ভাষা আন্দোলনের প্রথম নেতা ও সৈনিক, একজন সনাতনী।

 


কি, অবাক লাগলো!!
তাহলে চলুন একটু আলোচনা করি।
পাকিস্তান গণপরিষদে যিনি প্রথম মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদার দাবি তুলে ধরেছিলেন, একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে বীরগতি প্রাপ্ত (শহীদ) হওয়ার আগ পর্যন্ত যিনি স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন তিনি মহান বীরগতি প্রাপ্ত (শহীদ) ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
একুশ নিয়ে আজ আমরা গর্ব করি, যে একুশ আজ সমগ্র বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয় সেই একুশের সূত্রপাত হয়েছিল বীর (শহীদ) ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে। আমরা মায়ের ভাষায় প্রাণখুলে কথা বলতে পারছি যে সকল কালজয়ী মহান ব্যক্তির অক্লান্ত ত্যাগের কল্যাণে তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। কিন্তু কি এক আজানা কারনে আমাদের ইতিহাসে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম মুছে ফেলা হয়েছে প্রায় এবং উচ্চারিত হয় না কোন একুশে ফেব্রুয়ারির মঞ্চে এমনকি পাপ্য স্থান মিলে নি পাঠ্যপুস্তকেও। তাই সেই দায়িত্ব তুলে নিলাম আমরাই এবং উনার অবদান তুলে ধরা হবে আমাদের (SPS) ব্লগে।
ধীরেন দত্ত তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং কারাগারে আটক ছিলেন। ১৯৩৫ সালের নতুন ভারত শাসন আইনে ১৯৩৭ সালে যে সাধারণ নির্বাচন হয়, তাতে জয়লাভ করে তিনি বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনেও তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন।


ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাতঃ
যদিও ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা বুঝি কেবল ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকেই পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত।
অধিবেশনের শুরুতে আলোচনার সূত্রপাত করে পূর্ব বাংলার কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেনঃ Mr. President, Sir, I move: “That in sub-rule (1) of rule 29, after the word ‘English’ in line 2, the words ‘or Bengalee’ be inserted.”
পাকিস্তান গণপরিষদের এ অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই পূর্ব বাংলায় বাংলাকে অফিস-আদালতের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার জন্য ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনেরই প্রতিফলন ঘটে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক উত্থাপিত ভাষা বিষয়ক একটি প্রস্তাবের মধ্যে।
প্রস্তাবটিতে তিনি বলেন,
উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের অধিকার থাকতে হবে।'
দাবীর পেছনে যুক্তি কি ছিল?
তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন, পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের ছয় কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে চার কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাংলা ভাষাভাষী। সুতরাং বিষয়টিকে প্রাদেশিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাংলাকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে দেখা উচিত এবং সেই প্রেক্ষিতেই বিবেচনা করা উচিত। তাই তিনি গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্তির দাবি তুলেন।
বিরোধিতা করেছিল কারা?
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটি পাকিস্তান গণপরিষদে আলোচিত হয় ১৯৪৮’র ২৫ ফেব্রুয়ারি। প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে বক্তৃতা করেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, মোহাজের ও পুনর্বাসনমন্ত্রী গজনফর আলী খান, পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন এবং গণপরিষদের সহ-সভাপতি তমিজউদ্দিন খান।
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তার বক্তৃতায় বলেন,
'পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা ও একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।’ খাজা নাজিমুদ্দীন বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনোভাব, ‘একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্র ভাষারূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।’

