ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধিকে অতিক্রম করে আত্মা ও পরমাত্মাকে দর্শন


 

বিস্তারিত ভূমিকায় নিয়ে গিয়ে কঠোপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় বাল্লীর ৫৭ নং মন্ত্র দিয়ে শুরু করব।
"শরীরে অধীষ্ঠিত আত্মাকে রথি বলিয়া জানিও, জীবের শরীরকে রথ বলিয়া জানিও, বুদ্ধিকে রথচালক সারথি বলিয়া জানিও এবং মনকে লাগাম বলিয়া জানিও।"
#ব্যাখ্যাঃ মানুষের দেহ একটা রথের মত। রথ যেমন বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় তেমনি এই শরীরের বিভিন্ন অংশ দ্বারা মানুষ বিবিধ কার্যাদি সম্পাদন করে। প্রত্যেক রথের আবার একজন রথী (আত্মা) থাকে যিনি রথে অবস্থান করে রথের (শরীর) সকল কার্য পর্যবেক্ষন করে কার্যের ফলভোগ করে। রথকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন একজন সারথি যিনি সঠিক পথে চালনা করে রথকে গন্তব্যে পৌছে দেয়। দেহরথের সারথি হিসেবে সেই কার্য সম্পাদন করে বুদ্ধি। বুদ্ধিই মানবজীবনের সঠিক লক্ষ্য নির্দেশ করে এবং সঠিক পথে সেই লক্ষ্যে পৌছে দেয়। তবে সঠিক বেঠিকের সিদ্ধান্ত হয় মনে। তাই মনকে বলা হয়েছে লাগাম কারন লাগাম ঠিকঠাক না ধরলে সঠিক পথের দিশা পাওয়া অসম্ভব। মনের বিভিন্ন বিচার বিশ্লেষণ যখন বুদ্ধির সামনে এসে উপস্থিত হয় তখন বুদ্ধিই প্রেয় ও শ্রেয়র মধ্যে শ্রেয়কে নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী রথকে চালনা করে গন্তব্যে পৌছে দেয়।
[শ্রেয় ও প্রেয় পরস্পর বিভিন্ন এবং তাদের প্রয়োজনও ভিন্ন। যাহা আমাদের ইন্দ্রিয়ের জন্য সুখকর যেমন রূপ-রসাদি, যাহা হৃদয়ের জন্য প্রীতিকর যেমন স্ত্রী-পুত্রাদি কিংবা স্বর্গসুখ এসবই প্রেয়৷ অর্থাৎ ধর্ম, অর্থ ও কাম এই তিন পুরুষার্থকেই প্রেয় বলা হয়। অন্যদিকে সংসারের ভোগ্য পদার্থে আসক্ত না হয়ে আত্মজ্ঞান লাভ করে সচিনান্দ ব্রহ্মের সাথে যুক্ত হয়ে সংসারের জরা, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করাকেই শ্রেয় বলা হয়। এই শ্রেয়ই মোক্ষ।
এই বিষয়ে শ্রীমদভগবদগীতার ৫/২১ শ্লোকে বলা হয়েছে,
"সেই ব্রহ্মবিদ পুরুষ কোন রকম জড় ইন্দ্রিয় সুখভোগের প্রতি আকৃষ্ট হন না, তিনি চিরজগৎ সুখ লাভ করেন। ব্রহ্মে যোগযুক্ত হয়ে তিনি অক্ষয় সুখ ভোগ করেন।"]
মন্ত্র নং-৮ এ বলা হয়েছে,
"মনীষিগণ জীবের ইন্দ্রিয়সমূহকে দেহরথের অশ্ব, ইন্দ্রিয়ভোগ্য বস্তুসমূহকে ইন্দ্রিয়ের বিচরণভূমি এবং শরীর, ইন্দ্রিয় ও মনযুক্ত আত্মাকে ভোক্তা বলিয়া থাকেন।"
আমাদের শরীরের বিভিন্ন ইন্দ্রিয়গুলো হচ্ছে রথের অশ্বসমূহ। অশ্বসমূহ সক্রিয় হলে যেভাবে রথ চালিত হয় তেমনি ইন্দ্রিয়সমূহ সক্রিয় হলে শরীর তার কার্যসমূহ সম্পাদন করে। ইন্দ্রিয়সমূহ অশ্বের মতই উদ্দাম ও উচ্ছৃঙ্খল। ইন্দ্রিয়সমূহ সবসময়ই ভালো মন্দের বিচার না করে সুখকর বস্তুর দিকে ছুটতে থাকে। ঠিক তখনই লাগামরূপি মন ইন্দ্রিয়সমূহকে অবাধ্য হতে দেয় না। ইন্দ্রিয়সমূহের বিচরণভূমি হলো রূপ, রস ও গন্ধাদি বিষয়সমূহ।
তাহলে দেহরথ দ্বারা জীব যে কর্ম করে তার ভোক্তা কে?
