"প্রতিমা" শব্দ নিয়ে অবৈদিকদের অপপ্রচার খণ্ডন


প্রতিমা নিয়ে অবৈদিকদের অপপ্রচার খণ্ডন

পর্ব-১ 

ইদানীং হিন্দুদের প্রতিমা পূজা নিয়ে ঘরেবাইরে নানারকম অপ-প্রচার চলছে।

আজকাল অনেকেই বেদ ও গীতায় প্রতিমা পূজা বিরোধী মন্ত্র/শ্লোক খুঁজে পাচ্ছে শব্দের অনর্থ/কদর্থ করে। এই সংক্রান্ত অপপ্রচারটা সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে লাউডলি করেছিল ভারতের এক অন্য ধর্মীয় প্রচারক। সেখানে সে একটি বেদমন্ত্রের খণ্ডিতাংশ "ন তস্য প্রতিমা অস্তি"-এর (যজুর্বেদ ৩২/৩) প্রতিমা শব্দটি নিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, পরমেশ্বরের কোন প্রতিমা বা মূর্তি নেই। অতঃপর এই একটা মিথ্যাচার দিয়ে সে হিন্দুদের বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে পরমেশ্বরের যেহেতু কোন প্রতিমা বা মূর্তি নেই তাই হিন্দুরা প্রতিমা পুজা করে পাপ করছে এবং ঈশ্বরের সাথে শিড়ক করছে। 


কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কি জানেন? 


আজকাল কিছু হিন্দু নামধারী ছুঁপা অবৈদিক ব্যক্তি  আরও একধাপ এগিয়ে বেদমন্ত্রের অপব্যাখ্যা দিয়ে

প্রতিমা পূজার বিরোধিতা করছে। এরা একদিকে তারা প্রতিমা ভাঙার নিন্দা  করে সাধারণ হিন্দুদের পকেট

থেকে টাকা খসিয়ে নিজেদের পকেট ভরছে এবং অন্য দিকে প্রতিমা পূজা বিরোধী একটি ন্যারেটিভ

ক্রিয়েট করছে।  


মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। এই যে উক্ত যজুর্বেদ সংহিতার উপরোক্ত মন্ত্রে "প্রতিমা" অর্থ যে মূর্তি এবং পুরো

বাক্যের অর্থ ঈশ্বরের কোন মূর্তি নেই এই অর্থ ছু্ঁপা অবৈদিকগুলো পেল কোথায়? সত্যান্বেষণে বেড়িয়ে

এল আসল সত্য। 


পণ্ডিত ও বিশিষ্ট তার্কিক দয়ানন্দজ্বী তার একটি বই লিখেছেন "সত্যার্থ প্রকাশ" নামে পরিচিত। সে বইয়ে

তিনি একটা চমৎকার উক্তি করেছেন যে নারী-পুরুষ একত্রে মন্দিরে গেলে নাকি ব্যাভিচার হয়! একই

বক্তব্য কোন সম্প্রদায়ের মানুষ নারীদের জন্য ব্যবহার করে তা ত অবশ্যই জানেন। 


কি, এখানে অপপ্রচারকারীদের গন্ধ পাচ্ছেন?


এই বইটিতেই তিনি গঙ্গাস্নান নিয়ে অপশব্দ এবং গজনীর সুলতান মাহমুদ কর্তৃক সোমনাথ মন্দির ধ্বংস

করা ও  লুটের প্রশংসা করেছেন। (১১শ সমুল্লাস, সত্যার্থ প্রকাশ)


এই বইটি আদ্যোপান্ত সকলকে পড়ে দেখার অনুরোধ রইলো তাহলে হাজার বছর ধরে চলে আসা হিন্দু

সংস্কার, সংস্কৃতি ও আচারসমূহ নিয়ে উনার চিন্তাধারা নিয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা পাবেন। উনার কতিপয়

ভালোকাজের প্রশংসা আমরাও করবো কিন্তু তার স্বেচ্ছাচারী কার্যাদির সমালোচনাও করতে হবে কারণ

তিনি কোন মন্ত্রদর্শী ঋষি নন তাই তিনি শতভাগ অভ্রান্ত নন।


উনার এই বইয়েই শুক্লযজুর্বেদ সংহিতার ৩২ অধ্যায়ের ৩নং মন্ত্রের উদ্ধৃতি দেন এবং অর্থ করেন।

