সমাজে স্বঘোষিত মানুষের অভাব নেই যারা নিজে যা নয় কিন্তু সেটা হিসেবেই নিজেকে প্রকাশ করে নিরন্তর।
এদের অবস্থা অনেকটা আফিমখোরের শাস্ত্রচর্চার মতো।
সনাতন শাস্ত্র অধ্যয়ন একটা সাধনার বিষয়। শ্রদ্ধা, ভক্তি ছাড়া কেবল জড়-জাগতিক স্থুল ভাবনা থেকে সনাতন শাস্ত্র বিশ্লেষণ করলে অর্থের অনর্থ হবে এবং সেই বিশ্লেষণে আব্রাহামিক ধারার প্রতিফলন হবে।
https://sanatanphilosophyandscripture.blogspot.com/2020/09/blog-post_13.html?m=1
সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যারা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী নয়, অথচ দোকান থেকে একটা মেডিকেল সায়েন্সের সস্তা বই কিনে অথবা দুই পাতা পিডিএফ পড়ে রোগীর জন্য প্রেসক্রিপশন লিখা শুরু করে। শর্টকাট প্রজাতির স্বঘোষিত শাস্ত্রজ্ঞরা ত বইও পড়েনা, গুগল থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু লাইন পড়েই চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে বড় বড় লেকচার করতে থাকে। আর কিছু আহাম্মক ত তাদেরকেই দেবী শ্রেঠি মনে করে তাদের খুপরিতে বানানো অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে বসে।
ইদানীং ঠিক তেমনই কিছু নামধারী স্বঘোষিত পন্ডিতের আবির্ভাব হয়েছে যারা হয় দুপাতা "বেদসার" পড়েছে, নাহয় কটা ব্লগ পড়েছে নাহয় অন্যকোনো স্বঘোষিত বেদজ্ঞের কপি-পেস্ট নিয়ে ফেসবুক কাপাচ্ছে। নিজেদেরকে নিজেরাই বেদজ্ঞ বলে দাবি করে কোনরূপ অধ্যয়ন এবং চর্চা ছাড়াই কেবল তন্ত্র শাস্ত্রের কিছু খন্ডিতাংশকে উপজীব্য করে উঠেপড়ে লেগেছে তন্ত্রকে বেদবিরোধি এক অপ-শাস্ত্র হিসেবে প্রমান করার জন্য।।
যারা শস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং শাস্ত্রচর্চা করেন (পিডিএফ শাস্ত্রজ্ঞ বিবেচ্য নয়) তারা সকলেই জানেন এবং মানেন যে তন্ত্র হলো গুরুমুখী এবং গুহ্য বিদ্যা এবং এই শাস্ত্রের মূলতত্ত্ব কখনোই শাব্দিক অর্থ দ্বারা বিচার্য নয়। সেখানে কিছু নব্য (যাদের পিডিএফ চর্চার বয়স ২ মাস থেকে ২ বছর) স্বঘোষিত বেদজ্ঞ তরুণদের না আছে তন্ত্রবিষয়ক কোনো গুরুমুখী জ্ঞান (কারন বাংলাদেশ তন্ত্রজ্ঞ পন্ডিত নেই), না তারা নিজেরাও তন্ত্রের সমস্ত শাস্ত্র শ্রদ্ধাপূর্ণ অধ্যয়ণ করেছে (কারন ৬৪ টি তন্ত্রের মধ্যে চব্বিশ পঁচিশটারই অনুবাদ হয়েছে মাত্র, তথাপি চার পাঁচটি ছাড়া আর কোনো গ্রন্থই সুলভ নয়, দ্বিগুন টাকা ঢাললেও পাওয়া যায় না, আর পিডিএফ হিসেবে ছয় সাতটার বেশি তন্ত্র পাওয়াই যায় না)।
একারনে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এই পিডিএফ পন্ডিতরা (আদতে কদাচারী) যদি তন্ত্র নিজে নিজে পড়েও থাকে, তবে সর্বোচ্চ দুই তিনটি তন্ত্রই তারা পড়তে পেরেছে অথবা কেবল কিছু খন্ডিতাংশ।
তাহলে আমার প্রশ্ন, তন্ত্রের ব্যাপারে পূর্ণ জ্ঞান না নিয়ে কিংবা শুদ্ধ বিচার না করে কেবল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তন্ত্রের নিন্দায় রত হওয়া কোনো সুশিক্ষিত বা শাস্ত্রজ্ঞ বিদ্বানের কার্য হতে পারে??
