💠নারী পূজস্য💠

 💠নারী পূজস্য💠

🔳 নারী হলেন আদ্যাশক্তি মহামায়ার স্বরূপ। নারী সর্বদা যুদ্ধরত, নারী সর্বদা পালনরত এবং নারী সর্বদাই সৃষ্টিরত। যে নারী আমাদের সমাজে অবলাজাতি হিসেবে বিবেচিত সেই নারীই সংসারের কল্যাণে ও অসুর (পাপাচারী, কামাচারী) বিনাশে হয়ে উঠেন রণচণ্ডী৷ নারীই হয়ে উঠেন অন্নপূর্ণা (আহার দাত্রী), নারীই হয়ে উঠেন জগদ্বাত্রী আবার নারীই হয়ে উঠেন দুর্গতিনাশিনী শ্রী দুর্গা। অর্থাৎ নারীই হলেন স্বয়ং প্রকৃতিস্বরূপা।

🔲 অথচ সৃষ্টির আদি হতেই নারীজাতি বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়ে আসছে। নারী যেন কেবল ভোগ্যপণ্য হিসেবেই বিবেচিত এই স্বঘোষিত পুরুষতান্ত্রিক নষ্ট সমাজে। তথাকথিত সমাজপতি পুরুষজাতির কামাতুর দৃষ্টি ও কামাচারী মন হতে নারীর রেহাই নেই কোনকালেই। সেই কাম যখন লালসায় রূপ নেয় তখন হিংস্র পশুর মত ঝাপিয়ে পরে নারীদেহের মাংস্পিন্ডে। চিত্রটা স্পষ্ট ফুটিয়ে তুলতে কল্পনা করতে পারেন যে একটা হিংস্র ব্যাঘ্র তাড়া করছে এক নিরীহ হারিণীকে আর সেই হরিণী প্রাণপণ ছুটছেই। খুব ভাগ্যবান না হলে সেই হরিণীর মুক্তি নেই ব্যাঘ্রর থাবা হতে।

🔳 রাণী পদ্মাবতীর গল্প অনেকেই জানেন যে কিভাবে নিজের সতীত্ব রক্ষায় সহস্র সখী সমেত জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে ঝাপিয়ে পড়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতে স্বঘোষিত কুলিন ব্রাহ্মণ সমাজে "স্তন কর" এর মত ভয়াবহ কুপ্রথার প্রচলনও ইতিহাসের পাতায় ডুকরে কাঁদে।

🔳 যুদ্ধ মানেই নারীর উপর নেমে আসা নরকযন্ত্রণা। যুদ্ধক্ষেত্রে নারী মাত্রই যেন ভোগ্যপণ্য। যার সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ।। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশী ত্যাগ স্বীকার করেছে বাংলার নারীরাই।

★ নারী কি তবে কেবল নিগৃহীতই হয়েছে চিরকাল?

🔶 না, নারী নিজের ও সংসারে প্রয়োজনে রণচণ্ডী রূপ ধারণ করেছে বহুকাল ধরে বহুবার। রাণী দুর্গাবতী থেকে আযিযুন বাই, রানী লক্ষ্মী বাই (ঝাছি কি রানী) থেকে রানী অবন্তী বাই, রানী ঝালকারি বাই থেকে রানী ভেলু নাচিয়ার, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার থেকে বেগম রোকেয়া, আশালতা বৈদ্য থেকে তারামন বিবি সমাজের বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে লড়াই করেছেন ও নারীশক্তির জয়গান গেয়েছেন। প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলে তালিকা হয়ত আরও দীর্ঘতর হবে।

★ সনাতন দর্শনে নারীর গুরুত্ব কি?

🔶 সনাতন দর্শনে নারী মাত্রই দেবীস্বরূপ মাতৃরূপা এবং নারী মাত্রই পূজ্য। সনাতন ধর্মালম্বীরা প্রতিবছর দুর্গারূপে নারী তথা চিরন্তন মায়েরই পুজা করেন।

🔹 কি মন্ত্র উচ্চারিত হয় শ্রী দুর্গা পুজায়?

"ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃ রূপেন সংস্থিতা...
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতা...
ই নমোস্তেসৈ নমোস্তেসৈ নমোস্তেসৈ নমো নমো..."

অর্থাৎ নারী হলেন একইসাথে শক্তি ও মা-এর প্রতিরূপ।

🔶 এবার আরেকটু গভীর দর্শন ব্যক্ত করি।।

🔳 পরমপুরুষ পরমেশ্বর সৃষ্টির শুরুতে অর্থাৎ কল্পের শুরুতে অব্যক্ত থাকেন। তিনি যখন ব্যক্ত হন অর্থাৎ মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ শুরু হয় তখন তিনি নিজেকে পুরুষ ও প্রকৃতি উভয় রূপে প্রকাশ করেন।। প্রকৃতি হলেন ক্ষেত্র এবং পুরুষ হলেন ক্ষেত্রজ্ঞ।। প্রকৃতি যেহেতু নারীর স্বরূপ তথা ক্ষেত্র তাই প্রকৃতিই সৃষ্টির সকল বীজ ধারণ করেন। প্রকৃতিই জঠরাগ্নির তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করেন অবলীলায়, সকল জীবকে সন্তানের ন্যায় বক্ষে ধারণ করে রাখে মাতৃরূপা প্রকৃতি।। জীবের তীব্র অনাচার দিনের পর দিন সহ্য করে যায় শান্ত প্রকৃতি আবার অনাচার মাত্রা ছাড়ালে সেই শান্ত প্রকৃতিই হয়ে উঠে তান্ডবরূপী রুদ্রাণী।