"ন তস্য প্রতিমা অস্তি" 

অর্থাৎ যিনি সমস্ত জগতে ব্যাপক সেই নিরাকার পরমাত্মার প্রতিমা, পরিমাণ, সাদৃশ্য অথবা মূর্তি নেই। 

(সত্যার্থ প্রকাশ, বঙ্গ আসাম আর্য প্রতিনিধি সভা, আশ্বিন ১৩৫৩ সংস্করণ, পৃষ্ঠা নং -৩৪১)


এটি পণ্ডিত ও বিশিষ্ট তার্কিক দয়ানন্দজ্বীকৃত ভাষ্য (!) ও অনুবাদ।


যদিও বইটি হিন্দী থেকে বাংলা করা তবে হিন্দীতেও একই জিনিস রয়েছে। বইটি যদিও উনার অনুপস্থিতিতেই

কয়েক দফা সংস্কার করা হয়েছে তথাকথিত বিশুদ্ধতার নামে৷ একটি বিশেষ সমাজ বা সংগঠনের কাছে

বিশুদ্ধতার ফিল্টার মেশিন আছে যা দিয়ে তারা নিজেদের মান্য বৈদিক আচার্য্যদের ভাষ্য বা ব্যাখ্যাও

বিশুদ্ধতার নামে বদলে দেয়।


যাইহোক যাস্কের নিরুক্তে কিন্তু এই  প্রতিমা শব্দের অর্থ "তুলনীয়" এবং এই অর্থেই যাস্ক শব্দটিকে গ্রহণ করেছেন। বেদের মন্ত্রভাষ্য করার সময় সেটা নিরুক্তসম্মত অর্থ করাই কিন্তু সমীচীন। 


ঋগ্বেদের সংহিতা ভাগের  ১০ম মণ্ডলের ৮৯ নং সুক্তের ৫ নং ঋকে "প্রতিমা " শব্দটি রয়েছে। সেখানে 

"প্রতিমানানি দেভুঃ" রূপে শব্দটির প্রয়োগ হয়েছে। 


এই "প্রতিমানানি" শব্দের অর্থ আসলে কি সেটি আমরা বুঝতে পারি নিরুক্তের ৫ম অধ্যায়ের ১২ নং

পরিচ্ছেদ দেখে। সেখানে বলা হয়েছে, 


"নার্বাগিন্দ্রং প্রতিমানানি দভ্নুবন্তি, যৈরেনং প্রতিমিমতে নৈনং তানি দভ্নু বন্তি, অর্বাগেবৈনমপ্রাপ্য

বিনশ্যন্তীতি।।" (নিরুক্ত ৫/১২/১২)


শ্রদ্ধেয় অমরেশ্বর ঠাকুর তাঁর নিরুক্তে এটির শব্দ ধরে ধরে বিশ্লেষণ করেছেন। এটির বিশদার্থ নিম্নরূপঃ


যার সাথে কোন বস্তুর তুলনা করা হয় তা উপমান; যে বস্তুর তুলনা করা হয় তা উপমেয়। চন্দ্র উপমান, 

মুখ উপমেয়। সবসময়ই উপমেয় থেকে উপমানের শ্রেষ্ঠতা থাকে। ইন্দ্র সর্বশ্রেষ্ঠ,  কাজেই তাঁর উপমান

কিছুই হতে পারে না। যা কিছু ইন্দ্রের উপমান রূপে কল্পিত হয়, সেসকলই ইন্দ্র হতে হীনগুণ বলে প্রতিপন্ন হয়। গুণে তারা ইন্দ্রের সন্মুখীন হতে পারে না, কাজেই তারা উপমান ভাব পরিত্যাগ করে। এই যে উপমানসমূহের উপমান ভাব পরিত্যাগ, এটিই তাদের বিনাশ। 


সামান্যতম বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ মাত্রই বুঝবেন এখানে যাস্ক "প্রতিমা" শব্দের অর্থ উপমান বা তুলনা

অর্থে করেছেন, মূর্তি অর্থে করেননি। 


শুধু তাই নয়,  নিরুক্তের ১১ তম অধ্যায়ের ২১নং পরিচ্ছেদে ঋগ্বেদ সংহিতার ১০ম মণ্ডলের ১২০ নং

