প্রতিমায় পুজা বিরোধী অপযুক্তির ধারাবাহিক প্রত্যুত্তর।।
পর্ব-১ (দয়াকান্ড/দ্বিতীয় অংশ)
[দয়াজ্বী'র প্রতিমা পুজা বিরোধী বালখিল্য যুক্তি ও তার প্রতিত্তোর।।]
[দয়াকান্ড/১ম অংশ- এর লিংকঃ https://www.facebook.com/107237157.../posts/255782703028650/
ব্লগ িলংক ,পর্ব-১ (দয়াকান্ড/প্রথম অংশ) : https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2021/08/blog-post_13.html]
প্রথম পর্বের দয়াকান্ডের প্রথম অংশে দেখানো হয়েছে যে জোকার নালায়েকের ব্যকরণ ও শব্দ বিশ্লেষণের অজ্ঞতা হেতু জোকার কিভাবে অর্থের অনর্থ করে বেদ মন্ত্রের স্থুল ব্যাখ্যা দিয়েছে এবং প্রতিমায় পুজোকে আব্রাহামিক ধাচে শিড়ক বানিয়েছে।। তার পাশাপাশি জোকারের পূর্ববর্তী একজন তুখোড় তার্কিক, গবেষক ও সংস্কারক দয়াজ্বী'র অর্থ বিনাশ গ্রন্থে প্রতিমায় পুজা বিরোধী কিছু স্ব-চিন্তিত মতামতের প্রত্যুত্তর দেওয়া হয়েছে।। দয়াজ্বী তার অর্থ বিনাশ গ্রন্থের একাদশ অপোল্লাসে প্রতিমায় পুজা বিরোধী কিছু অপ-যুক্তি দিয়েছেন। তিনি ভক্তি, শ্রদ্ধা, ত্যাগ, সাধনায় (আদৌ চেষ্টা করেছিলেন কিনা সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ) ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে কেবল শব্দ ছলে ও তর্কেই ঈশ্বরের স্ব-চিন্তিত স্বরূপ আরোপ করেছিলেন। তিনি ঈশ্বরকে কিভাবে পেতে চাইবেন সেটা তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এখানে উদার সনাতন সংস্কৃতির আধারে (সনাতন ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া তত্ত্বে বিশ্বাসী নয়) আমার কোন মন্তব্য নেই কিন্তু তাই বলে উনার দেওয়া অপ-যুক্তির আধারে হাজার বছরের সনাতন সংস্কৃতি, সংস্কার, দর্শন ও মহাপুরুষদের দেখানো পথ মিথ্যা হয়ে যায় না। আমি স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন তাই আমার অবস্থান থেকে আমি দয়াজ্বীর অপোল্লাসের প্রত্যুত্তর দিবো।
প্রথম পর্বে আমি তিনটি পয়েন্টে প্রত্যুত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এবার আমি দয়াজ্বীর দেওয়া প্রতিমায় পুজা বিরোধী ১৬ টা অপ-যুক্তির প্রত্যুত্তর দিবো।
প্রথমে ছোটবেলার একটা গল্প শেয়ার করবো। একবার আমার খুব জ্বর হয় এবং মুখের খাদ্য রুচি (স্বাদ) চলে যায়। আমার ছোটভাইয়ের আবদারে আমার মা মিষ্টান্ন রান্না করবে কিন্তু আমি ত সেই মিষ্টান্নের স্বাদ নিতে পারবো না যেহেতু জ্বরের জন্য মুখের খাদ্য রুচি (স্বাদ) চলে গেছে। তখন আমি মা'কে যুক্তি দেখালাম মা ঘোষ কাকার গরুকে সেদিন দেখলাম বাড়ির পাশের ডোবায় ময়লা জল খাচ্ছিলো তাই এই দুধেও সেই ময়লা থাকবে নিশ্চিত তুমি এই দুধ দিয়ে মিষ্টান্ন রান্না করিও না। অর্থাৎ আমি যেহেতু মিষ্টান্নের স্বাদ আস্বাদন করতে পারবো না তাই মিষ্টান্ন রান্না আটকাতে এক শিশুসুলভ যুক্তির আশ্রয় নিয়েছিলাম।। যদিও মা সেদিন শেষ পর্যন্ত মিষ্টান্ন রান্না করেছিলো।