আর কথা না বাড়িয়ে সরাসরি অপপ্রচারের প্রত্যুত্তরে চলে যাই।
➤ তন্ত্র কি বেদবিরোধি শাস্ত্র??
এই কথা প্রায় জনের মুখেই শোনা যায় যাদের মস্তিষ্ক ভোগবিলাসী চিন্তায় মগ্ন যে তন্ত্র নাকি বেদবিরোধিদের তৈরী অর্বাচীন গ্রন্থ! ইদানীং নব্য স্বঘোষিত পন্ডিতেরাও এই একই অভিযোগ করে যাচ্ছে অর্বাচীনের মতো৷ অর্থাৎ যে যেমন তার চিন্তার জগতও তেমন।
তাদের দাবীর পক্ষে তারা কুলার্ণবতন্ত্রের নিম্নোক্ত শ্লোকটি উল্লেখ করে,
অর্থাৎ, বেদশাস্ত্র ও পুরাণসমূহ সাধারণ গণিকার মতো। আর এই কুলশাস্ত্র কুলবধূর ন্যায় অন্তরালবর্তী।।
শাস্ত্রচর্চাহীন কদার্যদের বক্তব্য যে, এখানে বেদকে গণিকা অর্থাৎ বেশ্যা বলা হয়েছে তথা বেদের অপমান করা হয়েছে।।। আমরা জানি এক দেশের গালি অন্যদেরশের বুলি অর্থাৎ একই শব্দ এক দেশে প্রচলিত সভ্য শব্দ হলেও সেই শব্দই অন্য দেশে গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাই শব্দের মর্মার্থ না বুঝে শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ অনুচিত। আমরা অনেকের প্রতিরোধ ক্ষমতার পারদর্শীতা বুঝাতে মান্দার গাছের সাথেও তুলনা করি অথচ মান্দার গাছকে অনেকে কণ্টক যুক্ত হওয়ার কারণে এড়িয়েও চলে।
এক্ষণে আমি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার একটা লাইন বলব, "পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।।"
একজন জ্ঞানবুদ্ধিধারী মানুষ মাত্রই বুঝবে যে এখানে সুকুমার রায় উপমা দিয়েছেন কেবল।। কেউ যদি এখন মনে করে, সুকুমার রায় চন্দ্রকে ঝলসানো রুটির সাথে তুলনা করে চন্দ্রের অপমান করছে, তবে সেই মনুষ্য দেহধারীকে আমি চরম উন্মাদের পর্যায়ে ফেলতে বাধ্য হবো।। আসলে শব্দ ও বাক্যের ব্যকরণগত বিশ্লেষণ করতে অসমর্থ হলেই কেবল কেউ উপমান ও উপমিত সমাসের তফাৎ বুঝতে ব্যর্থ হবে।
তন্ত্রের ঐ শ্লোকটির ব্যাপারেও একই বিশ্লেষণ প্রযোজ্য।।
এখানে বেদকে গণিকা বলা হয়েছে তা নিন্দা অর্থে নয়, কেবল উপমা দেওয়ার নিমিত্তে।। গণিকার স্বভাবই হলো সকলের সামনে নিজের দেহকে উন্মুক্ত করা। যেমন প্রকৃতিও সকলের নিকট উন্মুক্ত ও নগ্ন। এখন অনেক কদাচারী এই উন্মুক্ত প্রকৃতিকেও নগ্ন বলে নিজের কামাচারী মনোবৃত্তির স্বাক্ষী দেয়।
