একটি প্রকল্পিত কথোপকথন।।
দ্বীপঃ দাদা, নমস্কার। সাকারবাদ, অবতারবাদ, মূর্তি পুজা বিষয়ে একটু জিজ্ঞেস করতে চাই। কলেজের অহিন্দু বন্ধুরা প্রায়ই উত্যক্ত করে।
আমিঃ নমস্কার ভ্রাতা। আগুন নিরাকার নাকি সাকার?
দ্বীপঃ দাদা, আগুন জ্বালালে আগুন দেখা যায় অন্যথায় অদৃশ্য কিংবা অস্তিত্বহীন। আগুনের নির্দিষ্ট কোন আকার নেই, মোমবাতিতে স্বল্প শিখা আবার জঙ্গলের আগুণের শিখা বিস্তৃত। আগুনের বিষয়টা ক্লিয়ার করো ত, দাদা।
আমিঃ কিছু বিষয় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করো। ধরো, অস্ট্রেলিয়ার এক বিশাল বনভূমি যেখানে কোথাও কোন আগুন নেই, কেউ আগুন ধরালোও না। হঠাৎ করে বনে আগুন লাগলো, নিমিষেই সমগ্র বনভূমিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। এবার কিছু প্রশ্ন করো নিজেকে যে কোথা হতে এলো এই আগুন? কিভাবে ছড়িয়ে পড়ল এই আগুন সমগ্র বনভূমিতে?
দ্বীপঃ দাদা, দিয়াশলাই দিয়ে আগুন ধরানোর সময়ও দেখেছি ঘষা দিলে হঠাৎ করে আগুন ধরে যায় অথচ পূর্বে সেখানে কোন আগুনই ছিল না। তুমিই বিষয়টা পরিস্কার করে দাও আমাকে।
আমিঃ আগুন তথা অগ্নিতত্ত্ব সর্বত্র বিরাজমান আমরা যেমন বলি ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান অনেকটা তেমন।। আগুন প্রকাশিত না হওয়া অব্দি অস্তিত্বহীন।। আগুনও নিরাকার, আগুনকে স্পর্শ করা যায় না, আগুনকে ভেজানোও যায় না।। আগুনকে কেবল অনুভব করতে পারবে এবং দেখতেও পাবে কিন্তু সেজন্য আগুনকে ত প্রকাশিত হতে হবে নাকি অপ্রকাশিত কোন স্থানে আগুনের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারবে?
এবার চলো, অস্ট্রেলিয়ার বনভূমিতে আগুন প্রসঙ্গে আলোচনা করি।
দ্বীপঃ হ্যা দাদা, চলুন।
আমিঃ আমার স্পেসিফিক কিছু পর্যবেক্ষণ বলি তোমাকে। বিশাল বনভূমি, কোথাও আগুনের চিহ্নমাত্র নেই। হঠাৎ একদিন পাতার ঘর্ষণ কিংবা ডালের ঘর্ষণে আগুন ধরে গেলো।। সে আগুন ছড়িয়ে পড়লো সমগ্র বনভূমিতে।। একটু আগেও কালো অন্ধকার ছিল সমগ্র বনভূমি অথচ মূহুর্তেই আগুনের লেলিহান শিখায় সমগ্র বনভূমি আলোকিত হয়ে উঠল।। অর্থাৎ অন্ধকার বনভূমিতে আগুন ছিল না এই কথা সত্য নয় বরং উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে সেই অন্ধকারেই অগ্নিতত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে কেবল। আগুনের প্রকাশিত হওয়ার জন্য মাধ্যমেরও প্রয়োজন হয়েছে এখানে। আগুনের কোন নির্দিষ্ট আকার নেই কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশে সমগ্র বিশ্বও অগ্নিময় হয়ে উঠতে পারে আবার সমগ্র বিশ্বে কোথাও আগুনের প্রকাশ না থাকলেও কিংবা ছোট্ট একটা প্রদীপে সামান্য পরিমাণ আগুন প্রজ্জ্বলিত হলেও বিশ্বময় ব্যপ্ত আগুনের অপ্রকাশিত অংশের বিন্দুমাত্র তারতম্য হয় না।। আমাদের প্রয়োজনে আমরা আগুনের যথা ইচ্ছা ব্যবহার করতে পারি। একটা ছোট্ট প্রদীপে নিম নিম করে আগুন জ্বালালেও আগুনের সর্বব্যাপীতা ক্ষুন্ন হয় না। আগুন আমরা নিজেরাও প্রজ্বলন করি আবার আগুন নিজেই প্রকৃতিকে দগ্ধ করতে পারে।
দ্বীপঃ দাদা, আমার প্রশ্ন ত আগুন নিয়ে ছিল না।
আমিঃ ঈশ্বরকে তুমি দেখো নি কিন্তু আগুন দেখেছ তাই আগুনের প্রসঙ্গটা এলো।। ঈশ্বর নিরাকার, সর্বব্যাপী এবং অব্যক্ত।। কিন্ত তিনি যখন প্রকাশিত হন তখন তিনি ব্যাক্ত ও ব্যপ্ত হোন। তখন কিন্তু তিনি সাকার এবং এতে তাঁর সর্বব্যাপীতা বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় না। তিনি প্রকাশিত হতে অবশ্যই কোন একটা মাধ্যমের অবলম্বন করেন এবং সেটাই অবতারবাদ।। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটাই ঈশ্বরের স্ব ইচ্ছায় সম্পন্ন হয়।।
দ্বীপঃ কিন্তু মূর্তি পুজা কেন করতে হবে?
