হনুমানচরিত।।


মহাবলী হনুমান সমগ্র পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পরমভক্ত হিসেবে।।

বাল্মিকী রামায়ণের পৃষ্ঠাজুরে বর্ণনা করা হয়েছে মহাবলী হনুমান প্রতি মুহূর্তে কিভাবে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে সঙ্গ দিয়ে গেছেন।।
সুমেরী পর্বতে বাস করতেন বানররাজ কেসরী এবং তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী অঞ্জনি। পবনদেবের আশীর্বাদে বানররাজ কেসরী ও দেবী অঞ্জনির ঘর আলো করে চৈত্র মাসের শুক্লা পক্ষের পূর্ণিমা (পঞ্চদশী) তিথিত এলেন ভক্তশ্রেষ্ঠ মহাবলী হনুমান। মহাবলী হনুমান অঞ্জনিপুত্র ও পবনপুত্র নামেও জগদ্বিখ্যাত হন।
হনুমান অর্থ কি?
হনুমান অর্থ হলো যিনি সকল অহংকারকে নাশ করেছেন অর্থাৎ যিনি নিজের মধ্যেকার সকল অহংকারকে বিসর্জন দিতে পেরেছেন। অহংকারকে জয় করতে হলে জ্ঞানে ও গুণে উত্তম হওয়া প্রয়োজন এবং মহাবলী হনুমান মহাজ্ঞানীই ছিলেন।।
ভক্ত প্রবর (আরেকজন রাম ভক্ত) তুলসীদাস তাঁর রচিত হনুমান চালিশায় সেটাই লিখেছেন,
"জয় হনুমান জ্ঞান গুণ সাগর।"
অর্থাৎ মহাবলী হনুমানের জ্ঞান ও গুণ ছিল সমুদ্রের মতো।
সমুদ্রের জলরাশি যেমন অনন্ত তেমনি মহাবলী হনুমানের জ্ঞানও ছিল অনন্ত।
মহাবলী হনুমান যে মহাজ্ঞানী ছিলেন এর সত্যতা বাল্মিকী রামায়ণেই স্পষ্ট উল্লেখ আছে।
ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ভ্রাতা লক্ষ্মণকে বলছেন,
"তমভ্যভাষ সৌমিত্রে সুগ্রীবসচিবং কপিম্।
বাক্যজ্ঞং মধুরৈবাক্যৈঃ স্নেহযুক্তমরিন্দমম্৷৷"২৭
সৌমিত্রে(লক্ষ্মণ) ! এই সুগ্রীবসচিব, কপিবর হনুমানের
সঙ্গে তুমি বাক্যালাপ করো। ইনি বাকুশল, মধুরভাষী, স্নেহশীল এবং শত্রুদমনকারী।
"নানৃগ্বেদবিনীতস্য নায়জুর্বেদধারিণঃ নাসামবেদবিদুষঃ শক্যমেবং বিভাষিতুম্৷৷" ২৮
যিনি ঋগ্‌বেদে শিক্ষিত হননি, যজুর্বেদ অভ্যাস করেন নি, সামবেদে যিনি বিদ্বান নন তিনি কীভাবে এইরূপ বাক্যালাপে সক্ষম হন?'
"নূনং ব্যাকরণং কৃৎস্নমনেন বহুধা শ্রুতম্।
বহু ব্যাহরতানেন ন কিঞ্চিদপশব্দিতম্।।" ২৯
ইনি নিশ্চয়ই সমগ্র ব্যাকরণশাস্ত্র বহুবার স্বাধ্যায় করেছেন অর্থাৎ উত্তমরূপে অনুশীলন করেছেন, কারণ বহুকথা বললেও ইনি কোনো অপশব্দের প্রয়োগ করেন নি।
"ন মুখে নেত্রয়োশ্চাপি ললাটে চ ভ্রুবোস্তথা।
অন্যেষ্বপি চ সর্বেষু দোষঃ সম্বিদিতঃ ক্বচিৎ।।" ৩০
বাক্যস্ফুরণকালে এঁর মুখমন্ডলে, নয়নযুগলে, ললাটে বা ভ্রুমধ্যে কোনো দোষ লক্ষিত হয়নি।
"অবিস্তরমসন্দিগ্ধমবিলম্বিতমব্যথম্।
উরঃস্থং কন্ঠগং বাক্যং বর্ততে মধ্যমস্বরম্।।" ৩১
ইনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথা বলেননি, বাক্যে বা অর্থে কোনো সন্দেহ সৃষ্টি করেননি, শব্দ উচ্চারণের ক্ষেত্রে কোনো আড়ষ্টতা বা বিলম্বিত ভাব লক্ষ্য করা যায়নি। বক্ষ ও কন্ঠ থেকে উৎসারিত মধ্যমস্বরে ইনি সমস্ত বাক্যসমুহ উপস্থাপিত করেছেন।
"সংস্কারক্রমসম্পন্নামদ্ভুতামবিলম্বিতাম্।
উচ্চারয়িত কল্যাণীং বাচং হৃদয়হর্ষিণীম্।।" ৩২
এঁর উচ্চারিত কল্যাণময় বাণীতে রয়েছে ব্যাকরণের সংস্কার, যথাযথ পদবিন্যাসের ক্রম এবং অদ্ভুত অবিলম্বিততা, যা সমগ্ররূপে হৃদয়ে আনন্দদানকারী।
"অনয়া চিত্রয়া বাচা ত্রিস্থানব্যঞ্জনস্থয়া।
কস্য নারাধ্যতে চিত্তমুদ্যতাসেররেরপি।।" ৩৩
হৃদয় কন্ঠ মূর্ধা এই তিন স্থান দ্বারা স্পষ্টরূপে অভিব্যক্ত এই বিচিত্র বাণী শুনে কারি বাসিত অপ্রসন্ন থাকে? তরবারি দ্বারা হত্যা করতে উদ্যত শত্রুর হৃদয়ও এই মঙ্গলকারী বাণীতে প্রসন্ন হবে।
"এবংবিধো যস্য দূতো ন ভবেৎ পার্থিবস্য তু।
সিদ্ধ্যন্তি হি কথং তস্য কার্যাণাং গতয়োঅনঘ।।" ৩৪
হে নিষ্পাপ লক্ষ্মণ! এইরূপ দূত যে রাজার না থাকে,তার কার্যসিদ্ধি কেমন করেই বা হতে পারে!
"এবং গুণগণৈর্যুক্তা যস্য স্যুঃ কার্যসাধকাঃ।
তস্য সিদ্ধ্যন্তি সর্বেহর্থা দূতবাক্যপ্রচোদিতাঃ।।" ৩৫
এইরকম গুনসংযুক্ত এবং কার্যসাধক দূত যে রাজার আছে তাঁর সকল কার্যই দূতের এইপ্রকার বাক্যালাপের দ্বারা সিদ্ধ হয়।
(কিষ্কিন্ধা কান্ড, ৩য় সর্গ)
কেন তিনি ভক্তশ্রেষ্ঠ?
মহাবলী হনুমান নিজেকে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের চরণে সমর্পন করেছিলেন, তিনি নিত্য রাম নাম জপ করতেন এমনকি তাঁর হৃদয় চিরে কেবল শ্রীরামের প্রতিচ্ছবিই পাওয়া যায়।।
কে তিনি মহাবলী?
মহাবলী হনুমান ছিলেন মহা শক্তিধর। তাঁর গধার আঘাতে বহু রথী মহারথী নিমিষেই কুপুকাত হয়ে যেতো। মহাবলী হনুমান সকল বিদ্যায় ছিলেন পারদর্শী তাই প্রাচীন ভারতের সকল গুপ্তবিদ্যায় তিনি ছিলেন পারদর্শী।। নিমেষেই বায়ুর বেগে স্থান পরিবর্তন ও দেহের আকৃতি পরিবর্তন সবই ছিল তাঁর নখদর্পনে।।
সুন্দরকান্ডের প্রথম সর্গের (৪০-৪৪) শ্লোকে স্পষ্ট উল্লেখ আছে।
মহাবলী হনুমান বলেছেন,
"মাতা সীতাকে যদি আমি লঙ্কায় না পাই তবে আমি এই বায়ুর বেগেই দেবলোকে গমন করব, সেখানেও যদি না পাই তবে লঙ্কাদিপতি রাবণকে তার সম্পূর্ণ লঙ্কারাজ্যসহ তুলে নিয়ে আসবো। এরূপ বলেই বানরোত্তম শ্রী হনুমান কোনরূপ বাধাবিঘ্ন না মেনেই আকাশের দিকে উড়ে গেলেন।"