সুক্তের ৬ নং ঋকে উল্লিখিত "প্রতিমানানি" পদের ব্যাখ্যায় যাস্ক বলেন,


"স্তোতব্যং বহুরূপমরুভূতমীশ্বরতমমাপ্তব্যমাপ্তব্যানাম্, আদৃণাতি যঃ শবসা বলেন

সপ্তদাতৃনিতি বা সপ্তদানবানিতি বা, প্রসাক্ষতে প্রতিমানানি বহূনি, সাক্ষতিরাপ্নোতিকর্ম্মা।"


শ্রদ্ধেয় অমরেশ্বর ঠাকুর খুব সুন্দর ভাবে শব্দ ধরে ধরে এখানে ব্যাখ্যা করেছেন।


স্তোতব্যম্ = স্তুত্যর্হ বা স্তুতিযোগ্য

বহুরূপম্= বহুরূপধারী 

উরুভূতম্ = বিস্তীর্ণ বা মহান

ঈশ্বরতমম্ = প্রকৃষ্ট বা শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্যশালী 

আপ্তব্যম্ আপ্তব্যনাম্ = আপ্ত্য অর্থাৎ আপ্তব্য ঋষিগণের প্রাপ্তব্য

আদৃণাতি= বিদীর্ণ করেন

যঃ = যে 

শবসা বলেন = শবসা শব্দ বলবাচী ( নিঘন্টু ২/৯)

সপ্তদাতৃন্ = সপ্ত জলপ্রদা মেঘ 

বা= অথবা

সপ্তদানবান্ = নমুচি প্রভৃতি সপ্ত দানব 

প্রসাক্ষতে প্রতিমানানি বহূনি= বহু উপমানকে অভিভূত করেন 

সাক্ষতিঃ আপ্নোতিকর্ম্মা = সাক্ষ্ ধাতু আপ্ত্যর্থক বা ব্যাপ্ত্যর্থক


অর্থাৎ ইন্দ্রের উপমান স্থানীয় যদি কেউ থাকেন, তাকেও ইন্দ্র অভিভূত করেন কারণ প্রকৃতপক্ষে তাঁর

কোন উপমান বা প্রতিমা (তুল্য) নেই- এমনটাই যাস্কের মত। 


উপরে উল্লেখিত মন্ত্রদুটি যেন, "ন তস্য প্রতিমা অস্তি" - এই বেদবাক্যেরই প্রতিধ্বনি। বিচক্ষণ পাঠকমাত্রই

তা অনুভব করবেন। 


উপরের আলোচনা থেকে, আমরা আপাতত এতটুকু পরিস্কার যে যাস্ক প্রতিমা অর্থে উপমানই অর্থ

করেছেন। মূর্তি বা প্রতিকৃতি অর্থ এখানে প্রযোজ্যই নয়। "ন তস্য প্রতিমা অস্তি" বাক্যের অর্থ তাই প্রাসঙ্গিকভাবেই এমন হবে যে ঈশ্বরের তুল্য কেউ নেই। 


আপাতত প্রতিমা পূজা বিরোধী ছুঁপা অবৈদিকদের বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে হাজার বছরের

সনাতন বৈদিক পরম্পরায় চলে আসা সনাতন সংস্কৃতি ও সংস্কার সম্পর্কে নিজে অধ্যয়ন করুন এবং

প্রকৃত সত্যমিথ্যা যাচাই করুন। অপপ্রচারকারীদের অন্ধ অনুসরণে নিজের সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে

একটি বিশেষ সমাজ বা সংগঠনের আজ্ঞাবহ হবেন কিনা!


সিদ্ধান্ত আপনার। 


 


পর্ব-২


"প্রতিমা পূজা" বিরোধী অপপ্রচার বাস্তবায়নে বেদমন্ত্রকে উপজীব্য করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে

অর্থবিকৃতি চলমান। প্রথম পর্বে আমরা নিরুক্ত ও নিঘন্টু হতে দেখিয়েছি যে শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার ৩২/৩

মন্ত্রে 'প্রতিমা' অর্থ কোনভাবেই মূর্তি নয় অর্থাৎ অপপ্রচারকারীরা যেটা বলে যে "ঈশ্বরের কোন মূর্তি নেই"

