মাধ্যমিকের উচ্চতর গণিতে জ্যামিতির তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা যারা যারা বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়ন করেছি প্রত্যেকেই "ব্রহ্মগুপ্তের উপপাদ্য" সমাধান করেছি।
★ কে এই ব্রহ্মগুপ্ত ?
ব্রহ্মগুপ্ত ছিলেন পৃথিবীর মহানতম গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ। তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম, যাঁদের হাত ধরে জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতের বিকাশ হয়েছে।
ব্রহ্মগুপ্তের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ
তাঁর জীবনী সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। ধারণা করা হয় ব্রহ্মগুপ্ত ৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের উত্তর পশ্চিমের রাজস্থানের ’ভিনমাল’ (তৎকালীন ভিল্লামালা) নামক শহরে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল যিষ্ণুগুপ্ত। ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটান ভিল্লামালায়, রাজা ভ্যাগ্রমুখের রাজত্বকালে। ধারণা করা হয় তিনি রাজার অনুগ্রহপুষ্ট ছিলেন। অনেক সময় তাঁকে ভিল্লামাচারিয়া (ভিল্লামার শিক্ষক) বলে ডাকা হত। তিনি উজ্জাইনের মানমন্দিরের প্রধান ছিলেন। ৬৬৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
ব্রহ্মগুপ্তের অবদানসমূহঃ
উজ্জাইনের মানমন্দিরের প্রধান থাকাকালীন ব্রহ্মগুপ্ত গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার উপর চারটি বই লেখেন। এই বইগুলো হল ’চাদামেকেলা’, ’ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্ত’, ’খণ্ডখদ্যকা’ এবং ’দুরকেয়াম্যনাদ্রা’। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্ত (ব্রহ্মর সংশোধিত নীতিমালা/ The Opening of Universe)।
ইতিহাসবিদ আবু রায়হান আল বিরুনী (৯৭৩ - ১০৪৮) তাঁর বই "তারিখ আল হিন্দ (ভারতীয় ইতিহাস)" এ উল্লেখ করেন, আব্বাসীয় খলিফা আল মামুনের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ভারতবর্ষ থেকে একটি বই আরবে নিয়ে আসেন এবং তা আরবিতে অনুবাদ করেন "সিন্দহিন্দ" নামে।
ধারণা করা হয় এ বইটি ছিলো ব্রহ্মগুপ্তের লেখা 'ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্ত'। তিনি তাঁর সমকলীন জ্যোতির্বিদদের ভুল বের করার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি যে তাঁর সময়কার এবং তদানিন্তন ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ছিলেন সেই বিষয়ে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ জর্জ সার্টনও বলে গেছেন।
ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর বই ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্তে মোট ২৪ টি চ্যাপ্টার লেখেন, যার মধ্যে শেষের ১৪ টি কে আসলে প্রথম ১০ টির এক্সটেনশন বলা যেতে পারে।
চ্যাপ্টারগুলো এরকম:
১। গ্রহসমূহের গড় কোঅর্ডিনেট, ২। গ্রহসমূহের আসল কোঅর্ডিনেট, ৩। আন্হিক গতির উপর তিনটি সমস্যা, ৪। চন্দ্রগ্রহণ, ৫। সূর্যগ্রহণ, ৬। উদয়াস্ত, ৭। চাঁদের অর্ধাকৃতি, ৮। চাঁদের ছায়া, ৯। গ্রহসমূহের সংযোগ, ১০। গ্রহসমূহের সাথে স্থির নক্ষত্রের সংযোগ, ১১। পূর্ববর্তী জ্যোতির্বিদ্যার উপর পরীক্ষণ, ১২। পূর্ববর্তী গণিতের উপর পরীক্ষণ, ১৩। চ্যাপ্টার ১ এর এক্সটেনশন, ১৪। চ্যাপ্টার ২ এর এক্সটেনশন, ১৫। চ্যাপ্টার ৩ এর এক্সটেনশন, ১৬। চ্যাপ্টার ৪ ও ৫ এর এক্সটেনশন, ১৭। চ্যাপ্টার ৭ এর এক্সটেনশন, ১৮। বীজগণিত, ১৯। উন্মোচনকারী, ২০। পরিমাপ, ২১। গোলক, ২২। যন্ত্র, ২৩। সূচিপত্র, ২৪। ছক
ব্রহ্মগুপ্ত ও আরবীয় গণিত/বিজ্ঞানঃ
আরব জ্যোতির্বিদগণ ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে যা জেনেছেন, তার বেশিরভাগই ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্তের মাধ্যমে। আব্বাসীয় বংশের দ্বিতীয় খলিফা আল মনসুর (শাসনকাল ৭৫৪ - ৭৭৫) তাইগ্রিসের তীরে বাগদাদ নগরীর পত্তন করেন, এবং একে জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্র রূপে গড়ে তোলেন। ৭৭০ সালে তিনি উজ্জাইন থেকে কংকা নামের এক ভারতীয় পণ্ডিতকে বাগদাদে আমন্ত্রণ জানান, যিনি ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্তের সাহায্যে গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যার ভারতীয় পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। গণিতজ্ঞ, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ আল ফাজারী খলিফার নির্দেশে ব্রহ্মগুপ্তের লেখা আরবিতে অনুবাদ করেন।
[https://en.m.wikipedia.org/.../Indian_influence_on...]