আরেকটা গল্প শেয়ার করি। একবার সব বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম সাইকেল নিয়ে বেড়াতে যাবো। সবসময় যে পথে যাই সে-ই পথেই রওনা হলাম কিন্তু মাঝখানে বাধ সাধলো নিলু (ডাকনাম)। সে উক্ত পথে যাবেই না। সে একবার বলতেছে যে ক'দিন আগে নাকি এই পথে সে বিষধর সাপ দেখে আসছে, আরেকবার বলতেছে দুই মাস আগে এই পথে যাওয়ার সময় তার সাইকেলের চেইন পড়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ নিলু অদ্ভুৎ সব যুক্তি ও কারণ দেখাচ্ছিল উক্ত পথকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। পরে নিলুকে ফেলেই আমরা সবাই উক্ত পথেই রওনা হয়েছিলাম। পরে যদিও শুনেছিলাম যে উক্ত রাস্তার পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় সপ্তাহ খানেক আগে নাথ কাকার গাছের আম চুরি করার জন্য নিলুকে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল।
প্রতিমা পুজা বিরোধী বিভিন্ন শাস্ত্র প্রমাণে হিন্দু পন্ডিত ও হিন্দু সমাজের কাছে ধরাশায়ী হয়ে দয়াজ্বী কিছু বালখিল্য যুক্তি দেন যার প্রত্যুত্তরে আমি বাস্তবিক চিত্র তুলে ধরবো। শিয়ালের লেজকাটা গল্পের সাথে মিলে গেলে সেজন্য লেখক দায়িত্ব থাকবে না।
দয়াজ্বী'র বালখিল্য যুক্তিসমূহঃ
প্রথমতঃ মূর্ত্তিপূজা করা অধর্ম।
প্রত্যুত্তরঃ সনাতনের ধর্ম অধর্ম কি দয়াজ্বী ঠিক করে দিবে? সনাতন ধর্ম কোন ব্যক্তির ইজম বা মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় নি যে মাত্র দুইশো বছর আগে দয়াজ্বী কিছু বলে গেছেন আর আমরা হিন্দুরা তার বক্তব্যকে ঈশ্বরের বাণী হিসেবে মেনে নিবো। তিনি কোন ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষি ছিলেন না যে তার হৃদয়ে ঈশ্বরের বানী প্রকট হয়েছিল। তিনি নিজেই বলেছিলেন তার যে বক্তব্য শাস্ত্র বহির্ভূত তা যেন বর্জন করা হয়। আমিও তাই তার বক্তব্যকে সচেতনভাবে বর্জন করলাম।
ধর্ম শব্দটি আসে সংস্কৃত √ধৃ হতে। এই √ধৃ -এর অর্থ 'ধারণ'। একজন ব্যক্তি তার জীবনে তার যত প্রকার বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে সব মিলিয়ে হয় তার ধর্ম। তার বিশ্বাস, তার পরম্পরাগত শিক্ষা, তারা আচার ব্যবহার ইত্যাদি এই সবই তার ধর্ম। যেভাবে আগুনের ধর্ম দহন করা, জলের ধর্ম শীতলতা, পশুর ধর্ম পশুত্ব, তেমনি মানুষের ধর্ম হয় মনুষত্ব। কিন্তু শাস্ত্র বলে মানুষ উচ্চমার্গীর জীব তাই মানুষকে বিশ্লেষণ করতে লেখা হয়েছে মনুসংহিতা। এই গ্রন্থ অনুসারে মনুষ্য ধর্ম বিবেচিত হবে দশটি গুণ এর মাধ্যমে, যে দশটি গুণের উপস্থিতি তাদেরকে মনুষ্য প্রমাণ করবে।
যথা-
ধৃতিঃ ক্ষমা দম অস্তেয় শৌচং ইন্দ্রনিগৃহ।
ধীঃ বিদ্যা সত্যম্ অক্রোধ দশকম ধর্মস্য লক্ষণম্।।
অর্থাৎ, ধৈর্য, ক্ষমা, সংযত ভাব, চুরি না করা, পরিষ্কার, পরিছন্নতা, ইন্দ্রিয়কে সংযত রাখা, বুদ্ধি, বিদ্যা, সততা এবং রাগ না করা।প্রতিমা পুজায় কি এই দশটি লক্ষ্মণ প্রশ্নবিদ্ধ হয় নাকি প্রতিমা পুজায় জগৎ ও সংসারের জন্য হানি কারক হয়? আব্রাহামিকতার ছায়ায় চিন্তার জগৎ প্রভাবিত হলে মানুষের ভক্তি, শ্রদ্ধার উপর এহেন নোটিশবোর্ড সাটিয়ে দেওয়া সম্ভব তাছাড়া নয়।
দ্বিতীয়তঃ মূর্ত্তিপূজার উপলক্ষে লোকেরা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে দরিদ্র হইয়া পড়ে।
