"কদাচারীদের মহাজন ও সনাতনীদের মহাজন এক নয়।।"


সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী একটি চমৎকার লিখা উপস্থাপন করেছেন যে "মহাজনদের পথই, আমাদের পথ"। এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা উপস্থাপন লিখার দ্বিতীয় অংশে থাকবে। প্রথম অংশে তুলে ধরবো এক কদার্য নরাধিমা সম্প্রদায়ের কৃত শব্দের অপব্যাখ্যা যা এরা প্রতিনিয়ত করে থাকে নিজেদের কু-মতাদর্শ ও বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য এবং শাস্ত্রীয় অর্থের অনর্থ করে তরুণ সমাজকেও বিভ্রান্ত করে চলছে খুব কৌশলে।।
এই নরাধিমা কদার্য সম্প্রদায় বেদের অপব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য ব্যাকরণ ও নিরুক্তের উপর বেশি জোর দেয় অথচ এরা নিজেরা যেখানে ব্যাকরণে প্রাথমিক শ্রেণীর বিদ্যার্থীদের থেকেও দুর্বল সেখানে পাণিনি ব্যকরণ ত এদের কাছে পুরোপুরি দুর্বোধ্যই হবে।
প্রমাণ করে দেই।।
সনাতনীরা শাস্ত্র ও ব্যকরণগতভাবেই মহাপুরুষদের মহাজন বলে যেখানে অশাস্ত্রীয়, অশিক্ষিত নরাধিমা কদার্যদের কাছে মহাজন অর্থ হয়ে যায় কেবল সুদখোর।। ছয় মাস থেকে একবছর পিডিএফ চর্চা করে যখন কেউ শব্দ বিশ্লেষণ করবে তখন শব্দার্থের অনর্থই হবে।
আমরা সবাই আর অন্তত ষষ্ঠ শ্রেনীর বাংলা ব্যকরণ বইটা পড়েছি তারা সকলেই "সমাস" অধ্যায়টুকু পড়েছি যেটা নরাধিমা সম্প্রদায়ের শাস্ত্রজ্ঞরা পড়েছে বলে মনে হয় না, হয়তো এরা টুকলি করে পাশ করেছে নাহলে অটোপাশ।
কর্মধারয় সমাসে স্পষ্ট উদাহরণ আছে, মহৎ যে জন (ব্যাক্তি) তিনি মহাজন।। একইভবে মহান যে রাজা তিনি মহারাজা এবং মহান যে পুরুষ তিনি মহাপুরুষ। নরাধিমাদের নিয়েও সমাস আছে। অধম যে নর তিনিই অধম এবং কু যে আচার সেটাই কদাচার
অর্থাৎ সমস্ত পদ (মহাজন) এর ব্যসবাক্য করলেই স্পষ্ট হয় যেসকল ব্যক্তিরা মহৎ কার্য করে গেছেন তারাই মহাজন এবং মানুষ মাত্রই মহৎ পথকে অনুসরণ করা উচিত তাই মহাজনদের পথই অনুসরণীয়।
সামান্য বাংলা ব্যকরণে সমাস সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই তারা যদি সংস্কৃত শাস্ত্র নিয়ে বাতেলা করে তাহলে সেটা চরম হাস্যকর প্রতীয়মান হয়।
সনাতনের মান্য শাস্ত্রসমূহে মহাজন বলতে কি মহাপুরুষদের নির্দেশ করেছে নাকি নরাধিমাদের ভাষায় সুদখোরদের?
ভাষান্তরে হয়তো বঙ্গদেশে মহাজন অর্থ সুদখোর হয়েছে কিন্তু মূল সংস্কৃত অর্থে বা মূল বাংলা ভাষায় মহাজন অর্থ মহাপুরুষদেরই নির্দেশ করে যা উপরে সাধারণ বাংলা ব্যকরণ দিয়ে প্রমাণ করা হলো। এবার শাস্ত্রের আলোকে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক ব্যক্তি জীবনে সুদের কারবার করা নরাধিমা কদার্যদের সুদার্থ কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
এই যে সনাতনীরা বলছে মহাজনেরা যে পথে চলেছেন সে পথই আমাদের পথ, এটা কি আমাদের মনগড়া কথা?
