নমস্কার- একটি সনাতনী অভিবাদন।


★নমস্কার কি? কেন করা হয়? তাৎপর্য কি নমস্কারের?

নমস্কার (নমস্ + কার) শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষার নমস্কার (সংস্কৃত: नमस्कार, উচ্চারিত [nəməskaːrə]) শব্দ থেকে, নম এবং কৃ ধাতুর সাথে ঘঞ্ প্রত্যয়ের সংযুক্তিতে সৃষ্ট কার (কৃ + ঘঞ্) শব্দের সন্ধিতে। ক ধ্বনিটির আগে নমঃ শব্দটি বসায় সন্ধির জন্য তা নমস্ হয়েছে।

নম কথাটির অর্থ 'প্রণাম', 'অভিবাদন', 'সম্মাননা' এবং কার কথার অর্থ 'কার্য' বা 'করা' ('কৃ' ধাতুর কর্ম কারক)। অর্থাৎ, নমস্কার কথাটির আভিধানিক অর্থ হল "প্রণাম করা" বা "সম্মান" করা।

“যো দেবো অগ্নৌ যো অপসু যো বিশ্বং ভূবনাবিবেশ য ৷
ওষধীষু যো বনস্পতি তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ॥”
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (২/১৭)

অনুবাদঃ যোগ যেমন পরমাত্মার দর্শনের সাধন বা উপায়, নমস্কারাদিও অনুরূপ বলিয়া তাঁহাকে নমস্কার জানাই।

অর্থাৎ পরমাত্মাকে সম্মান জানানোর একটা প্রক্রিয়া হিসেবেও নমস্কার শাস্ত্রসম্মত।

কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কিংবা সমর্পনের ক্ষেত্রেও নমস্কার শব্দের ব্যবহার আছে।

"নমস্তে স্ত্বায়তে নমো অস্তু পরায়তে। নমস্তে রুদ্র তিষ্ঠতে আসীনাযোত তে নমঃ।।"
অথর্ববেদ (১১/২/১৫)

অনুবাদ: নমস্কার তোমায়(কেননা) আমাদেরকে দেয়া চৈতন্যের জন্য, হে রুদ্র তোমায় নমস্কার কেননা তুমি ই এই বিবেকরুপে আমাদের মাঝে অবস্থান কর।

শ্রীমদভগবদগীতার ১১/৩৯-৪০ শ্লোকদ্বয়ে অর্জুন বার বার পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে নমস্কার করে ভগবানের প্রতি ভক্তের সমর্পন প্রকাশ করেছেন।

"বায়ুর্যমোহগ্নির্বরুণঃ শশাঙ্কঃ
প্রজাপতিস্ত্বং প্রপিতামহশ্চ।
নমো নমস্তেহস্তু সহস্রকৃত্বঃ
পুনশ্চ ভূয়োহপি নমো নমস্তে।।"

অনুবাদঃ তুমিই বায়ু, যম, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র, প্রজাপতি ব্রহ্মা ও প্রপিতামহ। অতএব, তোমাকে আমি সহস্রবার প্রণাম করি, পুনরায় নমস্কার করি এবং বারবার নমস্কার করি।

"নমঃ পুরস্তাদধ পৃষ্ঠতস্তে
নমোহস্তু তে সর্বত এব সর্ব।
অনন্তবীর্যামিতবিক্রমস্ত্বং
সর্বং সমাপ্নোষি ততোহসি সর্বঃ।।"

অনুবাদঃ হে সর্বাত্মা! তোমাকে সম্মুখে পশ্চাতে ও সমস্ত দিক থেকেই নমস্কার করছি। হে অনন্তবীর্য! তুমি অসীম বিক্রমশালী। তুমি সমগ্র জগতে ব্যাপ্ত, অতএব তুমিই সর্ব-স্বরূপ।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেও জ্যেষ্ঠ, কনিষ্ঠ সকলকেই নমস্কার দিতেন এবং মহাভারতের পাতায় পাতায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

শুধু পরমেশ্বরের প্রতি সমর্পনই নয় মানবজাতিকে অভিবাদন জানতেও "নমস্কার" উচ্চারিত হয়।

কৃষকদের অভিনন্দন জানাতে গিয়ে বলা হয়েছে,
"নমস্তে লাঙ্গলেভ্যো নম… বিরুত্ক্ষেত্রিযনাশন্যপা।"
 অথর্ববেদ (২/৮/৪)

অর্থাৎ, যারা লাঙ্গল ও চাষের মাধ্যমে জমিতে ফসল ফলান তাদের জানাই নমস্কার।

অভিবাদনরুপে নমস্কার প্রদানের উৎকৃষ্ট উদাহরন যজুর্বেদের নিম্নলিখিত মন্ত্রটি-

"নমো জ্যেষ্ঠায় চ কনিষ্ঠায় চ নমং পূর্বজায় চাপরজায চ 
নমো মধ্যমায় চাপগল্ভায় চ নমো জঘন্যায় চ বুধ্ন্যায় চ।।"
যজুর্বেদ (১৬/৩২)

অনুবাদঃ নমস্কার জ্যেষ্ঠদেরকে, নমস্কার কনিষ্ঠদেরকে, নমস্কার উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, ধনী- গরীব, জ্ঞানী, স্বল্পজ্ঞানী সকলকে!