প্রত্যুত্তরঃ প্রতিমা পুজা করে ঠিক কোন লোক দরিদ্র হয়ে গেছে এটা জানার জন্য আশেপাশের প্রায় সকল ব্যক্তির খুজ খবর নিলাম এবং তেমন কাউকেই খুজে পেলাম না যে প্রতিমা পুজা করে হতদরিদ্র হয়ে গেছে। হাজার বছর ধরে বহু রাজা অসাধারণ সব মন্দির ও বিগ্রহ স্থাপন করে গেছেন হাজার বছর পরেও যাদেরকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি অর্থাৎ তাদের সমৃদ্ধির চর্চা করি। সবাই প্রতিমা পুজায় লক্ষ্য কোটি টাকা খরচ করে ঈশ্বরের পুজা করে না, অনেকে নিজের হাতে গড়া প্রতিমা ও ছোট্ট একটা খুপরি মন্ডপেও প্রতিমায় ঈশ্বরের পুজো করেন। এমন বহু উদাহরণ আছে যারা ভক্তি শ্রদ্ধায় পুজা করে ঈশ্বর কৃপায় ধনবান হয়েছেন এবং পরবর্তীতে মহা সমারোহে দরিদ্রের অর্থ সম্পদ দানপূর্বক দশকের পর দশক পুজো করেছেন। অর্থাৎ দয়াজ্বী এখানে প্রতিমা পুজার বিরোধিতা হেতু একটা বালখিল্য যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন।
তৃতীয়তঃ মন্দিরে স্ত্রী পুরুষের মেলামেশা হয়, তাহাতে ব্যভিচার, কলহ-বিবাদ এবং রোগাদি উৎপন্ন হয়।
প্রত্যুত্তরঃ এই যুক্তির চেয়ে সংকীর্ণমনা ও নোংরা যুক্তি আর হতে পারে না এবং এহেন চিন্তা কোন সম্প্রদায়ের মানুষ করে তা আলাদা করে উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করি না।একটা গল্প মনে পরে গেলো। প্রতিদিন ভোরবেলা এক চুর সারারাত চুরি করে পুকুর ঘাটে এসে স্নান করতো এবং প্রতিদিনই পুকুরের উল্টো ঘাটে অন্য আরেক ব্যক্তিকেও স্নান করতে দেখতো। চুর ভাবতো সে-ই ব্যক্তিও সম্ভবত সারারাত চুরি করে এসে পুকুরে স্নান করে। অথচ প্রকৃত সত্য এই যে সেই উল্টো পাশের লোক প্রতিদিন ব্রহ্মমুহূর্তে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে পরিচ্ছন্ন দেহে মন্দিরে গিয়ে নিত্যপূজা করেন।অর্থাৎ যার মন যেমন সে চিন্তাও করে তেমন।।
এবার বাস্তবতায় আসি। আপনারা নিজেরা আশেপাশে দেখুন ত যারা সত্যিকার ভক্তি ও শ্রদ্ধাভরে মন্দিরে গিয়ে পুজা অর্চনা করেন তারা কতজন ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়? আমি এই অব্দি অন্তত সহস্রখানা পুজো মন্ডপ, মন্দির, রথযাত্রা, স্নানযাত্রায় স্ব শরীরে এবং কখনও আমার সহধর্মিণীকে নিয়ে উপস্থিত থেকেছি যেখানে শত সহস্র নারী পুরুষের সমাগম হয়েছে। আমি আজ অব্দি কোন ব্যভিচারের ঘটনা প্রত্যক্ষ করি নি বরং এগুলো ত যব**দের দৃষ্টিভঙ্গি যারা মন্দির প্রাঙ্গনে উপস্থিতই হয় হিন্দু নারীদের উত্যক্ত করতে। দয়াজ্বীর অনুসারীরা যখন বদ্ধ গৃহে নারী পুরুষ একত্রে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যজ্ঞাদি ক্রিয়া করে তারাও কোন ব্যভিচারে লিপ্ত হয় না বলে আমরা বিশ্বাস করি কারণ আমরা পুকুর ঘাটে স্নান করতে যাওয়া চুরের মতো নয় বরং ব্রহ্মমুহুর্তে স্নান করতে আসা পূজারির স্থানে অবস্থান করি।তবে ইদানীং দয়াজ্বীর কিছু অনুসারী মন্দির প্রাঙ্গনে কিছু দুশ্চরিত্র পূজারীদের দ্বারা সংঘটিত অশালীন কর্মকান্ডের উদাহরণ তুলে ধরেন দয়াজ্বীর এই সংকীর্ণ যুক্তিতে জাস্টিফাই করতে। যেখানে হাজার হাজার বছর ধরে লাখ লাখ মন্দিরে শত সহস্র কোটি সনাতনী ভক্ত মন্দির ও পুজো মন্ডপে গিয়ে পুজো করে আসছে সেখানে ১০০ টি ঘটনাও ত দয়াজ্বীর এই সংকীর্ণ যুক্তিকে ভ্যালিডিটি দিতে পারে না।
চলবে...
©স্টিমন অনিক।
0 মন্তব্যসমূহ