আমিঃ ভ্রাতা, আগুন জ্বালানোর কি প্রয়োজন? আমাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে আমরা অগ্নি প্রজ্বলন করি।। রান্না করতে, যজ্ঞ করতে, গৃহকে আলোকিত করতে অগ্নি প্রজ্বলন করি।। এই আগুনকে আমাদের প্রয়োজনে ব্যবহার জন্য আমরা সংরক্ষণও করি। আগুনকে সংরক্ষণ করতে অবশ্যই মাধ্যমের প্রয়োজন হয়।৷ একইভাবে আমরাও বিধি মাফিক মন্ত্র উচ্চারণ করে ঈশ্বরকে আহবান করি এবং মাধ্যম হিসেবে মূর্তি তথা বিগ্রহ প্রস্তুত করি।। উপযুক্ত পরিবেশ এবং প্রক্রিয়ায় যেমন যেকোনো জায়গায় অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়, একইভাবে উপযুক্ত ভক্তিতে যেকোনো বিগ্রহেও ঈশ্বর অধিষ্ঠিত হন।
দ্বীপঃ দাদা, অনেকেই ত নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করে।
আমিঃ ভ্রাতা, এটা যার যার নিজস্ব ভাব। আমি তাদের প্রত্যেকের ভাবকেও সম্মান করি।৷ ঈশ্বরের পরম সত্ত্বাকে অনুধাবন করতে পারলে আর কোনকিছুরই প্রয়োজন হয় না, তখন সর্বদাই (প্রতিটি মুহূর্তে) তাদের অন্তরে ঈশ্বর অনুভূত হয়, তখন তারা আর জাগতিক মোহে আবদ্ধ থাকে না, তখন সম্পুর্ন জাগতিক ভাবনা হতে তারা আলাদা স্তরে অবস্থান করে, তখন তারা সকল জাগতিক কামনাবাসনা হতে মুক্ত। কিন্তু জাগতিক ভাবনায় নিমজ্জিত আমার মত মানবের মনে ঈশ্বর ভাব প্রতিষ্ঠা করতে এবং মনকে একাগ্র করতে অবশ্যই মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। এজন্যই আমাদের বিগ্রহের প্রয়োজন হয়।।
দ্বীপঃ মূর্তি পুজা নাহয় করলে কিন্তু সাকারবাদ ও অবতারবাদ মান্য করার আবশ্যকতা কি?
আমিঃ ভ্রাতা, যাহা কোনদিন প্রকাশিতই হয় নি এবং হয় না, যাহার অস্তিত্ব অনুভবই করা যায় না তাহা আমি কেন মান্য করব? আমি জানি আগুন তথা অগ্নিতত্ত্ব সর্বত্র ব্যপ্ত আছে, সুপ্ত আছে। আমি এটাও জানি যে আগুন স্ব ইচ্ছায় কিংবা আমাদের প্রয়োজনে প্রকাশিতও হয়। আগুন প্রজ্জ্বলিত হতে এবং সংরক্ষণের জন্য মাধ্যমেরও প্রয়োজনও হয়।। যেটার অস্তিত্ব আমি অনুভব করতে পারি এবং যেই তত্ত্ব আমি উপলব্ধি করতে পারি সেটাই ত আমার কাছে মান্য তাই না?
দ্বীপঃ সামান্য অবতারে কিংবা মূর্তিতে ঈশ্বরকে অধিষ্ঠিত করলে ঈশ্বরের সর্বব্যাপীতা ত ক্ষুন্ন হয়।
আমিঃ যদিও এই বিষয়টা উপরে পরিস্কার করেছি তবুও আবার বলছি।। ধরো একটা মোমবাতি প্রজ্জ্বলিত করলে তাহলে কি সম্পুর্ন অগ্নিতত্ত্ব এই এক মোমবাতিতেই? অন্য কোথাও আর কোন মোমবাতি জ্বলবে না? আবার চাইলে এই একটা মোমবাতির অগুন দিয়েও সমগ্র জগতের সকল মোমবাতিকে প্রজ্জ্বলিত করা যাবে।। ঈশ্বরের বেলায় তেমন হবে না কেন?
দ্বীপঃ ধন্যবাদ দাদা।
আমিঃ নমস্কার ভ্রাতা। ঈশ্বর সকলের মঙ্গল করুক।।
©স্টিমন অনিক।
0 মন্তব্যসমূহ