🟠 লোকাচার/দেশাচারের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা।


 🟠 লোকাচার/দেশাচারের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা।

🔹 ভূমিকাঃ

সনাতন সংস্কার ও সংস্কৃতিতে দুই ধরনের আচার প্রচলিত। 

১/ বৈদিক আচার

২/ লোকাচার/দেশাচার/কুলাচার 

বৈদিক আচারগুলো সম্পূর্ণ শাস্ত্রানুযায়ী পালিত হয় যা সব অঞ্চল, দেশ ও জাতীতে অনাদিকাল থেকে একই রকম। অন্যদিকে লোকাচার বা দেশাচারগুলো একেক অঞ্চলে, দেশে এমনকি কুল পরম্পরায়ও ভিন্ন ভিন্ন হয়। কখনও কখনও বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতির উপর প্রয়োজনীয়তার ভিত্তি করেও লোকাচারগুলো গড়ে উঠে যা সে-ই অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতি হিসেবে পরবর্তীতে এগিয়ে যায়। সনাতন সংস্কৃতিতে লোকাচারগুলো মূলত জনহিত, প্রকৃতি ও জীবের কল্যাণের উদ্দেশ্যেই তৈরী করা হয়ে থাকে। তবে শ্রুতি ও স্মৃতি বিরুদ্ধ তথা প্রকৃতি ও জীবের জন্য অহিতকর কোন লোকাচার বা দেশাচার কোনভাবেই মান্য নয়। সনাতন সংস্কৃতিতে কিছু লোকাচার সম্পূর্ণ প্রকৃতিকেই কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এর কারণ হলো প্রকৃতি থেকেই এই জীবকুলের সৃষ্টি এবং আমৃত্যু এই প্রকৃতির উপরই নির্ভরশীল৷ প্রকৃতির উপর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বিভিন্ন অঞ্চলে নানান লোকাচার বা দেশাচার দেখা যায় যা প্রত্যক্ষ ও  পরোক্ষভাবে প্রকৃতি ও জীবজগতকে সংরক্ষণের তাগিদ দেয়। এইজন্য যদি কেউ সনাতনীদের প্রকৃতি পূজারিও বলে তবে তাতেও লজ্জিত হওয়ার কিছুই নেই। যে গাছ আমাকে খাদ্য, ছায়া ও অক্সিজেন দিচ্ছে আমি সে গাছের পূজা করতেই পারি। পূজা করা আর উপাসনা করা এক অর্থ নয়৷ আমরা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ পিতামাতার পূজাও করি। এটাই সনাতন সংস্কৃতির বিশালতা। 

⭕ লোকাচার কি মান্য❓ শাস্ত্র এই বিষয়ে কি বলছে❓

লোকাচার বা দেশাচার অবশ্যই পালন করতে হবে যদি সে লোকাচার বা দেশাচার শ্রুতি ও স্মৃতি শাস্ত্রের বিরুদ্ধে না যায়। মূলত শ্রুতি শাস্ত্রে লোকাচারের কোন বিধিও নেই আবার নিষেধও নেই। কিন্তু অন্যান্য শাস্ত্র (স্মৃতি, পুরাণাদি) ও বেদাঙ্গ (কল্প) শাস্ত্র গৃহ্যসূত্রাদিতে লোকাচার বা দেশাচার পালনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। মহর্ষি ব্যাসদেবের পিতা ভগবান পরাশর মুনি তাঁর বৃহৎপরাশরস্মৃতির ৬/২০৪-২০৫ এ বলেছেন,

"দেশাচারস্তথা ধর্ম ইতি প্রাহ পরাশরঃ

অয়ং হি পরমো ধর্মঃ সর্বেষামিতি নিশ্চয়ঃ" 

অর্থাৎ দেশাচার পালন সকলের পক্ষেই শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইহা নিশ্চয় বলে জানবে। 

ভাগবত পুরাণেও (১১/১০/১) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুলাচার পালনের কথা বলেছেন। বামন পুরাণের ১৪/৩৮ শ্লোকেও দেশাচার ও কুলাচার পালনের কথা বলা হয়েছে। স্কন্দ পুরাণের ব্রহ্মখণ্ডের ধর্মারণ্যখণ্ডের ৪০/৬৪-৬৬ শ্লোকেও কুলাচার ও গোত্রাচার পালনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

🏵️ লোকাচার/দেশাচারের প্রাসঙ্গিকতাঃ

কয়েকটি সাধারণ লোকাচার বা দেশাচারের উদাহরণ তুলে ধরে এর প্রাসঙ্গিকতা সকলের নিকট স্পষ্ট করার চেষ্টা করবো। 

১/ চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে এক মাস প্রতিদিন তুলসী বৃক্ষের ওপর বেঁধে দেওয়া হয় জলের ঝারা।

এর পেছনে কারণ কি? মূলত বৈশাখের তীব্র তাপদাহে এই বৃক্ষটি যেন সর্বক্ষণ শীতল ও সতেজ থাকে সেই ব্যবস্থা করতেই হয়তো এই লোকাচারের শুরু হয়। এই আপাত অর্থহীন আচারের সাথেও প্রকৃতির রয়েছে আত্মিক যোগস্থাপনের এক ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ! এর সাথে যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে এক বেদমন্ত্রেরও (যজুর্বেদ ৩৬/১৭)।

পৃথিবী শান্তিরোপঃ 

শান্তিরোষধয়ঃ শান্তিঃ

বনস্পতয়ঃ শান্তির্বিশ্বে

শান্তির বিশ্বদেবা শান্তি......

