ক'দিন ধরে ফেসবুকে একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে যে ফুসফুসের ব্যায়াম করা ও ফুসফুসের কার্যক্ষমতা মাপার যন্ত্র স্পাইরোমিটারের বিকল্প হতে পারে শঙ্খনাদ তথা শঙ্খ বাজানো।।
এই দাবীর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু এবং শঙ্খনাদের আর কি কি উপকারিতা আছে?
আমাদেরকে আগে জানতে হবে স্পাইরোমিটার কি? স্পাইরোমিটার কয়েক ধরণের হয় তবে ফুসফুসের ব্যায়ামের জন্য ব্যবহার করা হয় Three-ball incentive spirometer.
এটা কিভাবে কাজ করে?
আমাদের ফুসফুস আমাদের শরীরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ অর্গানগুলোর মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে অক্সিজেন এবং শরীরে এই অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের কাজ করে ফুসফুস। হৃদপিন্ড ও মস্তিস্কের সাথে ফুসফুসের তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ মিথস্ক্রিয়া হয় প্রতিনিয়ত।। ফুসফুসের মাধ্যমেই আমরা শরীরে অক্সিজেন গ্রহণ করি এবং কার্বনডাই-অক্সাইড বের করে দেই। ফুসফুসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ট্রাকিয়ার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া চলে প্রকৃতির সাথে৷ ট্রাকিয়া (শ্বাসনালী) ভেতরের দিকে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে ফুসফুসের ভেতরে ঢুকে যায় এবং অনেকগুলো ব্রঙ্কিওলে বিভক্ত হয়ে৷ এই ব্রঙ্কিওলগুলোই বিশুদ্ধ অক্সিজেন ফুসফুসের ভেতর প্রবাহিত করে। ব্রকিওলগুলোর প্রান্তভাগে থাকে অসংখ্য এলভিউলাই (বায়ুথলি) যেগুলো রক্ত প্রবাহের সাথে অক্সিজেন ও কার্বনডাই অক্সাইডের আদানপ্রদান করে।
হৃদপিন্ডের সাথে ফুসফুসের মিথস্ক্রিয়াঃ হৃদপিন্ড হচ্ছে আমাদের দেহে রক্তপ্রবাহের প্রধান মাধ্যম। আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনবাহী রক্ত শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পৌছে দেওয়া এবং শরীরের জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইডবাহী রক্ত বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শরীর থেকে বের করে দেওয়ার কাজটা অনবরত করে যাচ্ছে হৃদপিন্ড। এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে ফুসফুস। ফুসফুসের এলভিউলাই হৃদপিন্ডে অক্সিজেন সাপ্লাই দিয়ে এবং হৃদপিন্ড থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে হৃদপিন্ডকে সচল রাখে।।
মস্তিষ্কের সাথে ফুসফুসের মিথস্ক্রিয়াঃ আমাদের মস্তিষ্কের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ফুসফুস থেকেই যায়। মস্তিষ্কে অক্সিজেন সাপ্লাই কমে গেলে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কমে যায় এবং একসময় ডেমেজ হয়ে যায়। মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত সিগ্ন্যাল দেয় অক্সিজেনের সল্পতার সম্ভাবনা দেখা দিলেও যেমন জলে ডুব দেওয়ার পূর্ব মুহুর্তে মস্তিষ্কের সিগ্ন্যালের জন্যই আমার বড় করে শ্বাস নিয়ে ফুসফুসে অতিরিক্ত অক্সিজেন জমা করার চেষ্টা করি।
স্পাইরোমিটার কিভাবে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়ায়?
স্পাইরোমিটারের নলে মুখ রেখে লম্বা করে দম ভেতরে নিয়ে (শ্বাস) স্পাইরোমিটারের বলগুলো উপরের দিকে তুলতে হবে এবং কিছুক্ষণ রেখে আবার দম ছেড়ে (প্রশ্বাস) দিতে হবে।। এতে করে ফোর্সড এক্সপাইরেটরি ভলিউম (FEV) বাড়ানো যায়। অর্থাৎ ফুসফুস থেকে অধিক বেশি বাতাস বের করে দেয়া যেন পরবর্তীতে অধিক পরিমাণ বাতাস শ্বাস নেয়া যায়। তাতে করে ফুসফুসের বাতাস ধারণের ক্ষমতা বাড়ে।
বিভিন্ন রোগে কিংবা ভাইরাস ও ব্যক্টেরিয়ার আক্রমণে ফুসফুস আক্রান্ত হলে ফুসফুসের এলভিউলাই স্ফীত হয় এবং ব্রঙ্কিওল সংকুচিত হয়ে যায় যার কারণে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। স্পাইরোমিটারের সাহায্যে যখন ব্যায়াম করা হয় তখন ফুসফুসের ব্রঙ্কিওলগুলো প্রসারিত হয় এবং অতিরিক্ত অক্সিজেন প্রবেশ করে ফুসফুসে।। হৃদরোগে আক্রান্ত হলেও ফুসফুসকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয় অক্সিজেন সরবারাহের জন্য তাই ওপেন হার্ট সার্জারির পরও রোগীকে স্পাইরোমিটার দেওয়া হয় ব্যায়াম করার জন্য।
কভিড রোগির জন্য কি স্পাইরোমিটার উপকারী হয়?