ধীরেন্দ্রনাথের পাশে দাড়িয়েছিলেন কে?
সেদিন মুসলিম নেতাদের তীব্র বিরোধিতার মুখে ধীরেন্দ্রনাথের পাশে দাড়িয়েছিলেন আরেকজন সনাতনী। মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের নেতাদের এসব বক্তব্যের জবাবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব সমর্থন করে গণপরিষদে কংগ্রেস দলের সেক্রেটারি রাজকুমার চক্রবর্তী বলেন,
'উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশেরই কথ্য ভাষা নয়। তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপরতলার কিছুসংখ্যক মানুষের ভাষা। আসলে এ হলো অন্যদের উপর উচ্চশ্রেণির আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা। বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্য চাপ দিচ্ছি না। আমরা শুধু চাই পরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি। ইংরেজিকে যদি সে মর্যাদা দেয়া হয়, তাহলে বাংলা ভাষাও সে মর্যাদার অধিকারী।’
অতঃপর ১১ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা উর্দু বিল পাশ হয়ে যায়।
ওই দিন সারা পূর্ব বাংলায় প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত করাচীর অধিবেশন থেকে ঢাকায় ফিরে এলে, বিমান বন্দরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা তাকে বিপুল সম্বর্ধনা জানান। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত মূলতঃ সেখান থেকেই।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের অধিবেশনের ঠিক আগে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ কয়েকজন পরিষদ সদস্যকে ছাত্ররা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ভেতরে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের দ্বারা আক্রান্ত কয়েকজনের কাছে নিয়ে যান এবং পরিষদের বাংলা ভাষার সপক্ষে বলার জন্য তাদের কাছে দাবি জানান।
শুধু ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সমগ্র পর্যায়টিতে পরিষদের অভ্যন্তরে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষার সপক্ষে এবং ছাত্র ও সাধারণ মানুষের ওপর সরকারি নির্যাতনের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তৃতা করেন।
বীরগতি (শহীদ) প্রাপ্ত হন এই মহান বীর সনাতনী সন্তান।
এত অক্লান্ত ত্যাগের পরও বাংলাভাষার এই প্রথম প্রাণপুরুষ স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই বর্বর পাক হানাদার বাহিনী যে নির্মম গণহত্যা শুরু করে, তিনি তার শিকার হন। তাকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ। ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে তার উপর চালানো হয় অমানবিক অত্যাচার। এক সাক্ষাৎকারে সেই বিবরণ দিয়েছেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ক্ষৌরকার রমণীমোহন শীল। রমণীমোহন শীল হিন্দু হলেও তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল পাকিস্তানী মিলিটারিদের প্রয়োজনেই, কারণ তার মৃত্যু হলে পাকিস্তানী সৈন্যদের চুল দাড়ি কাটার মতো কোন লোক থাকবে না।
বীরগতি প্রাপ্ত (শহীদ) ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন হয়েছে তার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ছিলেন রমনীমোহন শীল। সাখাওয়াত আলী খান প্রদত্ত এক সাক্ষাতকারে জানা যায়: ‘ধীরেন বাবু সম্পর্কে বলতে গিয়ে রমণী শীলের চোখের জল বাঁধন মানেনি। মাফলারে চোখ মুছে তিনি বলেন, ‘আমার সে পাপের ক্ষমা নেই। বাবু স্কুলঘরের বারান্দায় অতি কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কোথায় প্রস্রাব করবেন। আমি আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় তাকে প্রস্রাবের জায়গা দেখিয়ে দিই। তখন তিনি অতি কষ্টে আস্তে আস্তে হাতে একটি পা ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠানে নামেন। তখন ঐ বারান্দায় বসে আমি এক জল্লাদের দাড়ি কাটছিলাম। আমি বার বার বাবুর দিকে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলাম বলে জল্লাদ উর্দুতে বলে, ‘এটা একটা দেখার জিনিস নয়, নিজের কাজ কর।’
‘এরপর বাবুর দিকে আর তাকাবার সাহস পাইনি। মনে মনে শুধু ভেবেছি বাবু জনগণের নেতা ছিলেন, আর আজ তার কপালে এই দুর্ভোগ। তার ক্ষতবিক্ষত সমস্ত দেহে তুলা লাগান, মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় উপর্যুপরি কয়েকদিনই ব্রিগেড অফিসে আনতে নিতে দেখি।’ (শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ: পৃষ্ঠা ৩০২)
তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা।
নিউইয়র্কের ওল্ড ওয়েস্টব্যারির প্রফেসর ড. সব্যসাচী ঘোষ দস্তিদার তার ‘অ্যাম্প্যায়ারস লাস্ট কজালটি’ বইয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : দি ফাদার অব দি আইডিয়া অব বাংলাদেশ।’ তিনি লিখেছেন, ‘কুমিল্লার ঠাকুরপাড়ায় তার শ্মশান পরিদর্শকালে আমার আবার মনে হলো কীভাবে হিন্দুরা উপেক্ষিত হয়। দত্তবাবু হিন্দু ছিলেন। তিনিই প্রথম পাকিস্তানের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবি তুলেছিলেন। ভাষার প্রতি তার ভালোবাসার চূড়ান্ত পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ। তার এই স্বপ্নপূরণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।’ তিনি লিখেছেন, ‘একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী দত্ত ও তার ছেলেকে টেনে-হিঁচড়ে ধরে নিয়ে যায়, তাদের আর খোঁজ মেলেনি।’ লেখক দুঃখ করে লিখেছেন, “অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে এই মহান নেতার বাড়িঘর ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে বাজেয়াপ্ত হয়।” তিনি তুলনা করে বলেন, আমেরিকায় জর্জ ওয়াশিংটনের বাড়িঘর ‘শত্রু-সম্পত্তি’ হয়ে গেছে কি ভাবা যায়?

[http://empireslastcasualty.blogspot.com/2009/10/dhirendranath-datta-father-of-idea-of.html]

আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে সেই মহান বীর ও ভাষা আন্দোলনের প্রথম "ওয়ান ম্যান আর্মি" শ্রী ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের প্রতি SPS পরিবারের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
©SPS পরিবার
তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপনায়ঃ স্টিমন অনিক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