স্বস্তিকা ও হাজার বছরের ইতিহাস।

স্বস্তিকা সনাতনের তথা চিরন্তন একটি পবিত্র চিহ্ন ও কল্যাণের প্রতীক হিসবে পরিচিত। যে কোনো মঙ্গল অনুষ্ঠানে অনেকে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকেন। এই চিহ্ন প্রগতিরও প্রতীক।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে স্বস্তিকার মান্যতা আছে। হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মালম্বী মানুষের কাছে খুবই পবিত্র এই স্বস্তিকা চিহ্ন। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই প্রতীকটি হাজার বছর ধরেই বিশ্বব্যাপী এক সার্বজনীন মান্যতার অংশ।
গবেষকরা বলছেন প্রায় পনের হাজার বছরেরও পুরানো এই চিহ্ন।

স্বস্তিকা চিহ্ন দুই প্রকার -
১) ডান মুখী
২) বাম মুখী

ডান মুখীঃ এই স্বস্তিকা হিন্দুদের কাছে সূর্য বা প্রগতির প্রতীক।

বাম মুখীঃ এই স্বস্তিকা রাত্রি কিংবা তন্ত্রের প্রতীক ।

জৈন তীর্থঙ্কর ও ভগবান গৌতম বুদ্ধের পাদ ফলকে আমরা এই পবিত্র চিহ্ন দেখতে পাই।
"স্বস্তিকা" শব্দটি তিনটি সংস্কৃত শব্দের সমন্বয়ে গঠিত: "সু" অর্থ (ভাল), "আস্তি" অর্থ(আছে, আগেও ছিল, এবং ভবিষ্যতেও থাকবে) এবং "কা" অর্থ (করা)। এই শব্দগুলির অর্থ দড়ায় সর্বদা ভালো করা।
স্বস্তিকা চিহ্নের কিছু অজানা ঘটনা নিয়ে আজকে আলোচনা করব।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপের লোকজন যখন ভারতবর্ষে আসা শুরু করে তখন থেকেই স্বস্তিকা চিহ্নের প্রতি একধরনের আকর্ষণ অনুভব করে এবং স্বস্তিকাকে শুভ ও কল্যাণের প্রতীক মানতে শুরু করে।

★ আমেরিকার গ্রাফিক ডিজাইন লেখক স্টিভেন হেলের তার বই "Swastika: Symbol Beyond Redemption" এ দেখান কিভাবে পশ্চিমারা এই চিহ্নটাকে শুভ শুরুর প্রতীক হিসেবে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন, স্থাপত্যশিল্প ও কাঠামোতে এই চিহ্নের ব্যবহার করেছিল।।

★ ১৯২৫ সালে বিশ্বের এক নাম্বার সফট ড্রিংক কোকা-কোলা তাদের বিজ্ঞাপনে স্বস্তিকা চিহ্ন ব্যবহার করে। বিখ্যাত বিয়ার কোম্পানি "কার্লসবার্গ" তাদের বোতলের লেভেলেও স্বস্তিকা চিহ্ন ব্যবহার করে।

★প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান মিলিটারি ও ১৯৩৯ সালের শেষের দিকে RAF বিমানে স্বস্তিকা চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।

★ আমেরিকা ছেলেদের একটা স্কাউট টীমও এই স্বস্তিকা ব্যবহার করত, মেয়েদের একটা ক্লাব "স্বস্তিকা" নামে একটা ম্যাগাজিনও বের করত।
★ প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোন থেকেই স্বস্তিকার চিহ্নের প্রাচীন থেকে প্রাচীনতম প্রমান পাওয়া যায় যাতে বুঝা যায় এর ব্যবহার শুধু প্রাচীন ভারত নয়, প্রাচীন ইউরোপেও পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রীক, এংলো-স্যাক্সন ও পূর্ব ইউরোপের জায়গাগুলোতেও স্বস্তিকার ব্যবহার হাজার বছর আগে থেকেই ছিল।
এর প্রমাণ পাওয়া যায় ইউক্রেনের জাতীয় জাদুঘরে গেলে। ওখানে সবচেয়ে দামী সম্পদ হচ্ছে হাতীর দাত দিয়ে বানানো একটা পাখির প্রতিমূর্তি যেটা ১৯০৮ সালে প্রত্ন-প্রস্তরকালের খনন করতে গিয়ে রাশিয়ার বর্ডারের সামনে পাওয়া যায়। ওই পাখিতে নকশা করা হয়েছিল স্বস্তিকা প্যাটার্নে। রেডিও-কার্বন পরীক্ষায় দেখা যায় এটা প্রায় ১৫,০০০ বছর পুরনো৷


