ঈশ্বর নিরাকারের মাঝে সাকার





প্রথমেই বলে রাখি ঈশ্বর সাকার কথাটা শুনলেই কিছু লোক যারা ঈশ্বরকে অলীকে রূপান্তর করেছে তাদের মাথায় ঢুকে যায় সাধারণ মানুষদের মত আকার যে দেহের মেকানিজম আছে।ওরা ভাবে সাকার মানেই নির্দিষ্ট আকারের ঈশ্বর।ওদের মতে নিরাকার মানে কোনই আকার নেই(অলীক)।
ওরা এটা নিয়ে পয়েন্টভিত্তিক একটা পোস্টও করেছে যে ঈশ্বর সাকার হলে কী হবে..
কিন্তু অগোছালো লেখার কারনে পয়েন্ট করে আমি সেটা লিখতে পারব না যে ঈশ্বর কোনই আকারহীন হলে কি হবে।তবে এ নিয়ে কিছু আলোচনা করতে হলো ওদের বাচ্চাদের মত চিন্তাভাবনা দূরীকরণের জন্য।
★বেদ থেকে ওরা বলে যে ঈশ্বর রূপহীন কিন্তু সেটা কোন অর্থে বলা হয়েছে তার মর্ম বুঝার ক্ষমতা নেই ওদের।ঈশ্বর যদি রূপহীন হন সর্বগুনসম্পন্ন নন কারন ঈশ্বরের মধ্যে সমস্ত গুণ বিদ্যমান,, কোন গুণ বাদ নেই।
ওরা পোস্ট করেছিল ঈশ্বর সাকার হলে সর্বজ্ঞত্ব ক্ষুন্ন হবে।ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান হবেন না।এক স্থানে স্থিতিশীল হবেন।যদি তারা এমনটা ভেবেই থাকে তাহলে ওদের কথা অনুসারেও ঈশ্বর সর্বশক্তিমান নন কারন ঈশ্বর কি মানুষ যে সাকার হলেই সর্বব্যাপক হবেন না??
আসলে মেইন সমস্যাটা হচ্ছে ওদের চিন্তাভাবনায়।সাকার বললেই হাড্ডি,রক্ত সঞ্চালন তন্ত্র, শ্বাস সংবহন তন্ত্র ইত্যাদি সাধারণ মানুষদের মত ঈশ্বরকে কল্পনা করে নেয়।কিন্তু ঈশ্বরের রূপ যে জ্যোতির্ময়,, চিন্ময়,,সচ্চিদানন্দ সে তত্ত্ব জানতে ওরা অপরাগ।
<>এবার আসি নিরাকার তত্ত্বের কথায়।নিরাকার বললেই ওরা ভাবে কোনই আকার নেই।তখন ওরা বেদের কিছু রেফারেন্স দেয় যেখানে শরীররহিত বলা হয়েছে। কিন্তু এখানে শরীররহিত কথাটি দ্বারা সাধারণ মানুষের মতো মেকানিজমযুক্ত শরীর যে নয় সেটা বুঝাচ্ছে।জড়াপ্রকৃতির নয় সেটা বুঝাচ্ছে।একটা সাধারণ মানুষের যেমন মেকানিজম রয়েছে ঈশ্বরের তেমন নেই।নিরাকার অর্থ যদি আকারহীন ধরা হয় তাহলে বলতে হবে সে ঈশ্বর না,সে অলীক অবাস্তব।মূলত নিরাকার মানে নির্দিষ্ট আকারহীন,যে আকারের কোন নির্দিষ্টতা নেই,যে আকারের আদি মধ্য অন্ত কিছুই দেখা যায় না,,যে আকার অসীম।সেই আকারকে কোন কিছু দিয়ে মাপা যায় না,,চোখের মধ্যে ধারন করা যায় না কারন সেটা অসীম।সেই অনির্দিষ্টক অসীম আকারকে নিরাকার বলে।এইই কথা অর্জুন স্পষ্ট করে দিয়েছেন কৃষ্ণের বিরাট রূপ দেখে।গীতার ১১/১৬ তে তিনি কৃষ্ণের এই রূপ দেখে বলেছিলেন,"হে বিশ্বেশ্বর!হে বিশ্বরূপ!অসংখ্য হাত,অসংখ্য উদর,চোখ,মুখ বিশিষ্ট অনন্তরূপ তোমাকে সকল দিকেই দেখতেছি কিন্তু আদি মধ্য অন্ত কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।"