একই সর্গের ৫৮ নং শ্লোকে বলা হচ্ছে,
বায়ুমার্গে গতিশীল শ্রীহনুমানের আগুনের মতো দুই চোখ যেন পাহাড়ের দাবানলের মতো প্রকাশিত হতে লাগলো।
বায়ুর বেগে পরাক্রমশালী হনুমান লঙ্কার অশোক বনে পৌছে গেলেন।। সেখানে মাতা সীতার সাথে সাক্ষাৎ হলো এবং ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পক্ষ থেকে মাতা সীতাকে উদ্ধারের সন্দেশ দিলেন।
মহাবলী হনুমান নিজেই বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রাবণের রাজ ভবনে পৌছে গেলেন।।
সুন্দরকান্ডের সর্গ-৫৩ ও (৫-৯) শ্লোকে দেখা যাচ্ছে।
রাবণের আদশে রাক্ষসসেনারা শ্রীহনুমানের পুছে কাপড় প্যাচিয়ে সেখানে ক্রমাগত তৈল মর্ধন করতে লাগলো। মহা শক্তিধর হনুমানও নিজের আকার বৃদ্ধি করতে লাগলো। মহাবলীর পুছে যখন রাক্ষসসেনারা আগুন ধরিয়ে দিলো তখন শ্রীহনুমানের মুখন্ডল প্রাতঃকালীন অরুণের ন্যায় টগবগ করতে লাগলো এবং তিনি দেদীপ্যমান পুছ দিয়ে রাক্ষসদের প্রহার করতে লাগলেন তারপর মহাবলী হনুমান স্বর্ণ লঙ্কা আগুনে ভস্মীভূত করে দিলেন।।
আরেকটি ঘটনা পাওয়া যায় যে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের প্রিয় ভ্রাতা লক্ষ্মণ যখন বাণাঘাতে ধরাশায়ী হলেন তখন বৈধ্যরাজ সুষেণ হনুমানকে বললেন—এখান থেকে শীঘ্র তুমি মহোদয় পর্বতে চলে যাও। জাম্ববান তোমাকে এই পর্বতের কথা আগে বলেছিলেন। এর দক্ষিণ শিখরে মহৌষধি লতা জন্মায়, তা এখনই নিয়ে এসো। মহৌষধিগুলি হল—বিশল্যকরণী, সাবর্ণকরণী, সঞ্জীবকরণী এবং সন্ধানী। হনুমান আর দেরী করলেন না। সেই পর্বতে গিয়েই উপস্থিত হয়ে ঔষধি গাছগুলি খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু বুঝতে না পেরে চিন্তিত হলেন। ভাবলেন— যদি বিশল্যকরণী না নিয়ে যাই, তাহলে সময় চলে যাবে সুতরাং তিনি সময় অতিবাহিত না করে পুরো পর্বতকেই উঠিয়ে নিয়ে আকাশমার্গে চলে এলেন।
(বাল্মিকী রামায়ণ, যুদ্ধকান্ড, সর্গ-১০১, শ্লোক ৩৬-৪১)

