জয় শ্রীকৃষ্ণ
কারো কারো মতে কৃষ্ণ গীতার জ্ঞান দেওয়ার সময় কখনো কখনো যোগস্থ অবস্থায় ছিলেন। এমনকি তিনি বিশ্বরূপ দেখানোর সময়ও যোগস্থ অবস্থায় ছিলেন। এখন তাদের কথামতো ধরে নিলাম কৃষ্ণ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখানোর সময় যোগযুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ কৃষ্ণ যখন বিশ্বরূপ দেখাচ্ছিলেন ঐ সময়ে তিনি অন্য কোন নিরাকার(যার কোন আকার/রূপ;এমনকি বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই) ঈশ্বরের সাথে যোগযুক্ত ছিলেন। তাহলে এবার কয়েকটা পয়েন্ট নোট করি.....
গীতার ১১/৩ এ অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন....এবমেত্দ যথাত্থ ত্বমাত্মানং পরমেশ্বর।দ্রষ্টুমিচ্ছামি তে রূপমৈশ্বরং পুরুষোত্তম।।→হে পরমেশ্বর! তুমি নিজের বিষয়ে যাহা বলিলে তাহা ঐরূপই বটে; হে পুরুষোত্তম, আমি তোমার ঐশ্বরিক রূপ দেখিতে চাই।এখানে অর্জুন কৃষ্ণের ঐশ্বরিক রূপ দেখার জন্য মিনতি করলেন। আবার ১১/৪ এ তিনি বলেছেন....মন্যসে যদি তচ্ছক্যং ময়া দ্রষ্টমিতি প্রভো।যোগেশ্বর ততো মে ত্বং দর্শয়াত্মানমব্যয়ম্।।→হে প্রভু! যদি তুমি মনে করো আমি সেই রূপ দেখিবার যোগ্য,তাহা হইলে হে যোগেশ্বর তুমি আমাকে তোমার সেই অক্ষয় আত্মরূপ দেখাও।।অর্থাৎ যদি কৃষ্ণের সেই রূপ দেখিবার যোগ্য হন তবে যেন অর্জুনকে তা কৃষ্ণ দেখান।অর্জুনের কথা রাখতে কৃষ্ণ বললেন,পশ্য মে পার্থ রূপাণি (১১/৫)হে পার্থ আমার রূপসকল 'দেখো(পশ্য)'....…
শ্লোকগুলো টীকা সহ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে অর্জুন বারবার বিশ্বরূপ "দেখার" জন্য মিনতি করেছেন আর কৃষ্ণ "দেখানোর" কথা বলেছেন। এখন কৃষ্ণ যেহেতু যোগযুক্ত ছিলেন তাহলে যে রূপ দেখার জন্য অর্জুন মিনতি করলেন আর কৃষ্ণ যে রূপ দেখালেন সেটা অবশ্যই নিরাকার (সম্পূর্ণ আকারহীন) ঈশ্বরের হবে। কারো কারো নিরাকারবাদীদের মতে ঈশ্বর সম্পূর্ণ নিরাকার মানে উনার রূপ দূরে থাক, কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
তাহলে এখন প্রশ্ন হল কৃষ্ণ যোগস্থ হয়ে বিশ্বরূপ দেখালে যে রূপ দেখালেন আর অর্জুন যে রূপ দেখলেন সেই রূপ নিরাকার ঈশ্বরের হলে সেই নিরাকার ঈশ্বরের কি করে কোন রূপ থাকে না? কি করে নিরাকার (রূপহীন) ঈশ্বরের রূপ বিশ্বরূপের মাধ্যমে প্রকাশিত হল??
এখন সেই সব নিরাকারবাদী ব্যক্তিগন বলে থাকবেন যে কৃষ্ণ বিশ্বরূপটা সাকারভাবে দেখান নি,,সেটা অদৃশ্যমান ছিল যা অর্জুন জ্ঞানের দ্বারা জাস্ট উপলব্ধি করেছিলেন। এমনকি এরা অর্জুনের পাওয়া দিব্যচক্ষুকেও জ্ঞানের চক্ষু বলে থাকেন। আচ্ছা। এই সমস্ত কিছু মেনে নিলাম। তাহলে অর্জুন ১১/৩ এ কৃষ্ণের বিশ্বরূপ শুধু উপলব্ধি করার বদলে 'চক্ষু দ্বারা দেখার' জন্য মিনতি করলেন কেন? বিশ্বরূপের বর্ননায় "দেখিতেছি দেখিতেছি (পশ্যামি)" বলে বর্ননা করলেন কেন যেখানে উপলব্ধি করতেছি বলে বলে বর্ননা করার কথা?!
