নাস্তিক বা মুক্তমনা থেকে প্রায় সৃষ্টির পেছনের কারণ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়, তারা প্রশ্ন তুলেন কার্য্য কারণের সম্বন্ধকে নিয়ে। সেই বিষয়গুলি শ্রুতির আলোকে ব্যাখা করার চেষ্টা করব।
পরিদৃশ্যমান এই জীবজগতের স্বরুপ নিরুপন করতে হলে এর কারণ অনুসন্ধান প্রয়োজন। এজন্য যেকেনো বৈজ্ঞানিক /দার্শনিক/অধ্যাত্মতত্তান্বেষী এর মূল কারণ জানার চেষ্টা করেছেন। উপনিষদের মতে নিত্য শুদ্ধ বিরাট ব্রহ্মই এই জগতের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ। তার হতেই সৃষ্টি এবং প্রলয়ে তাতেই লীন হয়ে যায়। যেমন শক্তির ব্যাখা বিজ্ঞান করে।
সদেব সোম্যেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ম্ । তদ্বৈক আহুরাসদেবেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ং তস্মাদসতঃ সজ্জায়ত।।
কুতস্তু খলু সৌম্যোবং স্ঠাদিতি হোবাচ কথমসতঃ সজ্জায়েতেতি। সদ্রব সৌমেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ম।।
তদৈক্ষত বহু স্ঠাং প্রজায়েয়েতি তত্তেজোহসৃজত তত্তেজ ঐক্ষত বহু স্ঠাং প্রজায়েয়েতি তদপোহসৃজত...।।
তা আপ ঐক্ষন্তু বহব্যঃ স্ঠাম প্রজায়মহীতি তা অন্নমসৃজন্ত তস্মাদ যত্র ক্ক চ বর্ষতি তদেব ভূয়িষ্ঠমন্নং ভবত্যদ্ভ্য এব তদধ্যন্নদ্যং জায়তে।।
(ছান্দোগ্য ৬।২.১-৪)
অর্থাৎ, (অরুনি বলিলেন) হে সৌম্য, সৃষ্টির পূর্বে এক সদ্ বস্তুই ছিল। কেউ কেউ বলেন যে পূর্বে কিছুই ছিল না এবং এই অসৎ হতেই যা কিছু উৎপত্তি।
(অরুণি) বলিলেন, কিন্তু সৌম্য অসৎ হতে সৎ কিভাবে উৎপন্ন হবে? (কারণ যা অসৎ তা অলীক। অলীক হতে কোন বস্তুর উৎপন্ন হতে পারে না)। অতএব সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র অদ্বিতীয় সৎই বর্তমান ছিলেন।
সেই সৎ দেখলেন, " আমি বহু হব, সমক্য রুপে অভিব্যাক্ত হব।'' তিনি তেজ সৃষ্টি করলেন। সেই তেজ দেখলেন, ' আমি সমক্যরুপে অভিব্যক্ত হব। ' উক্ত তেজ জল সৃষ্টি করলেন।
সেই সৎ দেখলেন, " আমি বহু হব, সমক্য রুপে অভিব্যাক্ত হব।'' তিনি তেজ সৃষ্টি করলেন। সেই তেজ দেখলেন, ' আমি সমক্যরুপে অভিব্যক্ত হব। ' উক্ত তেজ জল সৃষ্টি করলেন।
একই কথা অন্য উপনিষদেও বলা আছে, " আদি কারণ " সৃষ্টির পূর্বে ইচ্ছা বা চিন্তা করেছিলেন। " হে সৌম্য, এই বিশ্ব প্রথমে সৎ ছিল, এই সৎ ছিলেন এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি (আত্মা) মনে করলেন ' এক আমি বহু হইব, আমি জগতের বিস্তার করব। ' সুতরাং ব্রহ্ম এই জগৎ সমূহকে সৃষ্টি করলেন ( ঐ ১.১.১-২)। অচেতনের পক্ষে চিন্তা করা সম্ভব নয়, তাই ব্রহ্ম চেতনা সম্পন্ন। ঐ রুপ ব্রহ্ম হতেই সমস্ত জীবের ভোগ্য পদার্থ স্বরুপ অব্যাক্ত প্রকৃতি অভিব্যক্ত হয়(মায়া)। ঐ রুপ অন্ন বা প্রকৃতি থেকে প্রাণ অর্থাৎ ব্যাষ্ঠিজগতের জ্ঞান ও ক্রিয়া শক্তির সমষ্ঠ্যাত্মক হিরণ্যগর্ভ উৎপন্ন হন। ঐ হিরণ্যগর্ভ হতে সমষ্ঠ্যাত্মক অন্তঃকরণ এবং অন্তকরণ হতে আকাশাদি পঞ্চভূত ও পঞ্চভূত হতে ভূঃ প্রভৃতি লোকসমূহ এবং প্রানী তাহার কর্ম ও কর্মফল উৎপন্ন হয়। (মন্ডুক ১।১।৮)