অর্থাৎ তুলসীগাছ কেবল একটি বৃক্ষই নয় বরং বহু রোগের ঔষধি হিসেবেও কার্যকর। তাই তুলসীগাছের একান্ত পরিচর্যা অবশ্য কর্তব্য।

২/ চৈত্র সংক্রান্তিতে নানান শাকসবজী দিয়ে পাচন রান্না করে খাওয়ার আচার লক্ষ্যনীয় ও পালনীয়। 

চৈত্রমাসে নানান চর্মরোগ ও পাচনজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। আয়ুর্বেদে এসবের চিকিৎসা বিভিন্ন রকমের ভেষজ পাতার মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও আমরা জানি যে শাকসবজীর ফাইভার আমাদের পাচন প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করে দেয়। কিছু আঞ্চলিক শাস্ত্র ও লোকাচার অনুযায়ী ১৪ পদের শাক (কিছু অঞ্চলে কমবেশি হয়) দিয়ে একটি বিশেষ পাচন রান্না করা হয় চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে।এই পাচনের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যা আমাদের দেহকে নানাবিধ রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা করবে। 

প্রাচীন স্মৃতিকার রঘুনন্দন (মহাপ্রভুরও পূর্বে এসেছেন) লিখেছেন, 

"ওলং কেমুকবাস্তুকং সার্ষপঞ্চ নিম্বং জয়াং।

শালিঞ্চিং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শেলূকং গুড়ুচীন্তথা। ভন্টাকীং সুনিষণ্ণকং শিবদিনে যদন্তি যে মানবাঃ প্রেতত্বং ন চ যান্তি কার্তিকদিনে কৃষ্ণে চ ভূতে তিথৌ।" -কৃত্যকৃত্ত্ব/রঘুনন্দন।

শাস্ত্রে উল্লেখিত চৌদ্দশাক হলো, ১. ওল ২. কেঁউ ৩. বথুয়া ৪. কালকাসুন্দে ৫. সরষে ৬. নিম ৭. জয়ন্তী ৮. শালিঞ্চে বা শিঞ্চে ৯. গুলঞ্চ ১০. পটল বা পলতা ১১. শেলুকা ১২. হিলমোচিকা বা হেলেঞ্চা ১৩. ভাঁট বা ঘেঁটু ১৪. সুনিষণ্নক বা শুষনি। 

শাকের এই তালিকা দেখলেই স্পষ্ট হয় যে প্রতিটি শাকই নানাবিধ রোগের প্রতিরোধে ভেষজ উপাদানযুক্ত। এছাড়াও শ্রী শ্রী চন্ডীতে মাকে শাকম্ভরী বলা হয়েছে। অর্থাৎ মা স্বয়ং শাকে শক্তিরূপে বিরাজ করেন। 

৩/ চৈত্র মাসে আম খাওয়া বারণ। 

চৈত্র মাসে আম সম্পূর্ণভাবে পরিপক্ব হয় না এমনকি আমের আঁটিও অপরিপক্ক অবস্থায় থাকে। অপরিপক্ক কাঁচা আমে টক্সিসিটি (পয়জন নয়) হতে পারে। অধিক পরিমাণে খেলে গলায় চুলকানো, পেটব্যাথা ও ডিসেন্ট্রি জাতীয় সমস্যা হতে পারে। আমের আঁটি পরিপক্ব না হলে সে আম না খাওয়া উচিত। বরং পরিপক্ব আমের আঁটিতে রয়েছে অসাধারণ উপকার। আমের আঁটিতে রয়েছে  'ম্যাঞ্জিফেরিন' নামের অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট। এ বিশেষ ধরনের অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট সেলুলার ড্যামেজ কমিয়ে শরীরে ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে। কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় এর ব্যবহার হয়ে আসছে। এছাড়াও চৈত্রমাসেই অপরিপক্ক অতি-কাঁচা আম অধিক পরিমাণে খেয়ে ফেললে সুস্বাদু পাকা আমেরও সংকট তৈরি হবে। 

আবার চৈত্রে আম খাওয়া যাবে না - এটা দক্ষিণবঙ্গে নীলপূজার আগে আম খাওয়া যাবে না হিসেবে পরিচিত।

এখন কোন দেশ বা অঞ্চলে যদি চৈত্র মাসেই পরিপক্ব আম পাওয়া যায় তবে সেখানে এই দেশাচার বা লোকাচার প্রযোজ্য না-ও হতে পারে।

