্র কি মাতা সীতার প্রতি অন্যায় অবিচার করলেন না এবং নিজেও কাপুরুষতার পরিচয় দিলেন না?

পরিস্থিতি ও অবস্থান তথা স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা না করে কেবল স্বতন্ত্র কোন ব্যক্তির অবস্থান থেকে এই ধর্মসঙ্কটের সমাধান বিশ্লেষণ করলে আদৌ সঠিক বিশ্লেষণ সম্ভব নয় বরং প্রেক্ষাপট অনুধাবন ব্যতিরেকে বিচার করাই অর্বাচীনের কাজ।

বর্তমান যুগে লােকেরা নিন্দা ও অপবাদকে তেমন কোন গুরুত্ব না দিয়ে আত্মরক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি ও কুযুক্তি দাড় করানোর চেষ্টা করে এমনকি রাষ্ট্রনায়কও নিজ রাষ্ট্রের জনসাধারণের সমালোচনাকে তোয়াক্কা না করে নিজেকেই সর্বময় ক্ষমতাবান মনে করে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন মর্যাদা পুরুষোত্তম এবং একজন রাজা হিসেবে তাঁর কাছে রাজধর্ম ও প্রজাদের সন্তোষ্টিই মুখ্য।

শ্রীরামচন্দ্রের মত আদর্শ রাজার পক্ষে তাই প্রজাদের নিন্দাচর্চা ও নিজ পত্নীর প্রতি এহেন অপবাদ এড়িয়ে যাওয়া কোনমতেই সম্ভব ছিল না। শ্রীরামচন্দ্র যদিও যুক্তিতর্ক দ্বারা প্রজাদেরকে সাময়িকভাবে বোঝাতে পারতেন কিন্তু তিনি কি প্রজাদের মন হতে সকল সংশয় ও সন্দেহ সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারতেন?

এই বিষয়ে বলতে হয় যে শ্রীরামচন্দ্র মাতা সীতার অগ্নি-পরীক্ষা নিয়েছিলেন রাবণের লঙ্কায় সেখানে স্বাক্ষী ছিলেন কেবল শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ এবং অযােধ্যার আর কেউ সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। এই ঘটনা লােকে কেবল শুনেছিল, কিন্তু তারা কি করে বিশ্বাস করবে যে একজন মানুষ আগুনে পুড়বে না! যেমন বর্তমান যুগের তথাকথিত যুক্তিবাদীরাও এই অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তারা স্থুল বিচারে।

[অগ্নিপরীক্ষা ও মানবদেহের আগুনে দগ্ধ না হওয়া নিয়ে বিস্তারিত পোস্ট করা হবে।]

সুতরাং অগ্নিপরীক্ষার ঘটনাকে সেকালেও অনেকে অবিশ্বাস্য ও লােক ভােলানাের উদ্দেশ্যে প্রচারিত গল্প হিসেবেই ধরে নিয়েছিল।

শ্রীরামের নামে যে কিছু লােক অকারণ নিন্দা করছিল, তারা যদি সব শুনে, সব বুঝে, বিচার করে মাতা সীতাকে শুদ্ধচরিতা বলে মেনেও নিত ; কিন্তু রাজ্যের যে কোটি কোটি প্রজা তাদের সকলের মনের সন্দেহ দূর করার উপায় তাে ছিল না। এখন সীতার অগ্নি-পরীক্ষার প্রত্যক্ষদর্শী যদি বানরদল ও রাক্ষসদের ডেকে এনে সাক্ষ্য নেওয়া হত তাহলে লােকে কি সেটাও বিশ্বাস করত!

