পরম্পরা নাকি পরমফোড়া !! তাচ্ছিল্যের নাকি গর্বের??


পরম্পরা নাকি পরমফোড়া !!
তাচ্ছিল্যের নাকি গর্বের?? 

পরম্পরা শব্দটি নিয়ে বহু মানুষেরই ধারণা স্পষ্ট নয় তাই অনেকেই এই শব্দটি নিয়ে বিভ্রান্তি বা তাচ্ছিল্যের শিকার হয়। পরম্পরা বিষয়টি মানবজাতীর সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। যেমন কোন অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে জিনগত পরম্পরা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এতে করে সে অঞ্চলের বংশগতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়৷ এটাকে বলা হয় একটি নিরবিচ্ছিন্ন বংশ পরম্পরা, বায়োলজিতে যাকে বলা হয় জেনেটিক লিনিয়েজ বা জেনেটিক পেডেগ্রী। 

ভারতবর্ষের তথা সনাতনীদের বর্তমান জেনেটিক লিনিয়েজ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় প্রায় ৫৫ হাজার বছর আগের বংশ পরম্পরার অর্থাৎ আমাদের নিরবচ্ছিন্ন বংশপরম্পরা অত্যাধিক প্রাচীন। আমাদের সনাতন সমাজে বংশ পরম্পরাকে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয় যে পরমপিতা ব্রহ্মা হতে মনু হয়ে পরম্পরাগত সকল ঋষিদের নাম ও পরিচিত আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থে উপলব্ধ৷ এই প্রক্রিয়াকে ধরে রাখতে একমাত্র সনাতন সমাজেই গোত্র প্রথা প্রচলিত আছে যেটা আধুনিক বিজ্ঞানে প্রাণি কিংবা উদ্ভিদ পরিচিতির জন্য ব্যবহার করা হয়। আমাদের নানাবিধ সংস্কার বা শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়ায়ও আমাদের গোত্র সমেত চৌদ্ধ পুরুষ বা সাত পুরুষের নাম উল্লেখ করতে হয় যা আমাদের চিরায়ত বংশপরম্পরার ক্রমধারাকেই নির্দেশ করে। 

★ পরম্পরা শব্দের অর্থ কি? 

পরম্পরা শব্দটি সংস্কৃত শব্দ থেকে আগত একটি শব্দ যার বুৎপত্তি হচ্ছে পরম্পর+আ (টাপ্)। এর অর্থ বিশ্লেষণ করলে হয় যে, এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া বা ক্রমানুসারে আগত অথবা একটি নিরবিচ্ছিন্ন ধারা। This is like a chain that never has been broken. 

নানাবিধ পরম্পরা প্রচলিত আছে আমাদের সমাজে যেমনঃ গুরু পরম্পরা, শাস্ত্র পরম্পরা বা সাংস্কৃতিক পরম্পরা এমনকি দর্শনগত পরম্পরাও প্রচলিত আছে। এই সকল পরম্পরা একমাত্র সনাতন সমাজেই পরিলক্ষিত হয় যা আমাদেরকে একটি নিরবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক উন্নত সভ্যতার উত্তরসূরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।  

একইভাবে আমাদের সংস্কৃতি ও দর্শনেরও একটি নিরবিচ্ছিন্ন পরম্পরা আছে যার সাথে আবার ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে গুরু পরম্পরা। 

সনাতন বৈদিক সংস্কৃতিতে প্রতি কল্পের শুরুতে মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণ শুদ্ধ সাধনপদ্ধতিতে পরমেশ্বর অনাদি অনন্ত সুপ্ত জ্ঞানসমষ্টি বেদ প্রাপ্ত হন ধ্যানে। পরমেশ্বরের জ্ঞান অনাদি ও অনন্ত তাই বেদও অনাদি অনন্ত। মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের দ্বারা প্রাপ্ত মন্ত্রসমূহ ধরণ ও প্রকার অনুসারে ঋষি পরম্পরায় চতুর্বেদ (ঋক্, যজুঃ, সাম ও অথর্ব) হিসেবে সংকলিত।  

সেই আত্মস্থ করা জ্ঞানরাশি তাঁরা গুরু-শিষ্য পরম্পরায় গুরুকুলে পাঠদানের মাধ্যমে সংরক্ষণ করেছিলেন যে ধারা এখনও চলমান৷ বৈদিক সংস্কৃতির সংস্কৃত মন্ত্রসমূহ, দার্শনিক উপস্থাপন ও আচার অনুষ্ঠানের বিশাল ভান্ডার কয়েক সহস্র বছর ধরে সনাতন সম্প্রদায় নিরবচ্ছিন্ন পরম্পরায় ধারণ করা হয়েছে যা মূলগতভাবে অবিকৃত ও অপরিবর্তিত। ২০০৩ সালের ৭ নভেম্বর UNESCO-Intangible Cultural Heritage সনাতন ধর্মের পরম্পরাগত প্রক্রিয়ায় অবিচ্ছিন্ন ও অপরিবর্তিতভাবে চলে আসা "বৈদিক মন্ত্রপাঠের ঐতিহ্য"কে "Masterpiece of the Oral and Intangible Heritage of Humanity" লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করে যা সনাতন পরম্পরার  প্রতি UNESCO এর একটি নির্মোহ স্বীকৃতি। 