ব্রহ্ম স্বয়পং বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ এবং অপরিবর্তনীয় হওয়ায় তাকে নিয়ে সর্বজ্ঞত্ব এবং সৃষ্টত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা বাতুলতা কেবল। কারণ ব্রহ্ম মায়ার সাহায্য সর্বজ্ঞ এবং সৃষ্টি করতে সক্ষম৷ সুতরাং ব্রহ্ম, উপনিষদে যাকে ' সৎ ' বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি ইচ্ছা করেছেন - তিনিই আদি কারণ।
শ্রুতির পরবর্তী অংশে দেখা যায়,
" সেই তেজ ( অগ্নি) ঈক্ষণ করিলেন ' আমি বহু হইব, আমি জাত হইয়া প্রকট হইব। ' তেজ জল সৃষ্টি করলেন, তা হতে মৃত্তিকা (ক্ষিতি) সৃষ্টি হল। ( ছা ৬.২.৩-৪) ।
এখন আমি এই তিনটি ( অগ্নি, জল এবং ক্ষিতিতে) জীবাত্মারুপে প্রবেশ করে নাম ও রুপে প্রকাশিত হব ( অনেন জীবেনাত্মনাহনুপ্রবিশ্য নামরুপ ব্যাকরবানীতে) (ছা ঃ ৬.৩.২)
অধিকন্তু বিভিন্ন দেবগণ তাঁহা হতে জাত হন, সাধ্যসমূহ, মনুষ্যগণ, পশু সকল, পক্ষিগণ, জীবন, ব্রীহিষব, তপস্যা, শ্রদ্ধা, সত্য ব্রহ্মচর্য এবং ইতি কর্তব্যও তাঁহা হতে উৎপন্ন হয়। (মুণ্ডুক ২।১।৭)
(মস্তকস্থ) সাতটি ইন্দ্রিয় (চক্ষুর্দ্বয়, কর্ণস্বয়, নাসা-রন্ধদ্বয়, রসনা) তাঁহা হতে ঊৎপন্ন। এই ইন্দ্রিয় গণের দীপ্তি সাতটি, সমিধ ( অর্থাৎ বিষয়) সাতটি ; হোম ( অর্থাৎ বিষয় -বিজ্ঞান) সাতটি ও এইব্যে সাতটি ইন্দ্রিয়ের অবস্থান ক্ষেত্র - যাহাতে প্রতি প্রানিভেদে এই সাতটি শরীরাশ্রিত ইন্দ্রিয় (বিধাতা কর্তৃক) সংস্থাপিত হইয়া বিচরণ করে, ইহারাও উৎপন্ন হয়। (মুন্ডক ২।১।৮)
এই পুরুষ হইতে সমুদ্র ও পর্বত সমূহ সম্ভুত হয়, সকল রকমের নদী ইহা হতে প্রবাহিত হয়, ইহা হতে ঔষধি সমূহ জাত হয় এবং যাহার বলে সূক্ষ্ণ শরীর স্থুল পঞ্চভূতের দ্বারা বেষ্ঠিত হয় অবস্থান করে সেই মধুরাদি রসও ইহা( ব্রহ্ম) হতে উৎপন্ন হয় ( মুণ্ডুক ২।১।৯)
সেই পুরুষ চিন্তা করলেন " কার নিষ্ক্রমণে আমি নিষ্ক্রান্ত হব? আর কাহারই বা অবস্থানে আমি (দেহ) অবস্থিত থাকব? (প্রশ্ন ৬।৩)
তিনি (হিরণ্যগর্ভ) প্রাণকে সৃজন করলেন এবং প্রাণ হতে শ্রদ্ধার সৃষ্টি করলেন। অতঃপর ক্রমে আকাশ, বায়ু, তেজ, জল, পৃথিবী, ইন্দ্রিয়, মন, অন্ন, অন্নসম্ভুত বীর্য, তপস্যা, মন্ত্রসমূহ, অগ্নিহোত্রাদি কর্ম, লোকসমূহ এবং তার নাম সৃষ্টি করলেন। (প্রশ্ন ৬।৪)
উর্ণনাভ যেরুপে নিজ দেহ হতে তন্তু উৎপাদন করে ও আত্মসাৎ করে, ভুপৃষ্ট যেরুপে লতাগুল্মাদি উৎপন্ন হয়, মনুষ্যদেহে যেভাবে কেশ ও লোম হয়, তদরুপ অক্ষর ব্রহ্ম হতে এই চরাচর বিশ্ব উৎপম্ন হয়। (মুন্ডক ১।১।৭)
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ৬.৯ বলা আছে, " তিনি কারণ, তিনি ইন্দ্রিয়ের অধিপতি ; তাহার কোন জনক নাই, অধিপতিও নাই "।
সুতরাং এটি প্রতিষ্ঠিত হল সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান ব্রহ্মই হলেন জগতের আদি কারণ, অচেতন প্রধান বা অন্য কিছু কারণ হতে পারে না। সমস্ত শ্রুতি বাক্যের তাৎপর্য হতে জগতের কারণত্ব সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়।
----- রবিন দে
0 মন্তব্যসমূহ