শ্রীরামচন্দ্রের তাহলে সীতার বিশুদ্ধতা প্রমাণের জন্য আবার সেই অগ্নি-পরীক্ষার মত কোন পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়ােজন হতো। এটা কি মাতা সীতার জন্য স্বস্তিকর হতো? হাজার হাজার প্রজার সামনে মাতা সীতাকে এনে অগ্নিপরীক্ষা নেওয়া যেমন মাতা সীতার পক্ষে চরম অবমাননাকর, তেমনি শ্রীরামচন্দ্রের জন্যও অত্যন্ত গ্লানিকর ও হৃদয়হীনতার পরিচয় হতো। তাছাড়া মাতা সীতা তখন ছিলেন গর্ভবতী। অযােধ্যার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী তাঁর গর্ভে। সুতরাং সেই গর্ভস্থ সম্ভানদের ক্ষতির কথাও একজন পিতাকে চিন্তা করতে হয়েছিল। সব দিক থেকে বিচার করলে শ্রীরামচন্দ্রের কর্তব্য নির্ধারণে বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি।

একজন রাজার কাছে মর্যাদা হল সব থেকে মূল্যবান সম্পদ। শ্রীরামচন্দ্র তাই মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখবেন এটাই স্বাভাবিক এবং এজন্যই তিনি মর্যাদা পুরুষোত্তম ছিলেন। তাঁর গৌরবময় বংশের মর্যাদা এবং নিজের মর্যাদা তিনি যে-কোন মূল্যে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। তাই তিনি ভাইদের বলেছিলেন—

“আমি লােকনিন্দার ভয়ে নিজের জীবন, এমন-কি তােমাদেরও ত্যাগ করতে পারি। সীতার তাে কথাই নেই।”


তবে মাতা সীতাকে বনবাসে পাঠানোর জন্য রামচন্দ্রকে হৃদয়হীনও বলা যায় না। কারণ-রামচন্দ্র ছিলেন সবরকম আদর্শের ঘনীভূত মূর্তি। তিনি যেমন আদর্শ পুত্র, আদর্শ ভাই, আদর্শ বন্ধু, আদর্শ প্রভু, আদর্শ স্বামী, তেমনি আদর্শ রাজা। স্বামীর দায়িত্ব স্ত্রীর প্রতি, পুত্রের দায়িত্ব পিতার প্রতি, ভাইয়ের দায়িত্ব ভাইদের প্রতি ; কিন্তু রাজার দায়িত্ব কোটি কোটি প্রজার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধন। যে দায়িত্বের কাছে অন্য সব দায়িত্বই হয়ে যায় ছােট। আর রামের যে ধর্ম, যে কর্তব্য, যে দায়িত্ব- সেটা মাতা সীতারও। পত্নীকে বলা হয় পতির সহধর্মিণী। রাম যেমন প্রজাদের পিতা, রাণী সীতাও তেমনি প্রজাদের মাতা। -সেকথা সীতাও জানতেন। তাই তাঁকে বনবাসে পাঠালেও তিনি রামকে কোন দোষারােপ না করে নিজের অদৃষ্টের দোষ দিয়ে বলেছেন- "এ আমার নিজের ভাগ্যের দোষ।"

তাঁর স্বামী রাজধর্ম পালন করছেন জেনে তিনি গৌরববােধ করে স্বামীর বন্দনাও করেছিলেন।

অন্যদিকে আমরা মাতা সীতার বনবাসে সীতার দুঃখের কথা, কষ্টের কথা জানি ও প্রচার করি। কিন্তু মাতা সীতাকে বনবাসে পাঠিয়ে শ্রীরামচন্দ্র নিজেও যে কি দুঃখ পেয়েছিলেন সেটা আমরা কখনও ভেবে দেখেছি? লক্ষ্মণকে যখন রামচন্দ্র মাতা সীতাকে বাল্মিকীর তপোবনে রেখে আসার আদেশ করেন, তখনই তার চোখ দুটি জলপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং সেই জলের ধারা বয়েছিল বেশ কয়েকদিন ধরেই। সে খবর লক্ষ্মণ কিছুটা জানতেন। তিনি সীতাকে বনবাসে দিয়ে যখন রামের ঘরে এলেন তখন দেখলেন, রামচন্দ্র অতি দীন-হীনভাবে চোখ ভরা জল নিয়ে উত্তম আসনে বসে রয়েছেন।

শ্রীরামচন্দ্রকে শোকার্ত অবস্থায় দেখে সে সময় লক্ষ্মণ তাঁকে বলেছিলেন,

"নেদৃশেষু বিমুহান্তি ত্বদ্বিধাঃ পুরুষ্ভাঃ।
অপবাদঃ স কিল তে পুনরেষ্যতি রাঘব।”
(উত্তরকাণ্ড-৫২/১৪)

