ত্রৈতবাদের সমীক্ষা






ত্রৈতবাদ হচ্ছে একটি দার্শনিক মতবাদ। যে মতবাদ দয়ানন্দ কর্তৃক প্রচারিত।

এবার এই ত্রৈতবাদ নিয়ে আমরা কিছু দার্শনিক বিচার বিশ্লেষণ ও সমীক্ষা করবো:-

প্রথমত,
এই দর্শনের মূল কথা গুলো হলো, ব্রহ্ম(ঈশ্বর, পরমাত্মা); জীবাত্মা; জগৎ তিনটা সত্ত্বাই অনাদি। এই তিন সত্ত্বাই স্বাধীন। কেও কারো অধীন নয়। কেও কারো অংশ নয়, তিনটা সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্ত্বা। ত্রৈতবাদে জীবাত্মা, জগৎ ও ব্রহ্ম ভিন্ন সত্ত্বা। স্বাধীন সত্ত্বা। কেও কারো অধীন না, কেও কারো অংশ না।
এবার জীবাত্মার সাপেক্ষে ব্রহ্ম ও জগৎ আলাদা সত্ত্বা। ব্রহ্মের সাপেক্ষে জীবাত্মা ও জগৎ আলাদা সত্ত্বা। আবার জগতের সাপেক্ষে ব্রহ্ম ও জীবাত্মা আলাদা সত্ত্বা।
এবার ব্রহ্ম যেহেতু জীবাত্মা ও জগতের বিচারে আলাদা একটা সত্ত্বা এবং যেহেতু জীবাত্মা ও জগৎ তার কোনো অংশ নয়, যেহেতু জীবাত্মা ও জগৎ স্বাধীন, সেহেতু জীবাত্মা আর জগতের উপর ব্রহ্মর কোনো অধিকার নাই। কারণ জগৎ ও জীবাত্মা ঈশ্বর/ব্রহ্ম বহির্ভূত সত্ত্বা। অধিকার তখনই আসবে যখন কোনো কিছু কারো অধীনে হয়। যেহেতু জীবাত্মা ও জগৎ ব্রহ্ম অধীন নয়, ব্রহ্মাংশও নয় সেহেতু জীবাত্মা ও জগতের উপর ব্রহ্মের কোনো অধিকার নাই, অর্থাৎ ব্রহ্ম কখনোই জীবাত্মাকে জগতের সাথে মিশিয়ে জীবকে সুখ দুঃখ দানের অধিকার রাখে না।
এখানে হয়তো কেও বলতে পারে ঈশ্বর ন্যায় বিচারক তাই সে জীবাত্মাকে তার কর্মফল দান করেন।
কিন্তু ঈশ্বরের সেই অধিকারও নাই। কারণ জীবাত্মা স্বাধীন সত্ত্বা। জীবাত্মা ঈশ্বরের অংশ না। সুতরাং জীবাত্মাকে জগতে প্রেরণ করে জীবকে সুখ দুঃখ ভোগ করালে ঈশ্বর অবশ্যই অনধিকার চর্চা করছে বলতে হবে। কারণ জীবাত্মা ও জগৎ তার অংশও না তার অধীনও না, ব্রহ্মের কোনো অধিকার নাই জীবাত্মা ও জগতের উপর হস্তক্ষেপ করার।
তারপরও ঈশ্বর হস্তক্ষেপ করেই যাচ্ছেন, জীবাত্মাকে জগতের সাথে জড়িয়ে সুখ দুঃখ দিচ্ছেন। এটা ঈশ্বরের অনধিকার চর্চা। এমন অনধিকার চর্চাকারী ঈশ্বর কদাপি ন্যায়কারী হতে পারে না।
ঈশ্বরের এমন করার পিছনে কারণ হিসেবে দুটো বিষয় থাকতে পরে :-
১. ত্রৈতবাদের ঈশ্বর/ব্রহ্মকে এটা করতেই হয়। না করে থাকতে পারেন না। তাহলে বলতে হবে ঈশ্বর, জীবাত্মা ও জগৎ কোনো নিয়মে আবদ্ধ। এখন সেই নিয়মটাকেই সুপ্রিম মূল ঈশ্বর / ব্রহ্ম মানতে হবে। তাহলে পূর্বোক্ত ত্রৈতবাদের ব্রহ্ম / ঈশ্বর মূলত ব্রহ্ম বা ঈশ্বর নন। এই নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মই ব্রহ্ম বা ঈশ্বর। এবং এই নিয়মে আবদ্ধ জীবাত্মা, জগৎ ও পূর্বোক্ত ব্রহ্ম এই নিয়মরূপী ব্রহ্মের অংশ ও অধীন।
২. এই তিনটি সত্ত্বার মধ্যে ঈশ্বর/ ব্রহ্ম সত্ত্বাটি অধিকতর শক্তিমান তাই সে শক্তিমান হওয়ায় বাকি দুই তুলনামূলক দূর্বল সত্ত্বার উপর জুলুম করছেন। দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচার আরকি। তো সে হিসেবে ঈশ্বর অন্যায় কারী, অত্যাচারী একটা সত্ত্বা।