[https://en.wikipedia.org/wiki/Muhammad_ibn_Musa_al-Khwarizmi]
পারস্যের বিখ্যাত গণিতবিদ আল-খারিজমি (৮০০-৮৫০ খ্রিস্টাব্দ) তার ল্যাটিন ভাষায় রচিত "Algorithmo de Numero Indroum" গ্রন্থে ভারতীয় সংখ্যাতত্ত্বের বিস্তর ব্যবহার করেন এবং সেখানে ব্রহ্মগুপ্তের ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্তের প্রভাব ছিল ব্যাপক।
পূর্বে ভাবা হত পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের চেয়ে বেশি। ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর গ্রন্থের সপ্তম অধ্যায়ে (চাঁদের অর্ধাকৃতি) এই ভুল ধারণা খণ্ডন করেন। জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর আরো যেসব গবেষণা আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো সময়ের সাথে নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয়ের পদ্ধতি, নক্ষত্রের উদয় ও অস্ত সম্পর্কিত গবেষণা এবং সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কিত গণনা। প্রাচীন ধারণায় পৃথিবীকে সমতল ভাবা হত, যার বিরোধিতা করেন ব্রহ্মগুপ্ত। তিনি বলেন পৃথিবী ও সূর্য গোলাকার এবং পৃথিবী গতিশীল। আল বিরুনী তাঁর "তারিখ আল হিন্দ (ভারতের ইতিহাস)" বইয়ে উল্লেখ করেন যে, তত্কালীন অনেকেই ব্রহ্মগুপ্তের মন্তব্যের বিরোধিতা করেন এই বলে যে পৃথিবী যদি গোলাকার হত, তাহলে তার থেকে গাছপালা, পাথর আছড়ে পড়তো।
ব্রহ্মগুপ্ত এসব ধারণাও খণ্ডন করেন।
তিনি বলেন,
"ভারি বস্তুসমূহ পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে আকৃষ্ট হয়। পানির ধর্ম যেমন গড়িয়ে যাওয়া, আগুনের ধর্ম যেমন জ্বালানো, বাতাসের ধর্ম যেমন বয়ে চলা, তেমনি পৃথিবীর ধর্ম বস্তুসমূহকে আকর্ষণ করা ও ধরে রাখা। এ কারণেই ভারি বস্তুকে উপর থেকে ছেড়ে দিলে তা নিচে পড়ে যায়।"
এভাবে ব্রহ্মগুপ্ত নিউটনেরও প্রায় হাজার বছর আগে প্রথম অভিকর্ষের ধারণা দেন।
ব্রহ্মগুপ্তের প্রধাণ ও সবচেয়ে অসাধারণ আবিষ্কার ছিল শূন্য/Zero (0)। তিনি সবার প্রথম '0' এর সংজ্ঞা দেন এভাবে যে, কোনো সংখ্যাকে সেই একই সংখ্যা থেকে বিয়োগ করলে '০' পাওয়া যাবে। তিনি আরো বলেন, কোনো সংখ্যার সাথে '০' যোগ করলে সেই সংখ্যার কোনো পরিবর্তন হয় না এবং কোনো সংখ্যাকে '০' দিয়ে গুণ করলে '০' পাওয়া যায়।
এর আগে ব্যাবিলোনিয়ান ও রোমান গণিতবিদগণ '০' কে কোনো আলাদা ডিজিট হিসাবে বিবেচনা করতেন না। ব্রহ্মগুপ্তই সর্বপ্রথম জিরোকে আলাদা ডিজিট হিসেবে পরিচয় করান।
সেই হিসেবে শূন্য আবিস্কারের প্রথম কোন ব্যক্তির নাম বলতে হলে অবশ্যই ব্রহ্মগুপ্তের নাম আগে আসবে। এছাড়া তিনি শূন্যের ব্যবহার আলোচনা করতে গিয়ে x/0 বা 0/x কে এভাবেই লিখতে পরামর্শ দেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি ‘শূন্য’ কে Infinitesimal বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রাশি রূপে কল্পনা করেছিলেন। যা পরবর্তীতে গ্রিকরা এপসাইলন দ্বারা চিহ্নিত করেছিল; ক্যালকুলাসের জন্য এই ধারণাটি অনেক গুরুত্ব বহন করে ।
গণিতের বেসিক চারটা অপারেশন (যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ) আমরা এখন যেভাবে অপারেট করি, তা মূলত আরব-ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতির আবিষ্কার, যা প্রথম পাওয়া যায় ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্তে। অবশ্য ভিন্ন মতবাদ অনুযায়ী সুমেরীয়রা এই পদ্ধতিগুলো প্রথম আবিষ্কার করে প্রায় ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। বইটির দ্বাদশ অধ্যায়ের গণনা নামক অনুচ্ছেদে ব্রহ্মগুপ্ত ভগ্নাংশের উপর বিস্তারিত আলোচনা করেন।