একদম না! এটা স্বয়ং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কথা!
মহাভারতের বনপর্বের ২৬৭/৮৪ শ্লোকে যুধিষ্ঠির যক্ষের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন -
"বেদা বিভিন্নাঃ স্মৃতয়ো বিভিন্না নাসৌ মুনির্যস্য মতং ন ভিন্নম্।
ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ॥"
অর্থাৎ, বেদ বিভিন্ন তথা বেদের আদেশ ভিন্ন ভিন্ন; এবং স্মৃতিশাস্ত্রও বিভিন্ন; এমন একজন মুনিও নেই যাঁর মত অন্য আরেকজন মুনির মতের তুলনায় ভিন্ন নয়। (এই ব্যবহারিক) ধর্মের মূলতত্ত্ব যদি দেখা যায়, তবে তাও অজ্ঞানের গুহার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে, অর্থাৎ সাধারণ লোকের বুদ্ধির অগম্য। এই জন্য মহাজন যে পথ দিয়ে গিয়েছেন, সেই পথই পথ।
কোনটা ধর্ম এবং কোনটা অধর্ম তা নির্ণয়ে যমরাজের মতোই শ্রেষ্ঠ ছিলেন যুধিষ্ঠির। তাই যুধিষ্ঠিরকে ধর্মরাজও বলা হয়। সেই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির স্বয়ং মহাজনদের পথ অনুসরণ করতে বলেছেন। আমরা কি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের এই কথাকে আদৌ সুদখোরের পথ বলতে পারি যদি না নিজেরা সুদের কারবারি হই?
হিমালয়ের চূড়ায় উঠতে হলে আমাদেরকে পূর্বগামী মহাজনদের পথ অনুসরণ করতেই হয় কারণ তাঁরা সেই চূড়া বিজয় করে এসেছেন এবং পথ সম্পর্কে তারা স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেবন। হিমালয়ের চূড়া আমাদের লক্ষ্য। চূড়া নিজে এসে কখনো আমাদেরকে পথ দেখিয়ে দেবে না। চূড়া তাদেরকেই পথ দেখাবে যারা চূড়াবিজয়ী মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। আমাদের পথ, পাথেয় ও লক্ষ্য সম্পর্কে অর্থগত স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে নাহলে হুট করে নিজেদের সুদের কারবারের প্রভাবে মহাজন অর্থ শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত অস্বীকার করে সুদখোর বানিয়ে দিবে কিছু নরাধিমা
সনাতন শাস্ত্র বাস্তবিক পরিস্থিতির আলোকেই স্পষ্ট নির্দেশ দেয় যেমন মহাপ্রাজ্ঞ মনুমহারাজও কিন্তু মহাপুরুষ তথা মহাজনদের অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
আমরা মনুস্মৃতির (২/১২) নম্বর শ্লোকটি একটু দেখে নিইঃ--
"বেদঃ স্মৃতিঃ সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ।
এতচ্চতুর্বিধং প্রাহু সাক্ষাৎ ধর্মস্য লক্ষণম।।"
অর্থ-- বেদ, স্মৃতিশাস্ত্র, সদাচার [সৎ+আচার,সৎ ব্যক্তির আচার অর্থাৎ মহাজনদের আচরণ কারণ সদব্যক্তির আচরণই সদাচার এটা সকলেই জানেন। প্রশ্ন হতে পারে শাস্ত্রে বর্ণিত আচরণও তো সদাচার হতে পারে। হ্যাঁ হতে পারে, কিন্তু শ্লোকের প্রথমেই বেদ ও স্মৃতির নাম উল্লেখ রয়েছে; আপনারা জানেন সনাতন ধর্মে শাস্ত্রসমূহ শ্রুতি অর্থাৎ বেদ (ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ ও সংহিতাসহিত) ও স্মৃতিশাস্ত্র (ঋষিবিধান ও পুরাণাদি শাস্ত্রসমূহ) নিয়ে গঠিত, তাই এখানে পণ্ডিতগণ মহাজনদের নির্ধারিত পথ ও আচরণকেই সদাচার বলেছেন] ও বিবেকের বাণী এই চারটি ধর্মের সাক্ষাৎ লক্ষণ।