🔴 ইহাই মাতৃ ও শক্তিরূপা প্রকৃতির নারী তাৎপর্য। অর্থাৎ জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশের চালিকাশক্তি হলেন নারী। সনাতন দর্শনে তাই নারীরূপে (শ্রী দুর্গা, শ্রী লক্ষ্মী, শ্রী সরস্বতী, শ্রী কালিকা, শ্রী অন্নপূর্ণা, শ্রী জগদ্বাত্রী) প্রকৃতি পুজা করা হচ্ছে অনাদিকাল হতে।

🔱 শ্রী শ্রী দুর্গা পুজার উপাখ্যানে আছে যে অনাচারী ও কামাচারী মহিষাসুর শ্রী ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে অবধ্য হওয়ার বর প্রার্থনা করেন এবং নারী ভিন্ন অন্য কারও হাতে তার মৃত্যু হবে না বলে আশ্বস্ত হন।৷ নারীকে সে এতটাই হীন ভাবত যে সে ধরেই নিয়েছিল কোন নারী তাকে কখনোই বধ করতে পারবে না। বর লাভের পর কামাচারী মহিষাসুর হাজারে হাজারে নারীকে বন্ধী করা শুরু করল তার লালসাকে পরিতৃপ্ত করার জন্য। এই অনাচারী, কামাচারী ও দাম্ভিক অসুরকে দমনে নারীস্বরূপা প্রকৃতি স্বয়ং অবতীর্ণ হলেন শ্রী দুর্গারূপে। তিনি দমন করলেন কামাচারী মহিষাসুরকে এবং সন্তানসম সকল জীবকে তিনি রক্ষা করলেন। তাই শ্রী শ্রী দুর্গা হলেন মাতৃ ও শক্তিস্বরূপা প্রকৃতি এবং ইহাই দুর্গা পুজার তাৎপর্য।





🔸 তাই ত শ্রী শ্রী চন্ডিতে বলা হয়েছে,
"হে দেবী, জগতের সকল নারীর মাঝেই আপনার মূর্তি স্বরূপ প্রকাশ।" 
( শ্রী শ্রী চন্ডী ১১/৬)

🔸 অথর্ববেদের বিভিন্ন মন্ত্রে বলা হয়েছে,

"নারী হলেন মঙ্গলময়ী লক্ষ্মী, নারী হলেন জ্ঞানের ধারক।"

🔸 ঋগবেদে নারীকে বলা হয়েছে জ্ঞানদাত্রী ও প্রেরণাদাত্রী। এজন্যই হয়ত বলা হয় প্রতিটি সফল পুরুষের পেছনে রয়েছে একজন নারীর অবদান এবং তাই ত স্ত্রী হলেন তাঁর স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী।। এই অর্ধঙ্গিনী তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা হেতু স্বয়ং মহাদেব অর্ধনারীশ্বর রূপ ধারণ করেছিলেন।

🔹 কবি নজরুল তাই লিখেছেন,
"বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।"

🔸 পবিত্র বেদে বলা হয়েছে যে সংসার কিংবা সমাজে নারীর অমর্যাদা হয় সেই সংসার ও সমাজ ধ্বংসমুখী।

মনুসংহিতার ৩/৫৬ শ্লোকে বলা হয়েছে,
"যত্র নার্য্যস্ত পূজ্যস্তে রমন্তে তত্র দেবতা"

অর্থাৎ, নারী যে সমাজে পূজা পান দেবতাগণ সেথায় বিরাজ করেন।

🔸 বৈদিক ধর্মে নারী অর্থাৎ 'মা' কে দেবীজ্ঞানে শ্রদ্ধা করা হয়। (তৈত্তরীয় উপনিষদ : শিক্ষাবল্লী, ১১ অনুবাক)।

🔸 মনুসংহিতার ৩/৫৫ শ্লোকে বলা হয়েছে,

"একজন পিতা, ভাই, পতি বা দেবর তাদের কন্যা, বোন, স্ত্রী বা ভ্রাতৃবধুকে মৃদুবাক্য, ভদ্র ব্যবহার ও উপহারাদি দ্বারা খুশি ও সন্তুষ্ট রাখবেন। যারা যথার্থ কল্যাণ ও উন্নতি চান, তারা নিশ্চিত করবেন যে, তাদের পরিবারের নারীরা যাতে সর্বদা খুশী থাকেন এবং কখনো দুর্দশা ভোগ না করেন।"

🔸 মনুসংহিতার ৩/৫৭ শ্লোকে বলা হয়েছে, 

"যে বংশে ভগিনী ও গৃহস্থের স্ত্রী (নারীকূল) পুরুষদের কৃতকর্মের জন্য দুঃখিনী হয়, সেই বংশ অতি শীঘ্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আর যে বংশে স্ত্রীলোকেরা সন্তুষ্ট থাকে, সেই বংশ নিশ্চিতভাবেই শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে।"

🔸 মনুসংহিতায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কেও নারীর সম্মানকে নিশ্চিত করা হয়েছে,

"যে স্বামী তার স্ত্রীকে সন্তুষ্ট রাখে না, সে তার সমগ্র পরিবারের জন্য দুর্দশা বয়ে আনে। আর যদি স্ত্রী পরিবারের প্রতি সুখী থাকেন, তবে সমগ্র পরিবার শোভাময় হয়ে থাকে।”

- মনুসংহিতা (৩/৬২)

🔸 তাই সনাতন বিবাহের মূল প্রতিজ্ঞা মন্ত্রে বলা হয়,

“যদেতত্ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম ।
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব ।।”

অর্থাৎ, তোমার এই হৃদয় আমার হোক আমার এইহৃদয় তোমার হোক।

🔶 নারীর শরীর নয় নারীর মনকে মূল্যায়ন করতে হবে, নারীর মনকে অনুভব করতে হবে।।

🙏 নারী হউক পূজস্য। 🙏


©স্টিমন অনিক।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