তথা প্রতিমা বানানো যাবে না তা সম্পূর্ণভাবে তাদের মিথ্যচারের অংশ। 

আজকে আমরা পাণিনীয় অষ্টাধ্যায়ীসহ আরও কিছু জায়গা হতে এই বিষয়ের বিশ্লেষণ করবো। 'প্রতিমা'

শব্দের অর্থ মূর্তি দেখাতে যব** সমাজ বহুল প্রচলিত সংস্কৃত অভিধান "অমরকোষ বা অমরার্থ চন্দ্রিকা"র

আশ্রয় নেয়। এই গ্রন্থখানি রচনা করেছিলেন উজ্জয়িনীর মহারাজ বিক্রমাদিত্যের সভার নবরত্নের

অন্যতম রত্ন মহামতি অমরসিংহ। 

অমরকোষের ২য় কাণ্ডে শূদ্রবর্গে প্রতিমা শব্দের অর্থে বলা হয়েছে, 

"প্রতিমানং প্রতিবিম্বং প্রতিমা প্রতিযাতনা প্রতিচ্ছায়া।প্রতিকৃতিরর্চ্চা পুংসি প্রতিনিধি।" (২য় কাণ্ড, শূদ্রবর্গঃ, ১০০) 

অর্থাৎ মৃত্তিকা (মাটি) দ্বারা নির্মিত প্রতিমার নাম - প্রতিমান, প্রতিবিম্ব (ক্লীব লিঙ্গ), প্রতিমা, প্রতিযাতনা, প্রতিচ্ছায়া, প্রতিকৃতি, অর্চ্চা (স্ত্রী লিঙ্গ), প্রতিনিধি (পুং লিঙ্গ)। 

তাহলে আমরা বর্তমানে প্রতিমা বলতে যে প্রচলিত মাটির মূর্তি পাই সেই অর্থ অমরকোষে পাওয়া যাচ্ছে।

এখন একটি বড় প্রশ্ন হল, যখন যজুর্বেদ সংহিতার অন্তর্গত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৪র্থ অধ্যায়ের ১৯ নং

মন্ত্র) পড়ি সেখানেও শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার ৩২/৩ মন্ত্রের মতোই একটা মন্ত্র পাই যেখানে আছে, "ন তস্য

প্রতিমা অস্তি"। 

প্রাচীন ভাষ্যকার গণ এই "প্রতিমা" শব্দের অর্থ "উপমা বা তুলনা" করেছেন। এই মন্ত্রে উল্লেখিত "প্রতিমা" শব্দের উপযুক্ত অর্থ কি হবে সেটা বের করতে আমরা বেদাঙ্গকেই প্রামাণ্য ধরবো। কারণ বেদ পাঠের সহায়ক গ্রন্থগুলোকে বলা হয় বেদাঙ্গ। এ প্রসঙ্গে মুণ্ডকোপনিষদে (১ম মুণ্ডক, ১ম খণ্ড, ৫নং মন্ত্র) বলা হয়েছে, 

"তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোহথর্ববেদঃ শিক্ষা কল্পোব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষমিতি।

অর্থাৎ ঋক, সাম, যজুঃ, অথর্ব - এই চারবেদ; শিক্ষা অর্থাৎ বর্ণের উচ্চারণ, কল্পসূত্র, ব্যাকরণ, নিরুক্ত

অর্থাৎ বেদে যে শব্দ আছে তাদের প্রকৃত অর্থ, ছন্দ আর জোতির্বিজ্ঞান নিয়ে যে ছয় বেদাঙ্গ - এগুলো

হল পরাবিদ্যা। এই বেদাঙ্গগুলোর মধ্যে ব্যাকরণ ও নিরুক্তের স্থান অতি উচ্চ।

নিরুক্ত থেকে প্রথম পর্বে আলোচনা হয়েছে, এই পর্বে আলোচনা করবো ব্যকরণ থেকে। ব্যাকরণের জগতে

মহর্ষি পাণিনি যেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে অবস্থান করছেন। তাঁর প্রায় চার হাজার সূত্র নিয়ে রচিত

অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে বৈদিক বাঙ্ময়ের ব্যাকরণগত শৃঙ্খলা খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। 

অষ্টাধ্যায়ীর ৫/৩/৯৯ সূত্র বলা হয়েছে, "জীবিকার্থে চাপণ্যে।" 