ইন্দ্রিয়, মন ও শরীরসংযুক্ত আত্মাই হলো ভোক্তা। এই আত্মাই আসলে জীব এবং জীবই বিভিন্ন কামনা-বাসনা দ্বারা চালিত হয়ে ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি দ্বারা বিভিন্ন কার্য করে এবং এই সকল কাজের "আমিই কর্তা" এরূপ অভিমান করে ফলস্বরূপ সুখ দুঃখ ভোগ করে।
রথীকে সঠিক গন্তব্যে পৌছে দেওয়ার জন্য লাগামরূপি মনের গুরুত্ব অনেক। তাই শ্রীমদভগবদগীতার ৬/৬ এ বলা হয়েছে।
"যিনি তার মনকে জয় করেছেন তার মন তার পরম বন্ধু কিন্তু যিনি তা করতে অক্ষম তার মন তার পরম শত্রু।"
কঠোপনিষদের মন্ত্র নং- ৫৯,৬০,৬১ ও ৬২ এ এই বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
যে মন বিবেকসম্পন্ন বুদ্ধির সাথে যুক্ত না হয়ে কিংবা বুদ্ধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে কামনা-বাসনা দ্বারা চালিত হয়। যে ব্যক্তির বুদ্ধি সত্য উপলব্ধি করতে পারে না তার মন কখনও সংযত থাকে না। মন যখন অসংযত থাকে তখন ইন্দ্রিয়সমূহ উদ্দাম ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠে এবং জীবকে বিপথে নিয়ে যায়।
অন্যদিকে শুদ্ধ বুদ্ধিসম্পন্ন মন সর্বদাই ইন্দ্রিয়সমূহের লাগাম টেনে ধরতে পারে। তার দেহ ও মন পবিত্র থাকে। এই শুদ্ধচিত্ত ব্যক্তিই সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মকে লাভ করতে সমর্থ হয় এবং দিব্য জীবন লাভ করে।
পরমেশ্বর শ্রীমদভগবদগীতা ১২/৩-৪ শ্লোকে নিজেই বলেছেন,
"যারা সমস্ত ইন্দ্রিয় সংযত করে সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন হয়ে সর্বভূতের কল্যাণে রত হয়ে আমার অক্ষর, অব্যক্ত ,অচিন্ত্য, অচল, ধ্রুব ও নির্বিশেষ স্বরুপকে উপাসনা করেন, তারা অবশেষে আমাকেই লাভ করে।"
কঠোপনিষদের মন্ত্র নং ৬৪ ও ৬৫ এ বিশ্লেষণ করা হয়েছে,
পরমপুরুষ ব্রহ্মকে লাভ করতে হলে আমাদেরকে জ্ঞানের নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তরে, স্থুল হতে সূক্ষ্ম, ব্যাপ্য হতে ব্যাপকে এবং কার্য থেকে কারণে উঠতে হবে৷