৪/ বৈশাখ মাসে মাছ খাওয়া বারণ। 

কিছু কিছু অঞ্চলে বৈশাখ মাসে মাছ না খাওয়ার লোকাচার প্রচলিত আছে। এর পেছনে কারণ কি হতে পারে! বেশিরভাগ অঞ্চলে ছোট মাছসহ অনেক বড় মাছের প্রজনন কাল শুরু হয় বৈশাখ মাস থেকে। এই তথ্য বাংলাদেশ সরকারের "কৃষি তথ্য সার্ভিস" সাইটেও দেওয়া আছে। এই সময়ে ছোট মাছ শিকার করাও নিষেধ। লোকাচারের মান্যতায়ও এই সময়টায় মাছ না খাওয়ার জন্যই বলা হয়। এতে করে মাছের উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পায় এবং কোন মাছের প্রজাতিই বিপন্ন হয় না। 

৫/ আমরা লক্ষ্য করি যে হিন্দু বিয়েতে বৈদিক আচারের পাশাপাশি কিছু দেশাচার বা লোকাচারও দেখা যায় যা এক অঞ্চলের সাথে অন্য অঞ্চলের সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেকসময় দেখা যায় বরের বাড়ীর আচারের সাথে কনের বাড়ীর আচারের ভিন্নতার কারণে বরপক্ষ কনে পক্ষের বাড়ী গিয়ে যুদ্ধংদেহী অবস্থায় অবতীর্ণ হয়। কিন্তু শাস্ত্র বলছে বিবাহের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই লোকাচার মান্য করা উচিত কারণ সেটা সেই অঞ্চলের সংস্কার ও সংস্কৃতির অংশ। যেহেতু বিবাহকার্য কনের বাড়ীতে সম্পন্ন হয় তাই সকলের উচিত কনে বাড়ীর লোকাচার মেনেই বিবাহকার্য সম্পন্ন করা।

এই বিষয়ে শাস্ত্র কি বলছে❓

ষড়বেদাঙ্গের মধ্যে কল্প বেদাঙ্গের অন্তর্ভুক্ত আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রের ১/৭/১ সূত্রে বলা হয়েছে। 

"অথ খলূচ্চাবচা জনপদধর্মা গ্রামধর্মাশ্চ তাম্বিবাহে প্ৰতীয়াত্"

অর্থাৎ, বিবিধ গ্রাম ও জনপদের আচার যা প্রচলিত আছে তা বিবাহে পালন করতে হবে।

দ্বিতীয় সূত্রেই (১/৭/২) সকল জনপদের লোকাচারকে সমমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। 

এবার একটি ব্যক্তিগত আলাপচারিতা শেয়ার করি। এই বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে আমার মায়ের সাথে বসে সকালের খাবার খাচ্ছিলাম। সব পদই আগের দিনের রান্না করা। মা'কে জিজ্ঞেস করলাম আজকে রান্না করে নি কেন। মা বললো যে ঠাকুমার সময় থেকেই (হয়তো আরও আগে থেকে চলে আসছে) নাকি এই লোকাচার। 

মা'কে এর কারণ জিজ্ঞেস করলাম। 

মা উত্তর দিলো,

আগেরদিনে মহিলারা অনেক আচারবিচার করতো তাই সংক্রান্তির দিন সকাল সকাল রান্না করার সময় হয়ে উঠতো না। এমতাবস্থায় ঘরের সকালেই সকালে না খেয়েই থাকার সম্ভাবনা তৈরী হতো। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্যই হয়তো এমন নিয়ম করা হয়েছে যে আগের দিনের রান্না মাটির পাত্রে সংরক্ষণ করা হতো এবং ভাতে জল দিয়ে রাখা হতো। সে থেকেই জলভাত (পান্তাভাত) ও আগের দিনের শাকসবজি খাওয়ার লোকাচারটা শুরু হয়ে থাকতে পারে।

🔸 উপসংহারঃ

পরিশেষে বলবো যে প্রতিটি কার্যের পেছনে অবশ্যই কোন কারণ আছে। আমরা কারণের অনুসন্ধান ব্যতীত কার্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করি। এখন এই কারণ যদি জীব ও জগতের জন্য অহিতকর না হয়ে বরং হিতকর হয় তবে সে কার্যকে আমরা কুসংস্কার বলতে পারি না। আপনি লোকাচার না মানতে পারেন কিন্তু অন্যের মান্যতাকে তিরস্কার করে তার উপলব্ধিকে ছোট করার নৈতিক অধিকার শাস্ত্রও আপনাকে দেয় নি। সনাতনীদের লোক পরম্পরায়, কুল পরম্পরায় প্রাপ্ত সংস্কৃতি ও সংস্কারাদি বেশিরভাগই জগৎ ও জনকল্যাণমুখী। আমরা আমাদের তথাকথিত আধুনিকতা ও স্থুল চিন্তায় সেগুলোকে কুসংস্কার বা পশ্চাৎপদ বলে নিজেদের মূল থেকেই সরে যাচ্ছি। 

© শ্রী অনিক কুমার সাহা 

প্রচারেঃ

SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।

 (বেদ ও বেদান্ত বিভাগ)

সনাতনী শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