অনুবাদঃ হে রঘুনন্দন আপনার ন্যায় মহাপুরুষেরা এইরূপ বিপত্তিকালেও বিমােহিত হন না। আপনি যদি এখন সদা দুঃখিত মনে থাকেন, তাহলে ওই অপবাদ পুনরায় আপনার উপর আসবে।

"যদর্থং মৈথিলী ত্যক্তা অপবাদভয়ান্নপ।
সােইপবাদঃ পুরে রাজন্ ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ।।"
(উত্তরকাণ্ড-৫২/১৫)

অনুবাদঃ রাজন! আপনি যে অপবাদ ভয়ে ভীত হয়ে মৈথিলীকে ত্যাগ করেছেন, যদি পুনরায় তার জন্য শােক করেন তাহলে, আপনার সেই অপবাদ নিঃসন্দেহে পুনরায় প্রকারান্তরে নগরে প্রচারিত হবে। অর্থাৎ, রামচন্দ্র যে স্ত্রৈণ ও দোষযুক্তা সীতাকে ত্যাগ করেও তার বিরহে কাতর তাই প্রমাণিত হবে।

[এখানে স্পষ্ট যে মাতা সীতাকে বাল্মিকী মুনির তপোবনে নিরাপদে রেখে এসেও শ্রীরামচন্দ্র পত্নী শোকে কাতর হয়েই ছিলেন। অন্যদিকে শ্রীরামচন্দ্র এই অবস্থায় দেখে লক্ষ্মণ শ্রীরামচন্দ্রকে বোঝাতে চাইলেন যে তিনি যদি সর্বদা পত্নী শোকে কাতর থাকেন তবে কিন্তু প্রজাদের নিন্দাচর্চা আরও বৃদ্ধি পাবে।]

সেসময় রামচন্দ্র বলেছিলেন,

"চত্বারাে দিবসাঃ সৌম্য কার্যং পৌরজনস্য চ।
অকুর্বাণস্য সৌমিত্রে তন্মে মর্মাণি কৃন্ততি।"
(উত্তরকাণ্ড-৫৩/৪)

অনুবাদঃ হে সৌম্য সুমিত্রানন্দন! চারদিন হল পৌরজনের কোন কাজ করা হয়নি। সেইজন্য আমার মর্মস্থল বিদীর্ণ হচ্ছে।”

শ্রীরামচন্দ্র দেবী সীতার বিরহে রাজকার্যেও মনোনিবেশ করতে পারছিলেন না এবং এই কারণে তিনি আরও দুঃখী হয়ে পড়েছিলেন। শ্রীরামচন্দ্র কিন্তু রাজ্য পরিচালনার কারণ হেতু পুনরায় বিবাহ করতে পারতেন কারণ রানী ব্যতীত রাজ্য অচল এবং রাজ্যের পরবর্তী বংশধরও অনিশ্চিত।। শ্রীরামচন্দ্র তাঁর পত্নী দেবী সীতাকে এতটাই ভালোবাসতেন যে দ্বিতীয় বিবাহের কথা চিন্তাও করেন নি বরং যখনই কোন শুভকাজে যেমন অশ্বমেধ যজ্ঞ করার প্রয়ােজন হয়েছিল তখন স্বর্ণ দিয়ে দেবী সীতার প্রতিমা তৈরি করে তিনি সেই শুভকাজ সম্পন্ন করেছিলেন।

[এখানে স্পষ্ট হয় যে শ্রীরামচন্দ্র প্রজাদের ইচ্ছাকে মেনেছেন ঠিকই, কিন্তু প্রজাদের অপবাদকে মেনে নেননি। তিনি বরং স্বর্ণ-সীতা তৈরি করে দেবী সীতাই যে তাঁর পত্নী ও সীতাই যে অযোধ্যার একমাত্র মহারানী রাজ্যবাসীদের তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। এটি সীতার অপবাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ নয় কী? রাম রাজারূপে রাজ্যপালন করেছেন ঠিকই, কিন্তু অন্তরে সীতা বিচ্ছেদের দুঃখ ছিল তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী এবং সীতাকে ত্যাগ করে তিনি নিয়েছিলেন কঠোর বৈরাগ্যের জীবন।]