অর্থাৎ জীবিকা উপার্জনের জন্য কিন্তু বিক্রীর অযোগ্য অর্থ বুঝালে 'কন্' প্রত্যয়ের লুক্ হয়। এটি বিধিসূত্র। এই সূত্রটির বিস্তৃত ব্যাখ্যায় যাওয়া যাক।


মহর্ষি পাণিনীর সময় (আনুমানিক ষষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) দেবমূর্তি বিক্রয় করা হত। আবার আরেকদল লোক

দেবমূর্তিকে জীবিকার্থে ব্যবহার করত কিন্তু বিক্রয় করত না। তাই পাণিনি বলেছেন, যেসব দেবতার

প্রতিকৃতি জীবিকার্থে ব্যবহৃত হয় কিন্তু বিক্রি করা হয় না, সেই সকল দেবতাবাচক শব্দের শেষে কন্ প্রত্যয়

হয় না। কিন্তু যদি বিক্রির জন্য হয়, তখন কন্ প্রত্যয় হবে। 

এই সূত্রের ভাষ্যে মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি বলেছেন,

 (সূত্রাদাহরণপ্রদর্শকভাষ্যম্) 

"অপণ্যে ইত্যুচ্যতে, তত্রেদং ন সিধ্যতি - শিবঃ, স্কন্দঃ, বিশাখ ইতি। কিম্ কারণম্? মৌর্যর্হিরণ্যার্থিভিরর্চাঃ প্রকল্পিতাঃ। ভবেন্তাসু ন স্যাত্। যাস্ত্বেতাঃ সম্প্রতিপূজার্থস্তাসু ভবিষ্যতি।।" 

অর্থাৎ পাণিনির এই সূত্রের উদাহরণ প্রদান করা হচ্ছে। এখানে অপণ্য অর্থাৎ যা বিক্রয় করা হবে না, তার উল্লেখ রয়েছে। যেমন, শিবঃ, স্কন্দঃ, বিশাখ ইত্যাদি। কারণ মৌর্যরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেবমূর্তি প্রদর্শন করে হিরণ্য (সোনা) বা অর্থসম্পদ প্রার্থনা করে জীবিকা নির্বাহ করত। 

সিদ্ধান্ত কৌমুদীতে আরও সুন্দর করে বলা হয়েছে, 

"জীবিকার্থ যদবিক্রীয়মাণং তস্মিবন্বাচ্যে কনো লুপ্স্যাত্। বাসুদেবঃ শিবঃ।স্কন্দঃ। দেবলকানাং জীবিকার্থাসু দেবপ্রতিকৃতিষ্বিদম্।অপণ্যে কিম্। হস্তিকান্বিক্রীণীতে।।

অর্থাৎ যেসব দেবতার প্রতিকৃতি জীবিকার্থে ব্যবহৃত হয় কিন্তু বিক্রয় করা হয় না, সেসব দেবতাবাচক শব্দের শেষে কন্ প্রত্যয় হয় না। যেমন বাসুদেবঃ শিবঃ স্কন্দঃ (পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হলে কন্ প্রত্যয় হত যথা বাসুদেবকঃ ইত্যাদি)। 

দেবল ব্রাহ্মণেরা দেবমূর্তিকে অবলম্ববন করে জীবিকা নির্বাহ করত। 

অপণ্য কেন বলা হল? 

কারণ মেলায় যেমন হস্তির (হাতির) প্রতিকৃতি বিক্রী হয়, সেরকম ভাবে এগুলো বিক্রি হয় না। তাহলে

আমরা বুঝলাম বাসুদেবঃ শিবঃ স্কন্দঃ অর্থাৎ দেবতাদের নামের শেষে কন্ প্রত্যয়ের লুক করেই তাদের

মূর্তি বোঝানো হত।

ঋগ্বেদের ১০ মণ্ডলের ১৩০ নং সূত্রের ৩ নং ঋকে "প্রতিমা" শব্দের উল্লেখ আছে। সায়ণাচার্য তাঁর ভাষ্যে এই প্রতিমা শব্দের অর্থ করেছেন "দেবতা"। তিনি প্রতিকৃতি বা মূর্তি অর্থ করেননি ( ইতি প্রতিমা দেবতা অর্থাৎ এখানে প্রতিমা অর্থ দেবতা)। 


যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় ১৩ অধ্যায়ের ৪১ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে, "সহস্রস্য প্রতিমাং বিশ্বরূপম্।"

অর্থাৎ এই জগত আদিত্যের প্রতিমাভুত; মানে, সারা জগতেই যেন আদিত্যের বিস্তার। এখানেও প্রতিমা

অর্থ মূর্তি নয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, পাণিনি মূর্তি অর্থে প্রতিমা শব্দের ব্যবহার করেননি। তাহলে বৈদিক

সাহিত্যে "প্রতিমা" শব্দের আসল অর্থ কি?