উপরোক্ত আলোচনায় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে এই নরাধিমা কদার্যগোষ্ঠী তাদের অপসংস্কারের ধারাবাহিকতা হেতুই মহাজন শব্দের কদার্থ করেছে যা তারা বেদের অপব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য নিয়মিতই করে থাকে।
কদাচারীরা মহাজন অর্থ সুদখোর বানানোর একটা নোংরা উদ্দেশ্য আছে যেটা এরা তাদের তথাকথিত পিতামহের কাছ থেকেই পেয়েছে।।
নরাধিমারা তাদের লেখায় আদিগুরু শঙ্করাচার্য, রামানুজাচার্য, মধ্ব, নিম্বর্ক ইত্যাদি মহাজনদের/মহাপুরুষ সুদখোর, জমিদার ও জোতদারের সাথে তুলনা করেছে। অথচ সনাতনী মাত্রই উল্লেখিত মহাজনদের পরমগুরু হিসেবে মান্য করে। এই মহাপুরুষদের অপমান করার কুশিক্ষা এরা এদের তথাকথিত পিতামহের কাছ থেকে পেয়েছে যে কিনা মন্দিরের মধ্যেও নারী-পুরুষের ব্যাভিচার খুজেছিলো। যেখানে তাদের পিতামহের চিন্তাভাবনাই ছিলো নিকৃষ্ট সেখানে এরা সভ্য চিন্তাভাবনা ধারণ করবে এটা আশা করাও ভুল।।
ভিন্ন ভিন্ন মহাজন/মহাপুরুষের ভিন্ন ভিন্ন পথে অর্থাৎ নানান মুনির নানান পথে চলে সনাতনীরা বিভ্রান্ত হবে না? লক্ষ্য যদি এক হয় তবে পথ কি ভিন্ন হতে পারে?
বেদ পরবর্তী মতবাদগুলিতে (ধর্ম নয়) কেবল একজনই মহাজন থাকেন, একজন প্রবর্তককেই আদর্শ মানা হয় অর্থাৎ একজনের অটোক্র্যাটিক চিন্তাভাবনাই রিলিজিয়নের নামে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন, বুদ্ধ, তীর্থংকর, যিশু ইত্যাদি। কিন্তু বৈদিক পরম্পরাগত সনাতনধর্মে কোনো একজন মহাজন নেই কারণ প্রতিটি মানুষের চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন নয় এবং সকলের জন্য একই পথ উপযোগী নয়। সনাতন পরম্পরায় বরং অসংখ্য মহাজনের জ্ঞানে, আদর্শে ও সাধনায় প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হয়ে এসেছে সনাতনধর্ম এবং প্রতিটি মানুষ তার স্ব উপযোগী পথে চলার স্বাধীনতা পেয়েছে। এখন কোন নরাধিমা সম্প্রদায় যদি আব্রাহামিক ধারায় একক ব্যক্তির একটিমাত্র পথকেই একমাত্র সঠিক বলে চাপিয়ে দিতে যায় তবে সেটা সনাতনের সমৃদ্ধশালী উদার সংস্কারে গৃহীত হবে না।
কেন কোনো একজন ব্যক্তির মতাদর্শে চলে না বৈদিক সনাতনধর্ম? কারণ হলো স্বয়ং বেদ! হ্যাঁ, বেদের একই বচনকে বিভিন্ন ঋষি বিভিন্নভাবে সত্য হিসেবে প্রতিপাদিত হতে দেখেছেন। বেদ স্বতঃসিদ্ধ স্বতঃপ্রমাণিত সত্য। আর বেদের মহাসত্যের ডায়মেনশন এতটাই সমৃদ্ধ যে কখনোই নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয় 'এটাই একমাত্র সত্য'! 6 এর বিপরীত পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি 9 দেখে। উভয়ই সত্য। বেদ এই সার্বিক সত্যকেই প্রকাশ করে। আর সত্যদ্রষ্টা ঋষিগণ ও মহাজনেরা এই সত্যকে দেখার পথ তৈরি করেন। কোন পথে দাঁড়ালে 6 কে 6 -ই দেখা যাবে এবং কোন পথে দাঁড়ালে 9 কে 9 -ই দেখা যাবে তার পথ তৈরি করেন মহাজনেরাই। যাতে করে ভিন্ন পথে দাঁড়িয়ে 6 কে 9 দেখে আমরা বেদকে অসত্য মনে না করি কিংবা বেদ হতে আগত কোনো দর্শন ও মতবাদকে (দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ ইত্যাদি) অসত্য মনে না করি।