ব্রহ্মগুপ্ত গণিতকে বীজগণিত ও পাটীগণিত এ দু’ভাগে ভাগ করেন। পাটিগণিতকে তিনি বলেন জ্ঞাত সংখ্যার সাহায্যে গণনা এবং বীজগণিতকে বলেন অজ্ঞাত বা অজানা রাশির গণনা। অবশ্য ব্রহ্মগুপ্ত বীজগণিত নামটি ব্যবহার করেননি, তিনি একে “কুট্টক গণিত” নামে অভিহিত করেছিলেন।
ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর বইয়ের অষ্টাদশ অধ্যায়ে (বীজগণিত) লিনিয়ার ইকুয়েশনের (একমাত্রিক সমীকরণ) সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি এই চ্যাপ্টারের শেষের দিকে দ্বিঘাত সমীকরণেরও দুটো সমাধান দেন, যদিও এ সমাধানের সাথে বর্তমান সময়কার সমাধানের কিছু পার্থক্য চোখে পড়ে। ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর বইয়ে যে নোটেশনগুলো ব্যবহার করেন, তা বেশ মজার। এগুলো এরকম:
১। দুটো সংখ্যাকে পাশাপাশি লিখে যোগ বোঝানো হয়।
২। যদি কোনো সংখ্যাকে আরেকটি সংখ্যা থেকে বিয়োগ করতে হয়, তাহলে সেই সংখ্যার মাথায় একটা ফোঁটা বা ডট দিতে হবে।
৩। ভাগের ক্ষেত্রে ভাজ্যের নিচে ভাজককে লেখতে হবে। এটা বর্তমান সময়ের 'বাই' এর মতো, শুধু মাঝের হরাইজন্টাল লাইনটা ছাড়া।
দ্বিঘাত সমীকরণের সমাধান করতে গিয়ে যে ঋণাত্মক সংখ্যা চলে আসলে দিউফান্তাস (Diophantus) তা বাদ দেন এবং অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু ব্রহ্মগুপ্ত ঋণাত্মক রাশিটিও এর একটি সমাধান হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ঋণাত্মক সংখ্যা ব্যবহারের একটি নিয়ম তুলে ধরেন।
তিনি ত্রিঘাত সমীকরণ সমাধানের যে পদ্ধতি অবলম্বন করেন পরবর্তীতে অয়লার (Euler) ১৭৬৪ সালে সেই একই পদ্ধতিতে ত্রিঘাত সমীকরণ সমাধান করেন। আর্যভট্ট এই পদ্ধতিতেই একঘাতবিশিষ্ট সমীকরণ সমাধান করেছিলেন।
ব্রহ্মগুপ্ত দশের বর্গমূলকে 'পাই' এর আসল মান এবং ৩ কে এর ব্যবহারিক মান বলে উল্লেখ করেন। এছাড়াও তিনি সাইন ফাংশন, ইন্টারপোলেশন, ধারার যোগফল ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন।
ব্রহ্মগুপ্ত গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, অভিকর্ষ ধারণাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অভাবনীয় অবদান রেখে গেছেন কিন্তু সনাতনী হয়েও আমরা আমার গর্বের ব্রহ্মগুপ্তকে মনে রাখি নি।
সামান্য তথ্যভিত্তিক উপস্থাপনা দিয়ে এই মহান বিজ্ঞানীকে তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।
©স্টিমন অনিক।
1 মন্তব্যসমূহ
অধুনা পশ্চিমবঙ্গ সহ তৎকালীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্ধকার যুগ বলে একটি বড় কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছিল। তার ক্ষত এখনও দগদগে। ঐ অন্ধকার যুগের মধ্যে বহু ঐতিহাসিক দলিল ওলটপালট হয়ে গেছে বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে গেছে সেটা বলাই বাহুল্য। ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখতে গিয়ে ঐতিহাসিক দের হাতে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে উঠে আসছে কলহন এর রাজতরঙ্গিনী।1188মতান্তরে 1192 সাল নাগাদ কলহন যে দলিল রচনা করেছিলেন সেটা কেই ভারতবর্ষের ইতিহাসে র প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গ্ৰহণ করছেন অধুনা ইতিহাস বিদ গন। তাহলে প্রশ্ন টি হল খ্রীষ্ট জন্মের পর ভারতবর্ষের ইতিহাস কি ছিল সেই সময়কার পুঁথি,গ্ৰন্থ,লিপি,মুদ্রা যা যা পাওয়া যায় সেসব নিয়ে বিস্তর মতানৈক্য আছে। আজগুবি বলে অনেক ঐতিহাসিক ই পাত্তা দেয় না,তাই ব্রহ্মগুপ্তের প্রতিভা ও আজগুবি র পর্যায় পড়ে গেছে। ধন্যবাদ আপনাকে প্রতিভাবান মানুষ টি কে খুঁজে বের করার জন্য।
উত্তরমুছুন