দ্বিতীয়ত,
ত্রৈতবাদ মতে জীবাত্মা নিরাকার। জীবাত্মা একাধিক, বহু সংখ্যক। প্রত্যেক জীবের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন জীবাত্মা অবস্থিত।
এবার এখানে সমস্যা হচ্ছে কোনো কিছু নিরাকার হলে একাধিক হওয়া সম্ভব কিভাবে!?
জীবাত্মা যদি একাধিক হয় তাহলে বলতে হবে প্রতিটা জীনাত্মা আলাদা। একটা জীবাত্মা আরেকটা জীবাত্মা থেকে আলাদা। আলাদা বললে বলতে হবে অবশ্যই জীবাত্মার একটা সীমানা বা বাউন্ডারি আছে। নয়তো বাউন্ডারী না থাকলে আলাদা জীবত্মা বলা যায় না।
আরো ভালো করে বুঝতে দুটি জীবাত্মা নিয়ে চিন্তা করুন। এখন যদি বলা হয় দুইটি জীবাত্মা। তাহলে জীবাত্মা দুটি একটা আরেকটার থেকে পৃথক। একটা আত্মা আরেকটা থেকে আলাদা। আত্মা দুটির অবশ্যই বাউন্ডারি আছে নয়তো তারা আলাদা থাকতে পারে না। বাউন্ডারি না থাকলে আত্মা দুটি একত্রে মিশে যেত। সুতরাং অবশ্যই তাদের বাউন্ডারি আছে তাই তারা মিশে একাকার হয়ে যায় না। যার বাউন্ডারি বা সীমানা আছে সেটা কখনোই নিরাকার না। আর কোনোকিছু নিরাকার হলে সেটাকে একটা দুইটা এভাবে গণনা করা অসম্ভব। যেমনঃ জলকে কেও বলে না একটা জল, বয়ুকে কেও বলে না একটা বায়ু, আলোকে কেও বলে না একটা আলো। সুতরাং নিরাকরকে কখনোই গণনা করা যায় না। আর নিরাকরের কোনো সীমনা বা বাউন্ডারিও থাকে না। আর দুই পাত্রে রাখা একই ধর্মীয় নিরাকার কোনো কিছু একত্র করলে তারা মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। যেহেতু নিরাকারের কোনো সীমানা নাই।
সুতরাং জীব আত্মাকে একাধিক বললে অবশ্যই মানতে হবে জীব আত্মা সাকার।

তৃতীয়ত,
ত্রৈতবাদ মতে, "ব্রহ্ম/পরমাত্মা/ঈশ্বর নিরাকার। সর্বত্র অনুপ্রবিষ্ট। ঈশ্বর কদাপি সাকার হন না।"
উক্ত মত অনুযায়ী, ব্রহ্ম/পরমাত্মা নিরাকার এবং সর্বত্র অনুপ্রবিষ্ট। জগতের সকল পদার্থ কি বৃহৎ কি ক্ষুদ্র কি স্থূল কি সূক্ষ্ম
, সকল কিছুতে অনুপ্রবিষ্ট। সকল পদার্থের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরমাত্মা অনুপ্রবিষ্ট। এমন কোনো তিল পরিমাণ জায়গায়ও নাই যেখানে ব্রহ্মের অনুপ্রবেশ নাই।
এবার বিবেচনা করি একটা গাছ (বিবেচ্য বিষয় ত্রৈতবাদে ব্রহ্ম, প্রকৃতি/জগৎ, জীবাত্মা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বাধীন সত্ত্বা। তাই গাছ ও ব্রহ্ম/পরমাত্মা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটা সত্ত্বা)। গাছটার প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরমাত্মা অনুপ্রবিষ্ট। গাছের ভেতর বাহির সর্বত্র পরমাত্মা অনুপ্রবিষ্ট। গাছ টা বিবেচনায় আনলে গাছের বিন্দুমাত্র জায়গা খালি নাই যেখানে পরমাত্মা উপস্থিতি নাই। অর্থাৎ গাছের ভিতরে অণুতে পরমাণুতে এমনকি গাছের আত্মায়ও (জীবাত্মা) পরমাত্মা অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছেন।
এবার গাছের ভিতরে পরমাত্মার অবস্থান বিচার করুন তো। গাছটার প্রতিটা অংশে পরমাত্মা থাকলে তাহলে গাছের ভিতর পরমাত্মার যে অংশ আছে তা গাছের মত আকারই ধারণ করে আছে। এখন বিবেচনায় গাছটার ভিতরের পরমাত্মার অংশ টা আনলে পরমাত্মার ঐ অংশ গাছের আকৃতি বিশিষ্ট।