সত্যই শ্রীহনুমান ছিলেন মহাবীর, লঙ্কাযুদ্ধে তাঁর বীরত্বের খ্যাতি সর্বত্রই। তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন কর্মী ও অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা। তাইতো তুলসীদাস তাঁর রচিত হনুমান চালিশায় লিখেছেন,
"হাথ বজ্র ও ধ্বজা বিরাজে, কান্ধে মুঞ্জ জানিউ সাজে।"
(তোমার হাতে ধ্বজ ও বজ্র রয়েছে, কাঁধে রয়েছে পবিত্র উপবীত)
"শঙ্কর শুভান কেশরী নন্দন তেজ প্রতাপ মহা জঙ্গবন্দন।"
(শিবের অবতার এবং কেশরীর সন্তান, তোমার সাহস ও ঐশ্বরিক শক্তিকে সারা বিশ্ব পুজো করে)
কেন তিনি বজরংবলি?
মহাবলী হনুমানের শরীর ছিল হীরের ন্যায় মজবুত যা দেবরাজের ইন্দ্রের বর্জ্রের আঘাতেও অক্ষত ছিল তাই তাঁকে বজরংবলিও বলা হয়।।
কেন তিনি সংকটমোচক?
রামায়ণের পাতায় পাতায় উল্লেখ আছে যে যেখানেই সংকট সেখানেই মহাবলী হনুমান ত্রানকর্তা হিসেবে উপস্থিত, অর্থাৎ তিনি তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বাহুবল দিয়ে যেকোনো সংকটের অবসান করে দিয়েছেন।।

জয় শ্রী মহাবলি হনুমান।।

© স্টিমন অনিক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