অর্থাৎ ঈশ্বরের রূপের ব্যপ্তি এতটা বিশাল এতটা আশ্চর্যজনক যে সেই আকারকে নির্দিষ্ট আকারে বাধা যায় না।এই রূপ সাধারণ মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব না কারন তা তাদের চোখের সীমানায় ধরবে না আআর সহ্য করতে পারবে না,, গীতার ১১/২০ এ অর্জুন বলেছেন,,"তুমি সকল দিক ব্যাপিয়া রহিয়াছ।তোমার ঐ উগ্ররূপ দেখিয়া আমি ভীত হইতেছি।"তাই এই বিরাট অসীম রূপ অর্জুন দিব্য চোখ দিয়েও সহ্য করতে না পারায় কৃষ্ণ আগের মত চতুর্ভুজ মূর্তি ধারন করলেন।কিন্তু ওদের কথা অনুসারে এরকম না হয়ে যদি নিরাকার মানে আকারহীন হত তাহলে ঈশ্বর আকারের ক্ষেত্রে অসীম নন যেহেতু আকার বলতে কিছুই নেই তাহলে তার ক্ষেত্রে অসীম কথাটা অপ্রাসঙ্গিক অর্থাৎ এই দিকে ঈশ্বরের অসীমত্ব ক্ষুন্ন হয়।
<>আবার রূপহীন বললেই ওরা ভাবে কোনই রূপ নেই।কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই রূপহীন শব্দটা দ্বারা নির্দিষ্ট রূপহীন বুঝাচ্ছে।অর্থাৎ ঈশ্বরের রূপের নির্দিষ্টতা নেই কারন তিনি অনন্ত রূপের অধিকারী।কোন নির্দিষ্ট রূপের(সসীম রূপ)মধ্যে সীমাবদ্ধ নন।ঈশ্বরের রূপ অসীম অনন্ত।বেদান্তে যে রুপহীনের কথা বলা হয়েছে সেটা দিয়ে ঈশ্বর যে জড়প্রকৃতির রূপধারী নন সেটা বুঝাচ্ছে তাই তো ঈশ্বরকে রূপহীন বলে আবার রূপের বর্ননাও দিয়েছে কিন্তু চিন্ময় রূপের বর্ননা দেওয়া হয়েছে। ব্রহ্মের রূপ হরিদ্রারঞ্চিত,বসনের মতো পীতবর্ণ,মেঘলোমের মতো রক্তবর্ন,অগ্নিশিখার মতো,ইন্দ্রগোপের কীটের মতো রক্তবর্ন,শ্বেতপদ্মের মতো এবং চমকিত বিদ্যুতের মতো,,,(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২/৪/৬)।এতে স্পষ্ট যে রূপহীন শব্দটার ক্ষেত্রে রূপের কথা বলতে জড় রূপের কথাই বেদে বলা হয়েছে।
এক্ষেত্রেও যদি ওরা বলে রূপহীন বলতে কোনই রূপ নেই বুঝায় তাহলে রূপের দিক দিয়েও ঈশ্বরের অসীমত্ব ক্ষুন্ন হবে কারন ওদের ধারনা অনুযায়ী ঈশ্বরের যেহেতু কোন রূপই নেই তাহলে সেক্ষেত্রে অসীম শব্দটা হাস্যকর ছাড়া আর কিচ্ছুই নয়।এই দিক দিয়েও ওদের ঈশ্বর সর্বগুনসম্পন্ন নন।।
★ওরা বলে থাকে যে ঈশ্বর সাকার হলে তিনি সর্বব্যাপক নন কারন তিনি এক স্থানে সীমাবদ্ধ। এই কথা বলার কারন হলো ওদের চিন্তাভাবনাটাই বাচ্চাদের মতো,,নির্দিষ্ট একটা ছোট্ট সীমার ভিতর আবদ্ধ।তবে এখন ওদের এই বাচ্চাদের মত কথায়ও বুঝা যায় ওদের ঈশ্বর সর্বগুনসম্পন্ন নন। ঈশ্বর একস্থানে থাকেন কে বলল??ঈশ্বরের আকার মানেই কি মানুষের মতো এক স্থানে সীমাবদ্ধ যে তিনি ব্রহ্মাণ্ড চালাতে পারবেন না?
★ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। সূর্য যেমন সাকার তেমনি এই সূর্যটাই পুরো পৃথীবিকে আলোকিত করে।এর থেকে নিঃসৃত রশ্মিগুলো হল নিরাকার কারন এটা অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত যার নির্দিষ্টতা নেই,,চোখে ধারন করা যায় না।কিন্তু সেই উজ্জ্বল সূর্যের রশ্মিগুলি দ্বারাই পৃথিবী আলোকিত হয়।রশ্মি দ্বারা আলোকিত হলেও আমরা কিন্তু সেই সূর্যকে কেন্দ্র করেই বলি সূর্যের দ্বারা আলোকিত হয় কারন সমস্ত রশ্মির কেন্দ্রস্থল,উৎপত্তিস্থল হল সূর্য।ঠিক তেমনি ঈশ্বরের সাকার রূপ হলো চিন্ময়, জ্যোতির্ময়,সচ্চিদানন্দ যা পুরো ব্রহ্মান্ডকে আলোকিত করে।এর থেকে যে ব্রহ্মজ্যোতি বের হয় তা অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত।ঈশ্বরের ব্রহ্মজ্যোতি আর অসীম আকার ও রূপের কেন্দ্রস্থল হল সেই চিন্ময় সাকার রূপ।তাই ব্রহ্মজ্যোতি দ্বারা আলোকিত হওয়া মানেই সেই চিন্ময় সাকার রূপ দ্বারা আলোকিত হওয়া।
★তাহলে ওদের কথা অনুসারে ওদের ঈশ্বর সর্বগুনসম্পন্ন তো??যেহেতু ওরা ভাবে ঈশ্বরের কোন রূপই নেই আকারই নেই তাহলে এসবের ক্ষেত্রে অসীম কথাটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়াবে।তাহলে ঈশ্বরের অসীমত্বও দুইটা গুণের ক্ষেত্রে কম পড়ে যায় যা ঈশ্বরের কোন ধর্মই নয়।
এবার আপনাদের(আকারহীন নামক অলীক ঈশ্বরে বিশ্বাসী)উদ্দেশ্যেই ছোট একটা প্রশ্ন,, আপনারা ওঁ জপ করে ধ্যানে বসলে হৃদয়ে ঈশ্বরকে কি রূপে ধারন করেন??অবশ্যই কোন রূপ বা ইমেজ আসতে হবে কারন মানুষ কোন ইমেজের চিন্তা ছাড়া ১ সেকেন্ডও থাকতে পারে না।ঈশ্বর সাকারের মাঝে নিরাকার কিন্তু কেউ কেউ নিরাকারের সঠিক ব্যাখ্যাই পালটে দিচ্ছে।তাদের মতে নিরাকার মানে আকারহীন অর্থাৎ কোনই আকার নেই অথচ এরা ধ্যানে বসলে কোন ঈশ্বরের রূপ যে হৃদয়ে ধারন করে সেটা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।

★নিরাকার মানে নির্দিষ্ট আকারহীন নির্দিষ্ট রূপহীন,,কখনো আকারহীন নামক অলীক নয়

------------------ সৃজ্জ রায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