গুরু-শিষ্য পরম্পরা থেকে সৃষ্টি হয় জ্ঞানের এক চমৎকার ধারা যা অনাদি জ্ঞানরাশিস্বরূপ বেদচর্চার এক অন্যতম প্রক্রিয়া। বেদের কর্মকাণ্ডের সংহিতা ভাগ (চতুর্বেদ), ব্রহ্মণভাগের পাশাপাশি বেদের জ্ঞানকাণ্ড আরণ্যক ও উপনিষদ এসে বেদচর্চা তথা চিরন্তন জ্ঞানচর্চাকে পূর্ণতা প্রধান করে। পরবর্তীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং অবতীর্ণ হয়ে এই জ্ঞানচর্চার পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যান সকল শাস্ত্রের সারগ্রন্থ শ্রীমদভগবদগীতা প্রদান করে। অর্থাৎ জ্ঞানচর্চা তথা বেদচর্চার ক্ষেত্রেও আমাদের একটি নিরবিচ্ছিন্ন পরম্পরা পরিলক্ষিত হচ্ছে। 

শ্রীমদভগবদগীতায়ও এর সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়৷ শ্রীমদভগবদগীতার চতুর্থ অধ্যায়ের প্র‍থম শ্লোকেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, 

"ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম্।।
বিবস্বান্মবে প্রাহ মনুরিক্ষ্বাকবেহব্রবীৎ।।"

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন-আমি পূর্বে সূর্যদেব বিবস্বানকে এই অব্যয় নিষ্কাম কর্মসাধ্য জ্ঞানযোগ বলেছিলাম এবং সূর্য (তাঁর পুত্র) মনুকে বলেছিলেন এবং মনু (তাঁর পুত্র) ইক্ষ্বাকুকে বলেছিলেন।

অর্থাৎ এখানেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে জ্ঞানচর্চার একটি নিরবিচ্ছিন্ন পরম্পরা বিদ্যমান ছিলো সৃষ্টির শুরু থেকেই৷ 

একই অধ্যায়ের দ্বিতীয় শ্লোকেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, 

"এবং পরম্পরাপ্রাপ্তমিমং রাজর্ষয়ো বিদুঃ।
স কালেনেহ মহতা যোগো নষ্টঃ পরন্তপ।।"

অনুবাদঃ এভাবেই পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত এই পরম জ্ঞান রাজর্ষিরা লাভ করেছিলেন। কিন্তু কালের প্রভাবে পরম্পরা ছিন্ন হয়েছিল এবং তাই সেই যোগ নষ্টপ্রায় হয়েছে।

এই শ্লোকেও পরম্পরার গুরুত্ব তুলে ধরা হলো। কিন্তু যখনই নানাবিধ কারণে পরম্পরা ছিন্ন হয়েছিল এবং মানবকূল শাস্ত্রের নামে বিভ্রান্ত হচ্ছিলো তখনই ভগবান স্বয়ং অবতীর্ণ হয়ে দান করলেন সকল শাস্ত্রের সারগ্রন্থ শ্রীমদভগবদগীতা। 

তিনি সকল যাত্রীকে নতুন কোন রেললাইনে তুলে দেন নি বরং লাইনচ্যুত রেলটিকেই মেরামত করে রেললাইনে পুনঃস্থাপন করলেন।  অর্থাৎ পরম্পরা যখনই বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে তখনই তিনি নিজে অবতীর্ণ হয়ে সে ধারা অব্যাহত রাখলেন। 

বৈদিক এই জ্ঞানসমূহ এমনই বিষয় যে, আপনি স্বয়ং তা অধ্যয়ন করে সঠিক মর্মার্থ উপলব্ধি করা প্রায় অসম্ভব। আপনাকে শ্রদ্ধাপূর্ণ হৃদয়ে শুদ্ধচিত্তে সদগুরুর নিকট এই গুরুমুখী জ্ঞান অর্জন করতে হবে। 

মহর্ষি ব্যাস দেব তাঁর ব্যাসগীতায় এ বিষয়ে বলছেন, 

"এবং দন্ডাদিভির্যুক্তঃ শৌচাচারসমন্বিতঃ ।
আহূতহধ্য্যনং কূর্যাদ্বীক্ষমাণো গুরুর্মুখম ।।"

অর্থাৎ বেদ ব্যাস বললেন, শৌচাচার বিধানবিধিবিধান যথাযথ মেনে ব্রহ্মচারী ( ব্রহ্মচর্য পালনে রত) গুরু তাকে আহব্বান জানালে তবে সে গুরুমুখ নিরিক্ষণ করে অধ্যায়ণ করবে। 