যাকগে, সব বাদ দিয়ে এবার আসি এসব একদম ক্লিয়ার করা শ্লোকে......
কিরীটিনং গদিনং চক্রহস্তমিচ্ছামিত্বাং দ্রষ্টুমহং তথৈব।তেনৈব রূপেণ চতুর্ভুজেনসহস্রবাহো ভব বিশ্বমূর্তে।। (১১/৪৬)→হে সহস্রবাহো! আমি তোমার সেই শঙখ-চক্র-গদা-পদ্মধারী রূপ দেখিতে ইচ্ছা করি(দ্রষ্টুম্ ইচ্ছামি)। হে বিশ্বমূর্তে তুমি সেই চতুর্ভুজ মূর্তি ধারন করো। ভব(আবির্ভূত হও)অর্জুনের এই কথা অনুসারে কৃষ্ণ ১১/৪৯ এ বললেন....পুনস্ত্বং তদেব মে রূপমিদং প্রপশ্য।।→পুনরায় তুমি আমার সেই পূর্ব রূপ 'দর্শন করো(প্রপশ্য)।'সঞ্জয় এই কথা ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন...ভূত্বা পুনঃ সৌম্যবপুর্মহাত্মা।(১১/৫০)শ্রীকৃষ্ণ আবার সৌম্য মূর্তি(সৌম্যবপুঃ) ধারন করলেন(ভূত্বা)।
উপরোক্ত তিনটি শ্লোক থেকে টীকা সহ দেখা যায় যে অর্জুন কৃষ্ণকে চতুর্ভুজ মূর্তি ধারন করার কথা বললেন,কৃষ্ণ সেই রূপ ধারন করলেন,সঞ্জয় আবার সেই কথা ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন যে কৃষ্ণ সৌম্য মূর্তি ধারন করলেন।
এখন বিশ্বরূপটা চক্ষু দ্বারা সাকারভাবে না দেখে কেবল জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করলে অর্জুন পূর্ব রূপ ধারন করার কথা কেন বললেন? কৃষ্ণ অর্জুনের কথা রাখতে সৌম্য মূর্তি কেন ধারন করলেন?সঞ্জয় কেন বললেন কৃষ্ণ সৌম্য মূর্তি ধারন করলেন?
অর্জুন নিজ চোখে বিশ্বরূপ না দেখে কেবল উপলব্ধি করলে চতুর্ভুজ মূর্তি ধারন করার কথা হললেন কেন?আমরা জানি কোন কিছু দৃশ্যমান হলেই কেবল সেটা দেখা যায় এবং সেটাকে মূর্তি ধারন করার কথা বলা যায়।কেননা অদৃশ্যমান বিশ্বরূপের মূর্তি ধারন অসম্ভব।
সুতরাং অর্জুন কৃষ্ণের বিশ্বরূপ টা নিজ চোখে দেখেছিলেন যা ছিল দৃশ্যমান এবং সাকার(অসীম আকারযুক্ত সাকার রূপ)। অর্থাৎ সেই বিশ্বরূপেরও একটা বাস্তবিক রূপ ছিল। এখন কৃষ্ণ যোগযুক্ত থাকলে বিশ্বরূপ টা হবে নিরাকার ( একদম রূপহীন) ঈশ্বরের। কিন্তু রূপহীন নিরাকার ঈশ্বরের রূপযুক্ত বিশ্বরূপ থাকবে কেমনে? তাইলে তো নিরাকার ঈশ্বরের রূপ নেই বলা যায় না!
এখন প্রসঙ্গ ঘুরাতে কেউ যদি বলে, না,বিশ্বরূপ দেখানোর সময় কৃষ্ণ তখন যোগযুক্ত ছিলেন না।এই রূপটা নিরাকার ঈশ্বরের না, সেটা কৃষ্ণেরই তাইলে আপনারা নির্দ্বিধায় মেনে নিন কৃষ্ণ ঈশ্বর।
--- শ্যামলী দাশ
0 মন্তব্যসমূহ