কভিড রোগীর ক্ষেত্রেও দেখা যায় করোনাভাইরাস ফুসফুসের এলভিউলাইকে আক্রমণ করে এবং ধীরে ধীরে ব্রঙ্কিওল সংকুচিত হয়ে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। হৃদপিন্ডের সাথে ফুসফুসের অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড আদান-প্রদান করতে পারে না বিদায় এলভিউলাইগুলো স্ফীত হয়ে নিউমোনিয়া পর্যন্ত হয়ে যায়।। কভিড আক্রান্ত রোগীর প্রাথমিক অবস্থায় স্পাইরোমিটার ব্যবহার করলে ফুসফুসের বাতাস ধারণক্ষমতা বাড়ানো যায় যাতে করে ব্রঙ্কিওল সংকুচনের সম্ভাবনা কমে যায়। ফুসফুসকে সম্পূর্ণ কার্যকরী রাখতে পারলে ফুসফুসকে ঘায়েল করতে করোনাভাইরাসকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।।
স্পাইরোমিটারের কার্য কি শঙ্খনাদ দিয়ে হবে?
সনাতন সংস্কৃতি ও পুজার আচারে শঙ্খনাদ অবশ্য করনীয়।। শঙ্খনাদে যে শব্দ হয় সেই শব্দের জন্য প্রয়োজনীয় বাতাস কিন্তু আমাদের ফুসফুসের বায়ুথলী থেকে আসে। শঙ্খে মুখ রেখে লম্বা করে দম নিয়ে (শ্বাস) কিছুক্ষণের মধ্যে ছেড়ে দিলে (প্রশ্বাস) এক চমৎকার ধ্বনি উৎপন্ন হয়।। অর্থাৎ স্পাইরোমিটারে যেভাবে ফুসফুসের ব্যায়াম করা হয় শঙ্খনাদে পরোক্ষভাবে সেই ব্যায়ামই হয়ে যায়।
ভারতীয় আয়ুর্বেদিক ডাঃ কুমুদ এস ওয়াংনু একটি অার্টিক্যাল লিখেন শঙ্খনাদের উপর। সেখানে তিনি লিখেন যে, তার ৭০ বছর বয়সী দাদুর জেনারেল মেডিক্যাল চেকাপ করতে গিয়ে ডাক্তার দেখেন যে তার ফুসফুস সেই বয়সেও সম্পূর্ণরূপে কাজ করতেছে। এর কারণ হিসেবে ডাঃ কুমুদ বলেন তার দাদু প্রতিদিন প্রার্থনার সময় শঙ্খনাদ করতেন।।
শঙ্খনাদের সময় আমরা যখন লম্বা দম নেই (শ্বাস) তখন ট্রাকিয়ার মাধ্যমে অক্সিজেন ফ্লো ব্রঙ্কিওলে প্রবেশ করে এবং এলভিউলাইগুলো বাতাস পূর্ণ হয়ে উঠে। এই প্রক্রিয়ার ফুসফুস বাতাসে পূর্ণ হয়ে প্রসারিত হয়। পুনরায় যখন দম ছেড়ে দেওয়া হয় তখন ফুসফুসের মধ্যেকার বাতাস বের হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার ফুসফুস আরও অধিক পরিমাণ বাতাস গ্রহণ করতে পারে। নিয়মিত কেউ এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে অর্থাৎ প্রতিদিনের প্রার্থনা অন্তত তিনবার করেও যদি কেউ শঙ্খনাদ করে তবে সম্পূর্ণ শ্বসনতন্ত্রের জন্য ব্যায়াম হয়ে যায় এবং একটি শক্তিশালী শ্বসনতন্ত্র গঠিত হয়ে যায়।
শঙ্খনাদের আর কি কি উপকারিতা আছে?