বিষয়টা যখন অধ্যায়ন বা শেখার প্রসঙ্গ আসে তখন অবশ্যই একটা সুগঠিত কাঠামো বা প্রতিষ্ঠানের বিষয় চলে আসে। আপনি গভীর ভাবে লক্ষ্য করুন, ঘরে বসে মুবাইল এপসের মাধ্যমে কিংবা নীলক্ষেতের লাইব্রেরী হতে বই কিনে ৩০ দিনে কেউ স্বঘোষিত এমবিবিএস ডাক্তার হয়ে গেলে এবং সেই ডাক্তার হতে চিকিৎসা নিলে আপনার স্থিতি কি হবে স্বয়ং বিবেচনা করুন?  দেখা যাবে, ফার্মেসি বা হাতুরি চিকিৎসার মতো হিতে বিপরীত হবে এবং ফলাফল হবে ভয়াবহ। 

তাহলে স্পষ্ট হলো মেডিক্যাল কিংবা প্রকৌশলি সনদ পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে অনাধিকারী কিংবা অযোগ্যদের হাতে উচ্চশিক্ষার মোটা মোটা বই ধরিয়ে জ্ঞানপাপী বানানোর প্রক্রিয়াকে জ্ঞানের সমবন্টন বলে না বরং ব্যবসায়িক ধান্দা অথবা চাটুকারিতা বলে। ইকুয়েলিটির কথা বলে ইকুয়েটিকে অস্বীকার করা অনুচিত। 

আমরা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার দিকে যদি তাকাই, তাহলে একজন ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ছাত্রকে যদি জাবেদা, খতিয়ান না বুঝিয়ে সোজা আর্থিক বিবরণী শেখানো হয় তাহলে সে কিছুই বুঝবে না। আবার তার নিজের পক্ষেও এগুলো নিজে নিজে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। সুতরাং, একজন শিক্ষক এবং সঠিক পথপ্রদর্শন আবশ্যক। 

বৈদিক পরম্পরায় এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে সাংখ্যদর্শনের একটি বিধান দেখা যায়। 

"নিজশক্তির্ব্যুপত্ত্যা ব্যবচ্ছিদ্যতে।।"
(সাংখ্যপ্রবচণসূত্র -৫/৪৩)

অর্থাৎ, বেদ অপৌরুষেয় হইলেও তাহাতে যে স্বতঃসিদ্ধ শক্তি বিদ্যমান, সেই শক্তি গুরু-শিষ্য পরম্পরায় ও উপদেশ, দান গ্রহণ নিয়ম অবলম্বনে ব্যুৎপাদিত হয় ও তাহাতেই ইতর অর্থের ব্যবচ্ছেদ হয়। তদর্থাতিরিক্ত অর্থের বোধ হয় না। 

এবার একটু মহাভারতে ফিরে যায়৷ মহাভারতের মহাযুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একটা বক্তব্য নিয়ে অনেকে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে। তারা দাবী করে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে পরম্পরা কুলষিত হলে সেটা ধ্বংস করে নতুন শুরু করার জন্য। মহাভারতের যুদ্ধে কি আদৌ তিনি পরম্পরার ধ্বংস করেছিলেন? দুর্যোধনের লালসায় একটি পরম্পরা যখন কুলষিত তখন তিনি বরং এক মহা বিনাশী যুদ্ধের মাধ্যমে অশুভকে বিদায় করে ছিন্ন হয়ে যাওয়া পরম্পরাকে আবার নতুন রূপে অভিমন্যু পুত্র পরীক্ষিতের মাধ্যমে পুনঃস্থাপনই করেছেন। অর্থাৎ আমরা সনাতনীরা এখনও এক গৌরবময় নিরবিচ্ছিন্ন পরম্পরারই গর্বিত উত্তরসূরী। 

এখানে সুস্পষ্ট যে, পরম্পরা কোন ঠুনকো বিষয় নয় যে নোংরা মানসিকতা নিয়ে এই শব্দটির বিকৃত করে ঠাট্টা করা যাবে। প্রত্যেকটি গুরু পরম্পরা কালক্রমে নিরবিচ্ছিন্ন বৈদিক সংস্কার মান্য করেই মনুষ্যকে বেদের পরম তত্ত্ব উপলব্ধি করার জন্য সমর্থ করে গড়ে তুলে। সুতরাং যারা দাবি করে যে তারা বৈদিক, তাদের অবশ্যই উচিত এই শব্দটির মর্যাদা রক্ষা করা অথবা তাদের শব্দচয়ন পক্ষান্তরে তাদেরকেই পরম্পরাহীন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে। 

জয় শ্রীমন্নারায়ণ🙏
জয় ভবানী🙏

©শ্রীমান গীতাংক ধর দীপ
সহযোগিতায়ঃ স্টিমন অনিক

প্রচারেঃ SPS শাস্ত্র গবেষণা কমিটি।
সনাতনী শাস্ত্র ও দর্শন প্রচারে বদ্ধপরিকর।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