দেবী সীতার প্রতি শ্রীরামচন্দ্রের ভালোবাসা কতটা গভীর ছিল সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলাও অন্যায়। দেবী সীতা হরণের পর থেকে শ্রীরামচন্দ্র এক মুহুর্তের জন্য স্থির ছিলেন না বরং বিরামহীন ছুটেছেন দুর্গম জঙ্গল পথে।

তিনি একবার মাতা সীতাকে বলেছিলেন-

"দেবি! তােমাকে ত্যাগ করে আমি স্বর্গও চাইনে"

[এখানে স্পষ্ট যে শ্রীরামচন্দ্র রাজধর্ম পালন করতে গিয়ে মাতা সীতাকে ত্যাগ করে প্রতিমুহূর্তে অন্তরে যে জ্বালা অনুভব করেছেন সেটা হৃদয়বান মানুষ ছাড়া কদাচারীদের বুঝার সাধ্য কোথায়? দুঃখিনী সীতা মাতার জন্য সমবেদনা যেমন উচিত, শ্রীরাচন্দ্রের অন্তরের তীব্র যন্ত্রণাও উপেক্ষার নয়।]

এখন যুক্তিবাদীরা প্রশ্ন তুলে যে দেবী সীতা-অবলা, গর্ভবতী নারী ছিলেন। সুতরাং রামের তাঁকে বনে পাঠানাে কোনভাবেই উচিত হয়নি, রামচন্দ্র কয়েকজন প্রজার কথায় কান না দিয়ে সীতাকে নিজের কাছেই রাখতে পারতেন। না হয় সীতার সঙ্গে তিনিও বনবাসী হতে পারতেন। এছাড়াও সীতাকে রামচন্দ্র জনকের ঘরেও পাঠিয়ে দিতে পারতেন।

এ বিষয়ে "রামায়ণী কথায়" শ্রদ্ধেয় অমলেশ ভট্টাচার্য বলছেন—

“প্রথমতঃ রাম যদি সীতাকে ত্যাগ না করতেন তা হলে, সকল প্রজার মৌন ঘৃণা ও ধিক্কারের উপরে দুর্নাম মাথায় নিয়ে রাম বসে থাকতেন, নিন্দিত রাণীকে নিয়ে কুখ্যাত রাজা। জনরব আরাে মুখর হয়ে সীতার কলঙ্ককে আরাে গ্লানিকর করে তুলত। তাতে না থাকত সীতার মর্যাদা, না রামের।

দ্বিতীয়তঃ সীতাকে নিয়ে রাম যদি রাজসিংহাসন ত্যাগ করেআবার বনবাসী হতেন, তাহলে বর্তমান কালের পাঠক আমরা আদর্শ প্রেমিক হিসাবে রামকে নিশ্চয়ই অনেক বাহবা দিতাম। কিন্তু তখনকার দিনের সমাজ ও জনতা রামের দিকে আঙুল তুলে বলত,-“ওই যে চলেছে রাজধর্ম-ত্যাগী বনবাসী স্ত্রৈণ রাজা!

তৃতীয়তঃ সীতাকে যদি রাম বনবাসে না পাঠিয়ে মিথিলায় পিতা জনকের কাছে পাঠিয়ে দিতেন তাতেও সীতার কলঙ্ক তাে দূর হতোই না, পরন্তু অযােধ্যার প্রজাদের দেওয়া অপবাদ মিথিলার প্রজাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত।”


[এখানে স্পষ্ট হয় যে শ্রীরামচন্দ্র অনেক বিচার বিবেচনা করে সঠিক পথ নির্বাচন করেই এই ধর্মসঙ্কটের সমাধান করেছিলেন। ]

আর আমরা যদি অদৃষ্টকে স্বীকার করি তবে বলতে হয়, রামচন্দ্রের বনবাসের জন্য যেমন কৈকেয়ীকে দোষারােপ করা যায় না, কারণ এটিই ছিল ভবিতব্য ; তেমনি দেবী সীতার বনবাসও ছিল ভবিতব্য, যার জন্য শ্রীরামচন্দ্রকে দোষ দেওয়া যায় না। এর প্রমাণ রামায়ণেই আছে।

লক্ষ্মণ যখন দেবী সীতাকে বাল্মীকির আশ্রম-প্রান্তে রেখে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে রথে ফিরে আসছেন তখন সারথি সুমন্ত্রকে বলছেন - "অন্যায়বাদী পুরবাসিগণের কথায় সীতা পরিত্যাগরূপ এই যশঃ হরণকারী কার্য করে রাম কোন ধর্ম রক্ষা করলেন?"