"এশিয়ান প্যাসিফিক জার্নাল অফ হেলথ্ সায়েন্স" এ G. G. Potey, Sai Sailesh Kumar Goothy2, Srilatha Goothy, Ramandeep Singh, V. K. মাহাদিক এরা সবাই মিলে একটা জার্নাল পাবলিশ করেছিলেন।
তাদের কিছু ফাইন্ডিংস ছিল যে, শঙ্খনাদ মানুষের মন ও আবেগের পাশাপাশি দেহের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন মস্তিষ্ক, ফুসফুস, লিভার, হৃদপিন্ডের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।। তারা বলার চেষ্টা করেন যে শঙ্খনাদের ফলে যে ধ্বনি উৎপন্ন হয় সেটা আমাদের মন ও আবাগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ তারা একটা EEG টেস্টের মাধ্যমে দেখেন যে শঙ্খনাদের ফলে যে ধ্বনি উৎপন্ন হয় সেটা আমাদের মস্তিষ্কের শত শত মিলিয়ন নিউরনকে আশ্চর্যজনকভাবে আন্দোলিত করে যাতে করে সেই মূহুর্তে নিউরন থেকে অন্যান্য সকল চিন্তাভাবনা দূর হয়ে যায় এবং আমাদের ব্রেইন নতুন নতুন ভবনার সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকে। এজন্যই প্রার্থনা পূর্বে কিংবা যেকোনো শুভকাজ এমনকি যুদ্ধের পূর্বেও শঙ্খনাদের মাধ্যমে নিজের মনযোগকে আরও তীক্ষ্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তারা বলার চেষ্টা করেন যে মহাবিশ্ব ও মহাজাগতিক ঘটনায় শব্দের গুরুত্ব অনেক। একইভাবে স্নায়ুবিজ্ঞানেও বলা হয় যে মস্তিষ্কের সাথে শব্দের মিথস্ক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই শঙ্খনাদ আমাদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতাও অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ শঙ্খনাদের ফলে সৃষ্ট ফুসফুসের বায়ুপ্রবাহ এবং শব্দ উভয়ই আমাদের মস্তিষ্কের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
https://apjhs.com/index.php/apjhs/article/view/1122
আরেকটা জার্নাল আছে এই বিষয়ের উপর।
International Journal of Research and Scientific Innovation (IJRSI) | Volume VI, Issue VII, July 2019 | ISSN 2321–2705
"Significance and Health Benefits of Conch Shell"
Pushpa K, Sanjana T
(Department of Electronics and Communication, BMSCE, Bangalore, India)
সেখানেও মস্তিষ্ক ও ফুসফুসকে শক্তিশালী এবং কার্যকারী করতে শঙ্খনাদের গুরুত্ব তুলে ধরেন।।
তাছাড়া আরও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে শঙ্খনাদের সময় আমাদের শরীরে অভ্যন্তরীণ রেকটাল মাসেলেরও ব্যায়াম হয় যাতে আমাদের হজমশক্তি বেড়ে যায় অনেকটা।
তাছাড়া নিয়মিত শঙ্খনাদ করলে আমাদের মুখমন্ডলের প্রসারণের কারণে স্কিনের সূক্ষ্ম ভাজ গুলো মিলিয়ে যায় ফলে মুখমন্ডলের বলিরেখাগুলো ধীরে ধীরে মুছে যায়।।
উপরোক্ত আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বার্তা দেওয়া যায় যে, সম্প্রতি যেহেতু বিশ্বব্যাপী কভিডের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে তাই আমাদের সকলেরই উচিত যে আমাদের ফুসফুস, হৃদপিন্ড ও মস্তিষ্ককে আরও বেশি শক্তিশালী ও কার্যকারী করে তুলতে হবে।৷ উপরের আলোচনা থেকে এটা ত স্পষ্ট যে প্রতিদিন প্রার্থনার সময় অন্তত তিনবার করেও যদি কেউ শঙ্খনাদ করে তবে তাকে ফুসফুস, হৃদপিন্ড ও মস্তিষ্কের জন্য আলাদা কোন ব্যায়াম করার আবশ্যকতা নেই।।
সনাতন সংস্কৃতি ও আচারে যেসকল পদ্ধতি প্রচলিত আছে সবগুলোর পেছনেই কোন না কোন বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে। আমরা আমাদের স্থুল বিচারবুদ্ধিতে অনেককিছুকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারি কিন্তু সেটা কেবলই আমাদের অজ্ঞতা থেকে।।
জয় সনাতন
©স্টিমন অনিক।
0 মন্তব্যসমূহ