আরো সহজে বললে নিরাকার কোনো বস্তু কোনো সাকার বস্তুর ভিতর সকল অংশজুড়ে অনুপ্রবেশ করলে সেই সাকার বস্তুর ভিতরের নিরাকার অংশ টুকু ঐ সাকার বস্তুর আদলে সাকার রূপ ধারণ করে।
সুতরাং এই ত্রৈতবাদ দর্শন অনুযায়ী ব্রহ্ম সাকার রূপ ধারণে অক্ষম হলেও সাকার বস্তুর মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে পরজীবীর মত সাকার রূপ ধারন করতে পারে। এই মতবাদ মতে দেখা যাচ্ছে ঈশ্বর এতোটাই অক্ষম যে তার অন্য সাকার বস্তু ব্যাতীত সাকার হওয়ার উপায় নাই। আবার এই ঈশ্বরই জগতকে সাকার রূপে তৈরি করতেছেন অথচ তার নিজের সাকার হওয়ার ক্ষমতা নাই!
বলিহারি! এই ত্রৈতবাদ বালকের প্রলাপ ব্যাতীত ইহা আর কি হইতে পারে!

চতুর্থত,
ত্রৈতবাদে ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান বলা হয়। অথচ সর্বশক্তিমানের সংজ্ঞা শুনলে না হেসে পারা যায় না।
তাদের মতে সর্বশক্তিমান অর্থ যিনি সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংসের জন্য অন্য কারো সহায্য গ্রহন করেন না, এজন্য তিনি সর্বশক্তিমান।
বলিহারি! পাঠকগণই বিবেচনা করুন, এটা কি সর্বশক্তিমানের সংজ্ঞা নাকি অন্যের সাহায্য ব্যাতীত সৃষ্টিআদি কার্যকারীর সংজ্ঞা?
সর্বশক্তিমান বলতে তাকেই বুঝায়, সমস্ত শক্তি যার অধীনে। এখন জগতের যে সাকার হওয়ার শক্তি এটাও তার অধীনস্থ শক্তি হতে হবে। নয়তো ঈশ্বরের শক্তি সল্পতা আছে। তার সাকার হওয়ার শক্তি নাই। সে হিসেবে ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান বলা যায় না।
আর এক্ষেত্রে সাকার হতে অক্ষম ঈশ্বর হতে জগৎ একটা গুণে এগিয়ে থাকলো। এই গুণের বিচারে জগৎ ঈশ্বর অপেক্ষা উৎকৃষ্ট।