ঠিক তেমনি, বেদ সকলেরই পাঠ্য, স্মৃতিশাস্ত্রে ত্রিবর্ণের সকলকেই যথাসময়ে উপনয়ন (উপনয়ন ব্যতীত নয়) ধারন করে বেদপাঠের কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু বেদপাঠ ত্রিবর্ণের সকলের জন্যই বাধ্যতামূলক, তাই বেদের সাথে গণিকার তুলনা দেওয়া হয়েছে।।
কিন্তু তন্ত্র!! তন্ত্র বিষয়ে যাঁদের সামান্যতম ধারনা আছে, তাঁরাও জানেন যে তন্ত্র হলো গুরুমুখী গুহ্যবিদ্যা।। তন্ত্রকে সকলের সামনে প্রকাশ করা হয়না।।
এমনকি তন্ত্রেই বলা হয়েছে গুরু যেন পর্যাপ্ত পরীক্ষা না করে কোনো শিষ্যকেই তন্ত্রের জ্ঞান না দেন, যদি দেন, তবে চন্দ্র, সূর্য যতকাল থাকবে, ততকাল নরকবাস হবে।।।
অর্থাৎ, কুলাচার (তান্ত্রিক আচার) প্রকাশ করিলে মন্ত্রনাশ, কুলহিংসা ও মৃত্যু হতে পারে।
এইকারনে তন্ত্রকে কুলবধূর উপমা দেওয়া হয়েছে। পুরাতন যুগের লজ্জাশীলা বধূরা স্বামী ব্যাতিত কারো সামনে নিজেকে প্রকাশ করতেন না। ঠিক একইভাবে, তন্ত্রশাস্ত্রও উপযুক্ত অধিকারী ব্যাতিত কারো সামনে প্রকাশ্য নয় বলে একে কুলবধূর সাথে তুলনা করা হয়েছে।। তন্ত্র যে বেদবিরোধি নয়, তা তন্ত্র শব্দের অর্থ দ্বারাই প্রমান করা যায়।।
প্রাচীন "মেদিনী" অভিধানে তন্ত্র শব্দের অর্থ "শ্রুতিশাখাবিশেষ" করা হয়েছে। এর থেকে অনুমান করা যায়, প্রাচীন কালে হয়তো তন্ত্র বেদের শাখা রূপেই ছিলো। পরে তা বিস্তৃত হওয়ায় আলাদা মার্গ হিসেবে প্রবর্তিত হয়।।
স্বামী বিবেকানন্দও বলেছেন,,
তন্ত্র বেদেরই সমর্থক, তা কয়েকটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমান করা হলো,,
অর্থাৎ, বেদশাস্ত্রাদি অভ্যাস না করার জন্য, গুরুর অর্চনা না করার জন্য এবং ইন্দ্রিয়নিগ্রহ না করার জন্য মানুষের আয়ুক্ষয় হয়।।
অর্থাৎ, প্রিয়ে, পূর্ণাভিষেকসম্পন্ন, বেদশাস্ত্রার্থতত্ত্ববিদ, দেবতা ও গুরুর প্রতি ভক্তিমান এবং সংযতাত্মা ব্যাক্তিরা তোমার অর্চনা করবে।।
পাঠক, নিজেই বিচার করুন, যে তন্ত্র এটা বলছে যে বেদপাঠ না করলে আয়ুক্ষয় হয় এমনকি বেদজ্ঞ না হলে কূলপূজায়ও অধিকার নেই, সেই তন্ত্র কিকরে বেদবিরোধি হয়???