এ সম্পর্কে আমরা যাস্কের মতকেই প্রামাণ্য ধরবো। ঋগ্বেদের ১০ মণ্ডলের ৮৯ সুক্তের ৫ নং ঋকে

"প্রতিমানানি" শব্দ আছে। 

এই শব্দের ব্যাখ্যায় যাস্ক তাঁর নিরুক্তে (৫/১২/১২) বলেছেন, 

"নার্বাগিন্দ্রং প্রতিমানানি দভুবন্তি, যৈরেনং প্রতিমিমতে নৈনং তানি দভ্নুবন্তি, অর্বাগেবৈনমপ্রাপ্র বিনশ্যন্তীতি।।"

অর্থাৎ যার সাথে কোন বস্তুর তুলনা করা হয়, তা উপমান। যে বস্তু তুলিত বা উপমিত হয় তাহা উপমেয়। সবসময় উপমেয় থেকে উপমানের শ্রেষ্ঠতা থাকে। ইন্দ্র সর্বশ্রেষ্ঠ, কাজেই তাঁর কোন উপমানই থাকতে পারে না। যা কিছু ইন্দ্রের উপমানরূপে কল্পিত হয়, তা ইন্দ্র থেকে হীনগুণ বলে প্রতিপন্ন হয়। কাজেই তারা উপমান ভাব ত্যাগ করে বিনাশপ্রাপ্ত হয়। এখানে যাস্ক "প্রতিমানানি" শব্দের অর্থ করেছেন, তুলনা করা।

ঋগ্বেদের ১০/১২০/৬ এও "প্রতিমানানি" শব্দ রয়েছে।এই শব্দের ব্যাখ্যায় যাস্ক তাঁর নিরুক্তের ১১.২১.২

এ বলেছেন, 

"প্রসাক্ষতে প্রতিমানানি বহূনি, সাক্ষাতিরাপ্নোতিকর্ম্মা।।"

অর্থাৎ এখানে বলা হয়েছে, বহু উপমানকে পরিব্যাপ্ত বা অভিভূত করার কথা। এখানেও উপমান বা তুলনা অর্থে যাস্ক প্রতিমানানি শব্দের অর্থ করেছেন। 

এখন প্রশ্ন হল, অমরকোষে প্রতিমা, প্রতিমানানি অর্থ মৃত্তিকা নির্মিত অর্থ করলেও বেদ সংহিতায় এর অর্থ

ভিন্ন কেন? 

এর উত্তর দিয়েছেন মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি। তিনি তাঁর ব্যাকরণ মহাভাষ্যের পস্পণাহ্নিকে বলেছেন,

"কেষাং শব্দানাম্? লৌকিকানাং বৈদিকানাং চ।

অর্থাৎ শব্দ সমূহ দুই ধরণের লৌকিক ও বৈদিক। বৈদিক শব্দ আর লৌকিক শব্দের অর্থ এক হবে না। তাই প্রতিমা শব্দের অর্থ অমরকোষ অনুযায়ী মৃত্তিকাদি নির্মিত প্রতিকৃতি হলেও বেদের ক্ষেত্রে এই অর্থ

প্রযুক্ত নাও হতে পারে। ভিন্ন অর্থও হতে পারে যেমনটি আমরা উপরে আলোচনা করলাম। তাছাড়া

প্রাচীনকালে 'পঙ্কজ' শব্দের অর্থ ছিল যা কিছু পঙ্কে জন্মে সেই সবকিছু যথাঃ শাপলা, পদ্ম সবকিছুই। কিন্তু

বর্তমানে 'পঙ্কজ' অর্থ কেবলই পদ্মফুল। এজন্য অমরকোষের যুগের অর্থ দিয়ে বৈদিক যুগের অর্থকে

প্রতিষ্ঠা করা যায় না।


© SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি (বেদ ও বেদান্ত বিভাগ)

সনাতনী শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।।

Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