তার উত্তরে সুমন্ত্র বলেছিলেন,- “সৌমিত্রে! মৈথিলীর জন্য তুমি সন্তাপ করাে না। লক্ষ্মণ! পুরাকালে বিপ্রগণ তােমার পিতার নিকট ভাবী সীতার এই নির্বাসন বৃত্তান্ত শুনিয়েছিলেন। মহারাজ রাম কখনাে সুখভােগ করতে পারবেন না। নিত্য তিনি বহুবিধ দুঃখভােগ করবেন। এবং অবিলম্বে প্রিয়জন যারা রয়েছেন তাদের থেকে বিযুক্ত হবেন। এমন-কি ধর্মাত্মা মহান রাম শুধু সীতা কেন, কালের বশীভূত হয়ে ভরত, শত্রুঘ্ন এবং তােমাকেও পরিত্যাগ করবেন।"

(পুত্রদের ভবিষ্যৎ-জীবনের ঘটনাক্রম কী হবে তা দুর্বাসা মুনির কাছে জানতে চেয়েছিলেন রাজা দশরথ। মুনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। সেসময় সুমন্ত্র উপস্থিত ছিলেন।)

শ্রীরামচন্দ্র দেবী সীতাকে বাধ্য হয়ে বনবাসে পাঠালেও স্ত্রীর প্রতি তাঁর করণীয় কর্তব্যের কোন অবহেলা তিনি করেননি। কারণ, জানকী হলেন অযোধ্যার মহারানী। উপরন্তু তখন তিনি সন্তান-সম্ভবা এবং রাজকুলবধূ অথচ নিষ্পাপ। এরকম দেবী প্রতিমাকে গঙ্গার তীরে বিসর্জন দিয়ে শ্রীরামচন্দ্র বা তাঁর ভাইয়েরা কেউই নিশ্চিন্তে থাকতে পারেননি। প্রজার কল্যাণ, রাজ্যের মঙ্গল নিশ্চিত করা রাজার একান্ত কর্তব্য—এ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু রাজকুললক্ষ্মী ও তার গর্ভস্থ সন্তানের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করাও রাজার কর্তব্য এবং রাজধর্মের অন্তর্গত। না হলে পারিবারিক কর্তব্যে তার ত্রুটি আসে। সেখানেও রামচন্দ্র ক্রটিমুক্ত। যদিও প্রজাগণের নিন্দার ভয়ে এবং লােক-অপবাদ দূর করতে তিনি বাধ্য হয়েই সীতাকে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু স্বামী হিসাবে তিনি তার কর্তব্যের কোন ত্রুটিই করেননি। প্রজাসাধারণের দৃষ্টির অন্তরালে সীতার জন্য তার যতদূর করা সম্ভব তা তিনি করেছেন। এমন ইঙ্গিত রামায়ণেই রয়েছে।

প্রথমত, দেখা যায় রামচন্দ্র সীতাকে কোন বাঘ, ভল্লুক বা হিংস্র জন্তুতে ভরা জঙ্গলে নির্বাসিত করেননি। বরং স্থানান্তরিত করেছিলেন বাল্মীকির আশ্রমে। যে আশ্রমকে স্বর্গের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আর বাল্মীকি ছিলেন রামচন্দ্রের অত্যন্ত আপনজন।

এ বিষয়ে সীতাদেবীকে দেবর লক্ষ্মণ বলছেন-

“পুণ্যঞ্চ রমণীয়ঞ্চ মা বিষাদং কৃথাঃ শুভে।
রাজ্ঞাে দশরথস্যৈব পিতুর্মে মুনিপুঙ্গবঃ৷
সখা পরমকো বিপ্রাে বাল্মীকিঃ সুমহাযশাঃ।
পাদচ্ছায়ামুপাগম্য সুখমস্য মহাত্মনঃ৷
উপবাসপরৈকাগ্রা বস ত্বং জনকাত্মজে।"
উত্তরকাণ্ড, ৪৭/১৬-১৭