তন্ত্র নিজের মত সমর্থনে বেদের আশ্রয় নিয়েছে, এমন প্রমান ও অপ্রতুল নয়।।
ভৈরবী চক্রে জাতিভেদ নিষিদ্ধ করার জন্য তন্ত্র বেদের আশ্রয় নিয়ে বলছে,,
অর্থাৎ, এই চক্রে জাতিভেদ নেই। সকলকে শিবতুল্য মনে করা হয়। এইরূপ মত বেদেও প্রতিষ্ঠিত। কারন বেদ বলেছেন সবই ব্রহ্ম।।
মূলত মুণ্ডক উপনিষদের (২/২/১১) "ব্রহ্ম এব ইদং সর্বম্" - এই সমস্ত নিশ্চয়ই ব্রহ্ম, বাক্যটিকে সামনে রেখে তন্ত্র এই উক্তিটি করেছেন।।
গুরুভক্তির মাহাত্ম্য নির্ণয়েও তন্ত্র বেদের সহায়তা নিয়েছে,
অর্থাৎ, দেবি, যারা ভোগমোক্ষার্থী এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব পদের অভিলাষী, গুরুভক্তিই তাদের একমাত্র পথ। অন্য কোনো পথ নেই- এটি বেদবাক্য।
শেতাশ্বতর উপনিষদের (৬/২৩) বাক্যের সমর্থনেই তন্ত্র এই উক্তিটি করেছে।।
এতো উদ্ধৃতি দেওয়ার পরও যদি কারো মনে সংশয় থেকে থাকে, তবে আমি শঙ্করাচার্যের প্রসঙ্গ তুলবো।।
সকলেই অবগত আছেন যে যখন বৌদ্ধদের প্রভাবে ভারতে বৈদিক চর্চা লোপ পেতে বসেছিলো, তখনই শশঙ্করাচার্য তাঁর অমিত প্রতিভাবলে ভারতে বেদের পতাকা পুনরায় উত্তোলন করেছিলেন একা হাতে এবং সেই পতাকা পায়ে হেটে সমগ্র ভারতবর্ষ বয়ে নিয়ে গেছেন একাধিকবার। অবৈদিক মতবাদ যেমন বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি খন্ডন করে শঙ্কর বেদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।।
এখন প্রশ্ন হলো, তন্ত্র যদি বেদবিরোধিই হয় তো শঙ্কর বৌদ্ধ, জৈন দর্শনের মতো তন্ত্রকেও প্রত্যাখান করলেন না কেন??
তিনি তন্ত্রকে প্রত্যাখান তো করেনই নি, বরং তাঁর রচিত "আনন্দলহরি" স্তোত্রে তন্ত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এমনকি তিনি "শাক্তামোদ" প্রভৃতি সংগ্রহ-তন্ত্রও সঙ্কলন করেন!!
অতএব, এখানেই প্রমানিত হয় যে তন্ত্র বেদবিরোধি নয়।। তবে হ্যাঁ, বৌদ্ধ পরবর্তীকালে তন্ত্রে কিছু বেদবিরোধি তত্ত্ব প্রবেশ করেছে বটে।।
নিগমানন্দ সরস্বতী লিখেছেন,,
"........ প্রকৃত তন্ত্রশাস্ত্র অনেক স্থলে এরূপভাবে বিকৃত হইয়া পড়িয়াছে...। বেদ ও সদাচারবিরুদ্ধ কত তন্ত্রগ্রন্থ নূতন রচিতও হইয়াছে।......”
প্রকৃত তন্ত্রশাস্ত্রমধ্যে বেদবিরুদ্ধ ব্যাবস্থা অতি স্পষ্টরূপে নিষিদ্ধ হইয়াছে।
--------------------
----------------------
পাঠক, খেয়াল করুন, শেষোক্ত শ্লোকটি অর্থ হলো সর্বকামপ্রদ পুণ্যবান তন্ত্র অবশ্যই বেদসম্মত।
যেমন তন্ত্র নিজেই বলছে প্রকৃত তন্ত্র বেদসম্মত এবং তান্ত্রিক আচার্যও তা স্বীকার করছেন, তাহলে একথা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে যে তন্ত্রে যদি বেদবিরুদ্ধ কিছু পাওয়া যায়, তা বিকৃত তন্ত্রশাস্ত্র বলেই গন্য করতে হবে, প্রকৃত তন্ত্রশাস্ত্র বলে নয়।।
পরিশেষ নিগমানন্দ সরস্বতীর একটি উক্তি উল্লেখ করে প্রবন্ধের ইতি টানবো,,
"যাহারা তন্ত্রের মর্ম অবগত না হইয়া ভ্রূ-কুঞ্চিত করে, তাহারা তন্ত্রশাস্ত্রানভিজ্ঞ, সন্দেহ নাই।।" ’তান্ত্রিকগুরু’ (পৃঃ১৩৭)
পরবর্তী প্রবন্ধে তন্ত্রে জাতিবিদ্বেষ, নারীর সম্মান, নরবলি বিষয়ক অপপ্রচারের জবাব থাকবে।।
©অগ্নিপুত্র
0 মন্তব্যসমূহ