একটা খুব বাস্তবিক উদাহরণ উপস্থাপন করছি।
আমাদের পরম্পরাগত আচার্যরা আমাদেরকে নানান উপায়ে নানাবিধ পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন যা অনুসরণ করে আমরা পরম গন্তব্যে পৌছতে পারি।
এখন স্বাভাবিকভাবেই যৌক্তিক প্রশ্ন এসেছে যে নানান মুনির নানান মত অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন আচার্যদের দেখানো ভিন্ন ভিন্ন পথের মধ্যে কোন পথে হাটবো? ভিন্ন ভিন্ন পথের সন্ধানে ত মানুষ বিভ্রান্ত হবে।।
উত্তরও স্পষ্ট যে আমরা কোন পথ নির্ণয় করবো এবং পালন-বর্জন করবো সেটা নিজেকেই ঠিক করতে হবে প্রয়োজনে সদগুরুর শরণাপন্ন হতে হবে। আমি এক পথে হেটেছি বলে এটাই সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে এবং অন্যরা যে পথ গ্রহণ করলো সেটা সকলের জন্যই অগ্রহণযোগ্য হবে এহেন ভাবনা সম্পূর্ণ আত্মকেন্দ্রিকতার শামিল।।
🔘 বিষয়টা ব্যাখ্যা করি।।
পথ আপনি বা আমিই ঠিক করবো কিন্তু নানান মুনির নানান পরামর্শ আপনার আমার জন্য পাথেয় হতে পারে।।
উদাহরণস্বরূপ ধরুন আপনি ঢাকা হতে চট্টগ্রাম যেতে চান এবং আপনি আপনার জন্য উপযোগী পথের সন্ধান করছেন।
🔹 প্রথম ব্যক্তি আপনাকে পরামর্শ দিলো যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম খুব ভালো বাস সার্ভিস আছে এবং রাস্তাও চমৎকার তাই বাসে যেতে পারেন। এসি, নন-এসি ও লোকাল সব ধরনের বাস সার্ভিসই আছে।
🔹 দ্বিতীয় ব্যাক্তি পরামর্শ দিলেন যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ট্রেনে চলে যেতে পারেন কারণ এতে জার্নিটা আরামদায়ক ও উপভোগ্য হবে এবং দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও কম।
🔹 তৃতীয় ব্যাক্তি পরামর্শ দিলেন যে প্লেনের টিকেট খরচ খুব বেশি না এবং স্থলপথে হুটহাট যানযটও লেগে যায় তাই আকাশপথে চলে যান এতে আপনার সময় বাঁচবে অনেক।।
তিনজন ব্যক্তিই কিন্তু আপনাকে সুপরামর্শ দিয়েছেন এখন আপনি ঠিক করবেন যে কোন পথ আপনার জন্য সুবিধাজনক এবং উপযুক্ত।। আপনি কিন্তু কোন পথককেই ভুল অথবা ভ্রান্ত বলতে পারেন না কারণ আপনি হয়তো আকশপথে গেলেন কিন্তু আরেকজনের জন্য রেলপথই উত্তম হতে পারে তার সামর্থ বিবেচনায় আবার কেউ বাসে যেতে পারেন তার সময় বিবেচনায় যেহেতু ২৪ ঘন্টাই বাস সার্ভিস চলমান।
আপনার আমার জন্য পথের সন্ধান দেওয়া আছে কিন্তু হয়তো আপনার সামর্থ আপনাকে আকাশপথে যাওয়া অনুমোদন করছে কিন্তু আমার জন্য বাস সার্ভিসটাই উপযোগী।
অর্থাৎ এটা শতভাগ যৌক্তিক স্লোগান যে "মহাজনদের পথই, আমাদের পথ" আমরা কোন কদার্য নরাধিমা গোষ্ঠীর পথে হাটবো না।
©স্টিমন অনিক।
সহযোগীতায়: অর্পন গোস্বামী ও জয় চক্রবর্তী

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