অর্থ- শুভে! গঙ্গাতীরে ব্রহ্মর্ষিগণের এই তপােবন, এটি রমণীয় এবং পবিত্র। অতএব আপনি এখানে থাকুন, বিষণ্ণা হবেন না। মহাযশা দ্বিজবর মুনি বাল্মীকি আমাদের পিতা মহারাজ দশরথের পরম বন্ধু। অতএব জনক তনয়ে! আপনি সেই মহাত্মার পাদমূলে উপনীত হয়ে একাগ্রচিত্তে উপাসনা করতঃ সুখে বাস করুন।

যে ভাবেই হােক, বাল্মীকিও আগে থেকেই সীতার আগমন সংবাদ পেয়েছিলেন। জেনেছিলেন সীতার প্রতি তাঁর করণীয় কর্তব্যের ইঙ্গিতও। তাই তিনি বলছেন,

“মুষা দশরথস্য ত্বং রামস্য মহিষী প্রিয়া।
জনকস্য সুতা রাজ্ঞঃ স্বাগতং তে পতিব্রতে।।"
উত্তরকাণ্ড- ৪৯/১১

অর্থ- পতিব্রতে! তুমি রামের প্রিয়তমা মহিষী, দশরথের পুত্রবধু এবং জনক রাজার কন্যা। তােমার আগমনের কুশল তাে?

মুনিবর আবার বলছেন,
“মুষা দশরথস্যৈ জনকস্য সুতা সতী।
অপাপা পতিনা ত্যক্তা পরিপাল্যা ময়া সদা॥
ইমাং ভবত্যঃ পশ্যন্ত স্নেহেন পরমেণ হি।
গৌরবান্মম বাক্যাচ্চ পূজ্যা বােহস্তু বিশেষতঃ॥"
উত্তর কাণ্ড-৪৯/২১-২২

অর্থ- এই সীতাদেবী দশরথের পুত্রবধূ এবং জনকের দুহিতা। ইনি পতিব্রতা। ইহাতে পাপের লেশমাত্রও নাই। তথাপি ইহার স্বামী ইহাকে ত্যাগ করিয়াছেন। সেইজন্য ইহাকে আমার সদা লালন পালন করিতে হইবে। তােমরা ইহাকে বিশেষরূপে সম্মান করিবে।

[ এখানে স্পষ্ট যে শ্রীরামচন্দ্র দেবী সীতাকে ত্যাগও করেন নি এবং কোন অরক্ষিত স্থানে ফেলেও আসেন নি। তিনি রাজা হিসেবে রাজধর্মকে এগিয়ে রেখেছেন কিন্তু পতিধর্ম হতেও বিচ্যুত হন নি।]

রামচন্দ্র নিজে গিয়ে বাল্মীকির আশ্রমে সীতাদেবীর খোঁজ-খবর না নিলেও শত্রুঘ্ন বা অন্যান্য ভাইয়েরা মধুপুরে যাতায়াতের পথে সীতাদেবী ও লবকুশের সব সংবাদ নিতেন। যদিও তা কৌশলে এবং যাতে লােক-সমাজে তা প্রচারিত না হয় সে বিষয়ে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা হতাে।

এ বিষয়ে রামায়ণে আছে,

যমুনা তীরবাসী জনসাধারণ মহর্ষি চ্যবনের নেতৃত্বে লবণাসুরের অত্যাচার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য রাজা রামচন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করে। শ্রীরামচন্দ্র তাদেরকে এই মহা বিপদ হতে উদ্ধারের আশ্বাস দেন এবং শত্রুঘ্নকে লবণ দৈত্য বধের ভার দেন। রামচন্দ্রের নির্দেশ মতাে শত্রুঘ্ন সৈন্য-সামন্ত, অস্ত্র-সস্ত্র ও যাবতীয় প্রয়ােজনীয় সামগ্রী সবই পাঠিয়ে দিলেন। অথচ নিজে তাদের সঙ্গে না গিয়ে এক মাস পরে সেখানে গেলেন। যাওয়ার সময় তিনি বড় ভাইয়ের নির্দেশ মতাে বাল্মীকি মুনির আশ্রমে একরাত্রি যাপন করলেন।

কেন গিয়েছিলেন বাল্মিকী মুনির আশ্রমে?