★ একক স্বস্তিকার ব্যবহার শুরু হয় প্রায় ৭,০০০ বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে নব্যপ্রস্তরযুগ। ব্রোঞ্জ যুগে এসে এর ব্যবহার আরও বেশি হয়৷ তার প্রমান পাওয়া যায় ইউক্রেনের রাজধানী কেইভের একটা জাদুঘরে। ওখানে ৪,০০০ বছর আগের কিছু মাটির পাত্র পাওয়া যায় যেগুলোতে স্বস্তিকা আকা ছিল।
★দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার বাহিনী যখন ইউক্রেন দখল করে তখন আর্যদের প্রতীক হিসেবে এই পাত্রগুলো নিয়ে আসে। বৈদিক সভ্যতায় হিন্দুদের পূর্বপুরুষ ছিল আর্যরা এবং হিটলার ও তারা বাহিনীর সবাই নিজেদের আর্য দাবী করত।

জেনে রাখা ভালো ১৯ শতকের শুরুর দিকে একজন জার্মান স্কলার একটা ভারতীয় সংস্কৃতি বই অনুবাদ করেন এবং জার্মান ভাষার সাথে সংস্কৃতির অনেক মিল খুজে পান। যেহেতু বৈদিক সভ্যতায় আর্যরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতায় ও যুদ্ধকৌশলে ছিল শ্রেষ্ঠ তাই হিটলার নিজেকে ও তারা যুদ্ধাদের আর্য দাবী করা শুরু করে। ফলশ্রুতিতে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর পতাকায় যুক্ত করা হয় "স্বস্তিকা"। হাজার বছরের ইতিহাসে সেই থেকে স্বস্তিকার কলংকজনক অধ্যায় শুরু এবং ইউরোপীয়দের কাছে স্বস্তিকা হয়ে উঠে এক আতংক ও বর্বরতার প্রতীক। হিটলারের পতনের পর ইউরোপীয়রা তাদের বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে স্বস্তিকার ব্যবহার বন্ধ করে দেয়।


★ জাপানের এক সুপ্রাচীন বৌদ্ধমন্দিরে এক বিশাল ফুলদানি রাখা আছে স্বস্তিকা অংকিত৷

★ কেইভের মিউজিয়ামে একটা গ্রীক অর্নামেন্টস পাওয়া যায় যেখানে স্বস্তিকা অংকিত ছিল, তখনকার টাইলসেও স্বস্তিকা প্যাটার্নের নকশা পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রীসের পাত্র ও ফুলদানিতেও একক স্বস্তিকার নকশা দেখা যায়।

কেইভের মিউজিয়ামের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক সংগ্রহ ছিল ১২ শতকের এক রাজার পোশাকের টুকরা যেখানে স্বর্ণের এম্ব্রোডারিতে স্বস্তিকা নকশা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ অব্দি রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে স্বস্তিকা একটা জনপ্রিয় নকশা হিসেবে প্রচলিত ছিল।

গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাস এই চিহ্নকে অভিহিত করেছিলেন আকাশ এবং মাটির সংযোগের চিহ্ন হিসেবে। ফিনল্যান্ডের বাসিন্দারা আবার এই চিহ্নকে মানতেন সূর্যের প্রতীক হিসেবে। ফিনল্যান্ডের বিমান বাহিনীর লোগতেও শোভা পায় ”স্বস্তিকা”। সেখানকার ধর্মযাজকদেরই শুধু এই চিহ্ন ব্যবহার করার অনুমতি ছিল। গ্রিস এবং ফিনল্যান্ডের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল লিডীয়, হিব্রু এবং মিশরীয়দের। সেই পথেই এই দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছিল এই চিহ্ন।
★ সম্প্রতি ইউরোপে স্বস্তিকার পুনঃব্যবহারের চেষ্টা চলছে পিটার ম্যাডসেন নামের একজন ট্যাটু আর্টিস্ট একটা মুভমেন্টও শুরু করেছে।
তার ভাষায়,
"হাকেনক্রইজ (স্বস্তিকা) ভালোবাসার প্রতীক এবং হিটলার এই চিহ্নের অপব্যবহার করেছে, আমরা এটা পুনঃব্যবহার চাই এবং এটা অসম্ভব নয়।"

যাইহোক ভারত কিংবা বাংলাদেশের সনাতন ধর্মলম্বীরা এখনও স্বস্তিকাকে শুভ ও মঙ্গলের প্রতীক হিসেবেই ব্যবহার করে আসছে হাজার বছর ধরে। যেকোন শুভকাজ ও বাড়ির প্রধান ফটকে স্বস্তিকা চিহ্ন অংকিত থাকে।



হিটলারের নাৎসি বাহিনী ব্যাতিত হাজার বছর ধরে শুভ ও মঙ্গলের প্রতীকে হিসেবেই স্বস্তিকার ব্যবহার হয়ে আসছে।
©স্টিমন অনিক




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