অর্থাৎ, এ থেকে আমরা জানতে পারি যে নমস্কার এমন ই এক অনন্য অভিবাদন যাতে ধনী-গরীব,ছোট-বড়,শিক্ষিত- অশিক্ষিত ভেদ নেই।

অতঃপর বৈদিক যুগ থেকেই সম্পুর্ন আর্যবর্তে সকল মানুষ পারস্পরিক অভিবাদন (গ্রিটিংস) হিসেবে "নমস্কার" (নমস্তে/প্রণিপাত) এর ব্যবহার শুরু করে।
সিন্ধু সভ্যতায় খননকার্যে প্রচুর পুরুষ ও নারীর টেরাকোটা মূর্তি পাওয়া গেছে, যারা নমস্কার ভঙ্গিরত (অঞ্জলি মুদ্রা)। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এই মূর্তিগুলির আনুমানিক সময়কাল নির্ধারণ করেছেন ৩০০০ থেকে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। অর্থাৎ অন্তত ৫০০০ হাজার বছর আগে থেকেই এই "নমস্কার" এর প্রচলন হয়ে আসছে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে সনাতন ধর্মালম্বীরা কেন ছোট বড় ধনী গরীব যেকোন মানুষকে দেখলেই "নমস্কার" অভিবাদন জানায়!

১৯৩৩ সালে বিশ্ব মহা ধর্ম সম্মেলনে ডঃ মহানামব্রত ব্রহ্মচারীজী নমস্কারের একটি স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেন।

"সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে প্রতিটি জীবের মধ্যে ঈশ্বর বাস করেন। ঈশ্বর দু ভাবে জীবের দেহে বাস করেন । এক জন সগুন অপর জন নির্গুণ । সগুণ ঈশ্বর জীবের দেহে আছেন জীবাত্মা রূপে আর নির্গুণ ঈশ্বর আছেন পরমাত্মা রূপে । আমরা যখন একজন অপরজনকে দেখি তখন নমস্কারের মাধ্যমে জানাই আমার সকল হৃদয় মন অঙ্গাদি দিয়ে আপনার মধ্যে যে ঈশ্বর বাস করছেন তাকে অভিবাদন জানাচ্ছি ।"

অর্থাৎ নমস্কারের মাধ্যমে আমার সকল অহংকার, দম্ভ আমার সামনের ব্যাক্তিটির নিকট সমর্পন করছি যার মধ্যে পরমাত্মার বাস। আমরা সূর্য, জল, পাহাড়, আকাশ সম্পূর্ণ প্রকৃতিকে নমস্কার করি কৃতজ্ঞচিত্তে। এজন্য আমরা অঞ্জলি মুদ্রায় এই নমস্কার অভিবাদনটি করি।

★অঞ্জলি মুদ্রা কি?

অঞ্জলি হচ্ছে নিজেকে সমর্পন করা আর মুদ্রা হচ্ছে ভঙ্গি। অঞ্জলি মুদ্রায় আমরা সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন পূর্বক অভিবাদন জানাই। দুই হাত জোড় করে বক্ষদেশের মাঝখানে রেখে আংশিক মাথা নত করে এই অভিবাদন জানানো হয়। এই মুদ্রায় হাত দুটো জোড় করে হৃদয় চক্রে রাখা হয় বলে একে হৃদয় মুদ্রাও বলা হয়। অর্থাৎ হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দিয়ে সামনের ব্যক্তিটিকে অভিবাদন জানানো হয়।
অঞ্জলি মুদ্রার একটা বিশেষত্ব আছে। সমগ্র পৃথিবীতে যোগসাধনা কিংবা যোগাসনে প্রত্যেকে এই মুদ্রার ব্যবহার করে। কারন এই মুদ্রায় আমাদের মন শান্ত থাকে, মন একাগ্র হয় আমাদের মস্তিষ্কের দুই দিকের ব্রেইনের সাথে সংযোগ স্থাপন হয় এবং বক্ষের সবগুলো অস্থির মধ্যে ফ্লেক্সিবিলিটি তৈরী হয়। অঞ্জলি মুদ্রায় যখন হাত দুটো জোড় করা হয় তখন হাতের কব্জা, আংগুল ও পেশিতে এক ধরনের ফ্ল্যাক্সিবিলিটি তৈরি হয় যেটা আমাদের সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে পড়ে তাই যেকোন যোগাসনের শুরু, মধ্যে ও শেষে অঞ্জলি মুদ্রার প্র্যাক্টিস করা হয়।

আমরা মহাত্মা গৌতম বুদ্ধের যে মূর্তি দেখি সেখানেও তিনি অঞ্জলি মুদ্রায় অধীষ্ঠিত অবস্থায় দেখা যায়।

অঞ্জলি মুদ্রায় যেকেউ "নমস্কার" উচ্চারণ না করেও অভিবাদন সেড়ে নিতে পারে।

অর্থাৎ পরমেশ্বরের সামনে যখন আমরা নিজেকে পুরোপুরি সমর্পন করি তখনও আমরা অঞ্জলি মুদ্রায় নমস্কার করি আবার যখন কোন ব্যাক্তি বিশেষকে আমরা অভিবাদন, সম্মান, শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা জানাই তখনও অঞ্জলি মুদ্রায় নমস্কার করি। অঞ্জলি মুদ্রা ও নমস্কার দুটোই আসলে সমার্থক এবং এর মাধ্যমে আমরা আমাদের ভেতরের অহংকার ও দম্ভকে বিসর্জন দিয়ে সর্বব্যাপ্ত পরমাত্মার কাছে নিজেকে সমর্পন করি।

©স্টিমন অনিক

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