লবণাসুর বধ করে বার বৎসর পর শত্রুঘ্ন যখন পুনরায় শ্রীরামদর্শনে অযােধ্যায় যান, তখন আবার বাল্মীকির আশ্রমে আসেন ও সেদিন সেখানে বাল্মীকি রচিত রামায়ণ গীতিকাব্য শােনেন। এখানে ওই ঘটনায় কয়েকটি প্রশ্ন আসে যার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে, শ্রীরামচন্দ্র নিয়মিতভাবেই সীতার সংবাদ রাখতেন।

কারণ

১। লবণাসুর বধের জন্য শত্রুঘ্নের স-সৈন্যে যাওয়ার কথা। কিন্তু সৈন্যসামন্ত যাওয়ার এক মাস পরে তিনি গেলেন কেন? তখনকার দিনে এরকম নিয়ম তাে ছিল না যে সৈন্য আগে পাঠিয়ে দিয়ে রাজা কিংবা সেনাপতি পরে যাবে।

২। যাওয়ার সময় বাল্মীকি মুনির আশ্রমে যাওয়ার কারণ কি? বা তিনি সেখানে কাউকে না নিয়ে একাই গেলেন কেন?


সুতরাং আমরা এখানে বিনা দ্বিধায় ধারণা করতে পারি যে, শত্রুঘ্নকে বাল্মীকির আশ্রমে পাঠানাের জন্যই শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে একমাস পরে যেতে বলেন। আর বাল্মীকির আশ্রমে শত্রুঘ্নের যাওয়ার পেছনে শ্রীরামচন্দ্রের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল।

কারণ, তাছাড়া শত্রুঘ্নের সেখানে যাওয়ার কোন কারনই ছিল না। পরন্তু সে যাওয়ার পেছনে মাতা সীতার সংবাদ নেওয়ার উদ্দেশ্যই স্পষ্ট।

যেজন্য তিনি মহামুনি বাল্মিকীকে বলেছিলেন–

“গুরু জ্যেষ্ঠভ্রাতার আদিষ্ট কার্য করবার জন্য অদ্য এই স্থানে বাস করতে ইচ্ছা করি।”

এখানে তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা রামচন্দ্রের আদিষ্ট কর্ম সম্পর্কেও নিঃসন্দেহে বলা যায়, শ্রীরামচন্দ্র জানতেন মাতা সীতা সন্তানসম্ভবা এবং কোন দিন তাঁর সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে। এজন্য শত্রুঘ্নের উপস্থিতিতে মাতা সীতার সন্তান প্রসব ব্যাপারটি মােটেই কাকতালীয় ঘটনা নয় বরং তা পূর্ব নির্ধারিতই ছিল।

মাতা সীতার সন্তান প্রসব কালে শত্রুঘ্নের উপস্থিতির আরেকটি কারণ, প্রথমতঃ ওই রকম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শ্রীরামচন্দ্রের একজন নিজস্ব প্রতিনিধি তথা বংশের কারও উপস্থিতি খুব প্রয়োজন ছিল।

এবং দ্বিতীয় কারণ হল-সন্তান বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া। না হলে ভবিষ্যতে সীতার একই সঙ্গে দুটি সন্তান বিষয়েও প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক ছিল না। আর সে বিষয়েও রামচন্দ্রের নির্দেশ থাকার জন্যই সীতার সন্তান জন্মদানের কথা শুনেই শত্রুঘ্ন ক্ষান্ত না থেকে ওই গভীর রাত্রিতে স্বচক্ষে দুই নবজাতককে দেখে এসেছেন এবং সীতার সঙ্গে তিনি কথাও বলেছেন।