পঞ্চমত,
ত্রৈতবাদীরা বলে থাকে যে, পরমাত্মা ও জীবাত্মা উভয়েই নিরাকার ও পৃথক হলেও পরমাত্মা জীবাত্মা ও জগত অপেক্ষা সূক্ষ্মতর, তাই পরমাত্মা জীবাত্মা ও জগতে বিস্তৃত।
তারা নিরাকারের সূক্ষ্মতা বলতে কি বুঝায়? আবার সূক্ষ্মাতার অধিকতা বা অল্পতাই বা কীরূপ?
সর্বোতভাবে কোনো বস্তু নিরাকার হলে তার তো সূক্ষ্মতা কম বা বেশি বলে কোনো বিশেষণই থাকা সম্ভব নয়। আর দুইটাই সম্পূর্ণরূপে নিরাকার বলে তাদের ভিন্ন তত্ত্ব হওয়াও সম্ভব নয়। এখানে জীবাত্মা নিরাকার, পরমাত্মাও নিরাকার। এই দুই তত্ত্ব যদি প্রকৃত পক্ষেই নিরাকার হয় তাহলে দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বা ভেদক ধর্ম থাকা অসম্ভব। ১ম পর্বে দেখানো হয়েছে নিরাকার বস্তুর একাধিক ও পৃথক হওয়া সম্ভব নয়। এবার জীবাত্মা ও পরমাত্মা পৃথক হয় কিভাবে? আর তারা সম্পূর্ণ রূপে নিরাকার হওয়ার পরও সূক্ষ্মতার পার্থক্য আবার থাকে কিভাবে?
সূক্ষ্মতার পার্থক্য তো আপাত দৃষ্টিতে নিরাকার বস্তুতে থাকে। এখানে আপাত দৃষ্টিতে নিরাকার বলতে বুঝানো হচ্ছে যে জগতের সকল নিরাকার উপাদান আপাত দৃষ্টিতে নিরাকার হলেও তা কোনো না কোনো সাকার এককে গঠিত। যেমন :- বায়ু-সকার বায়ুর অণু দ্বারা গঠিত, জল- সাকার জলের অণু দ্বারা গঠিত। এখানে বায়ু, জলের তুলনায় সূক্ষ্ম। কেননা বায়ুর অণুগুলোর আন্তঃআাণবিক দূরত্ব জলের থেকে বেশি। অর্থাৎ বায়ুর অণু গুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব জলের অণুগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব হতে বেশি। এজন্য তাদের মধ্যে সূক্ষ্মতা ভেদ আছে। আবার বায়ু ও জল ভিন্ন ভিন্ন সাকার একক তথা অণু দ্বারা গঠিত বলেও তাদের পদার্থভেদ ও ধর্মের ভেদ আছে।
কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, জলের অণুর কোনো প্রকার আকারই নাই। নিরাকার জল।(ভাবতে কষ্ট হচ্ছে?)। আবার ভাবুন বায়ুর কোনো প্রকার অণুই নাই নিরাকার বায়ু। এমন অবস্থায় নিরকার বায়ু ও নিরাকার জলের মধ্যে পূর্বের ন্যায় সূক্ষ্মতার ভেদ ও পদার্থগত ধর্মভেদ আর থাকছে না কোনো মতে। কারণ তাদের ভেদক ধর্মের হেতু যে সাকার একক তাদের গঠনের একক হিসেবে ছিল তা আর নাই। তাদের সূক্ষ্মতার হেতু যে সাকার অণুর দূরত্ব সেই অণুই আর নাই, তাহলে দূরত্ব পার্থক্যের কারণে সূক্ষ্মতার পার্থক্য আসবে কিভাবে?
এবার ত্রৈতবাদীর পরমাত্মা ও জীবাত্মা নিরাকার হলে তাদের মধ্যে কিভাবে পৃথকত্ব ও সূক্ষ্মতার পৃথকত্ব আসতে পারে, যদি তারা প্রকৃত পক্ষেই নিরাকার হয়? নাকি এই জীবাত্মা ও পরমাত্মা কোনো সাকার এককে গঠিত, যার কারণে তাদের মধ্যে উপাদান ও সূক্ষ্মতার পৃথকত্ব আসছে? এমন সাকার এককগুলো তাহলে কি?

ষষ্ঠত,
তারা যে বলে নিরাকার। এই নিরাকারের সংজ্ঞা কী? পূর্বে যেমন বলা হলো, নিরাকার জল( জলের অণুর আকৃতি হীনতা), নিরাকার বায়ু( বায়ুর অণুর আকৃতি হীনতা)। এমন নিরাকার হলে তো সেই বস্তুর অস্তিত্বই থাকছে না। যেমন পূর্বে উল্লিখিত নিরাকার বয়ু ও জলের অস্তিত্ব হওয়া অসম্ভব।
ত্রৈতবাদীগণ জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে নিরাকার বলে। তারা যেভাবে নিরাকারের বর্ণনা দেয় তাতে তো ঐ সত্ত্বাগুলোর উপর অনাস্থা দোষ ও অস্তিত্বহীনতা দোষ এসে পড়ে।
কিন্তু এই নিরাকার বলতে তারা কি বুঝায়? এই নিরাকারের সঙ্গা কি?

সুতরাং, এই তথাকথিত ত্রৈতবাদে এরূপ বেশ কিছু ফাঁক ফোকর দৃশ্যমান হয়। এমন ফাঁক ফোকর যুক্ত দর্শন কখনোই অপৌরুষেয় বেদের দর্শন হতে পারে না।
ত্রৈতবাদ যে দয়নন্দের মনগড়া মতবাদ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইহা সনাতন ধর্মের কোনো দর্শন নয়।


---শ্রী প্রান্ত সাহা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