তবে শত্রুঘ্ন প্রথমবার একাকী যাওয়ার কারণ মনে হয়, নির্বাসিতা সীতা যে সেখানেই আছেন তা যাতে কেউ না জানে সেজন্যই। জানলেই মানুষের সন্দেহ হবে। অবশ্য পরে তার সঙ্গে লােক থাকলেও তারা যাতে বাল্মীকি মুনির আশ্রমে সব কিছু জানার আগ্রহ প্রকাশ না করে—সে বিষয়েও তিনি নিজে যেমন সতর্ক ছিলেন, তেমনি তাদেরও সতর্ক করে দিয়েছিলেন—“এই মুনিবরের আশ্রমে বিবিধ আশ্চর্য বিষয় রয়েছে। মহামুনির কাছে কৌতূহলবশে সেই সকল বিষয়ে জানতে চাওয়া উচিত হবে না।

আশ্চর্যাণি বহুনীহ ভবন্তযস্যাশ্রমে মুনেঃ।
ন তু কৌতৃহলাদ যুক্তমন্ক্টুং তং মহামুনি।।”
উত্তরকাণ্ড-৭১/২৩-২৪

শত্রুঘ্নের বাল্মীকি-মুনির আশ্রমে বারবার যাতায়াতের আরেকটি কারণ ছিল। যা হল-সীতার দুই সন্তান হল অযােধ্যার ভাবী উত্তরাধিকারী। সুতরাং, শ্রীরামচন্দ্রের উত্তরসূরী হিসাবে তাদের যে ভাবে শিক্ষা-দীক্ষা হওয়া দরকার এবং তারা কিভাবে বড় হচ্ছে, না হচ্ছে সে সম্পর্কেও খোঁজ নেওয়া। আবার একথাও ঠিক যে, শত্রুঘ্ন বাল্মীকি মুনির আশ্রমে বারবার গেলেও মুনিবরকে সীতা সম্পর্কে একটি কথাও জিজ্ঞাসা করেননি। এই জিজ্ঞাসা না করার পেছনেও আছে নীতিগত কারণ। কারণ, নিরপরাধ যে সীতাকে তাঁরা বনবাসে পাঠিয়েছেন ফের তার কুশলাকুশল জিজ্ঞাসা করবেন কোন মুখে। তাছাড়া সেজন্য যদি মুনি অসন্তুষ্ট হন তারও ভয় ছিল। কিন্তু বাল্মীকি মুনি তাদের মনের সব খবর বুঝতেন। তাই রামায়ণ গানের মধ্য দিয়ে তিনি শত্রুমকে সব খবরই দিয়েছিলেন।


এ সকল তথ্য অনুসরণ করে মাতা সীতার বনবাস সম্বন্ধে নিঃসংশয়ে বলা যায়, সীতাদেবীকে শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে তথা বাল্মীকি মুনির আশ্রমে পাঠিয়ে তিনি তাঁকে কোন অকূল পাথারেও যেমন ভাসিয়ে দেননি, তেমনি অনিশ্চয়তার অন্ধকারেও নিক্ষেপ করেননি। শ্রীরামচন্দ্র একজন আদর্শ রাজা, সুতরাং তাঁর চরিত্র যেন প্রজাগণের সমালােচনার উৎস না হয় এবং প্রজাগণ যাতে সন্তুষ্ট থাকে, সেজন্যই তিনি সীতাদেবীকে বাল্মীকি মুনির আশ্রমে স্থানান্তরিত করেছিলেন মাত্র। বরং বলা উচিত মাতা সীতাকে বিপ্রবাসে পাঠানাে হয়েছিল। পরন্তু শ্রীরামচন্দ্র শত্রুঘ্ন ও অন্যান্য ভাইদের মাধ্যমে সীতাসহ দুই পুত্রেরই নিয়মিত খোঁজ-খবর নিতেন। সুতরাং রামরাজত্বের মন্দ দিক‌ বিষয়ে যুক্তিবাদীদের এই অপযুক্তি যেমন অচল, তেমনি শ্রীরামচন্দ্রও সম্পূর্ণ বিতর্কের উর্ধে। 

SPS পরিবার।
সনাতনী ঐক্য, প্রচার ও কল্যাণে অবিচল।

সহযোগিতায়ঃ স্টিমন অনিক ও মনোসিজ চক্রবর্তী

বিশেেষ ধন্যবাদঃ স্বামী যুক্তানন্দ 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