ইন্দ্রিয়সমূহ যে বিষয়সমূহকে প্রকাশ করে সে বিষয়সমূহ ইন্দ্রিয় অপেক্ষা সূক্ষ্ম ও ব্যাপক। এই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়সমূহ কারণ এবং ইন্দ্রিয়সমূহ তাদের কার্য। তাই কার্য অপেক্ষা কারণ শ্রেষ্ঠ। ইন্দ্রিয়ের এই বিষয়সমূহ তথা কারণ অপেক্ষা মন শ্রেষ্ঠ। আমরা মন দ্বারাই বিষয়সমূহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি, এই কারণে মন বিষয়সমূহ অপেক্ষা সূক্ষ্ম ও ব্যাপক। মন অপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ কারন বুদ্ধিই মনের নিয়ন্ত্রক। মনের বিচারকে সঠিক কিংবা বেঠিক বিশ্লেষণ করে বুদ্ধিই সঠিক পথ স্থির করে দেয় তাই বুদ্ধিজাত জ্ঞান মন দ্বারা উপলব্ধ জ্ঞান অপেক্ষা সূক্ষ্ম ও ব্যাপক। বুদ্ধি হতে মহান আত্মা শ্রেষ্ঠ কারণ কেবল বুদ্ধি দিয়ে অন্তরস্থ সত্যকে দর্শন করা যায় না। অন্তরস্থ সত্যকে দেখতে হলে বুদ্ধি হতেও সূক্ষ্ম ও ব্যাপক আত্মাকে জানতে হবে। এই মহান আত্মা হতে অব্যক্ত প্রকৃতি শ্রেষ্ঠ। কারণ ব্রহ্মের এই অব্যক্ত প্রকৃতি হতেই সৃষ্টির উদ্ভব হয়, এই প্রকৃতিই সৃষ্টির কারণ বা মূল। এই জগতের উৎপাদক অব্যক্ত প্রকৃতি থেকেই পরমপুরুষ পরমেশ্বর শ্রেষ্ঠ কারণ তিনিই প্রকৃতির নিয়ন্তা। তিনিই সমগ্র বিশ্ব পূর্ণ করে ব্যপ্ত হয়ে আছেন, তিনিই সমগ্র বিশ্বের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। অভেদজ্ঞানে আত্মা এবং পরমাত্মা একই তাই আত্মার চেয়ে অব্যক্ত প্রকৃতি শ্রেষ্ঠ নয়। প্রকৃতি জড়, আত্মা চেতন, পুরুষ। প্রকৃতি পুরুষেরই অংশ বা শক্তি। অতএব প্রকৃতি পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারেনা। ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি প্রকৃতিরই অংশ।
#মন্তব্যঃ ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধিকে অতিক্রম করে পরম জ্ঞানকে অর্জন করে অন্তরস্থ আত্মা ও প্রকৃতিকে উপলব্ধি করতে হবে এবং জ্ঞানচক্ষু দিয়ে সর্বব্যপ্ত পরমাত্মাকে দর্শন করতে হবে।
কঠোপনিষদের মন্ত্র নং-৬৬ এবং ঋগবেদের মন্ত্র নং ১/২২/২০ এ তাই বলা হয়েছে,
"যে পরম পুরুষকে জীবের সর্বোত্তম গতি বলা হইয়াছে তিনি আত্মারূপে সর্বভূতে প্রচ্ছন্ন আছেন বলিয়া সকলের নিকট প্রকাশ পান না অর্থাৎ সকলে ইহাকে স্বীয় আত্মারূপে জানিতে পারেন না। যে সকল জ্ঞানীলোকের বুদ্ধি সাধন দ্বারা বিশুদ্ধ এবং সূক্ষ্ম বস্তু দর্শনের যোগ্য হইয়াছে সেই সূক্ষ্মদর্শী ব্যক্তিগণই তাঁহাদের নির্মল ও সূক্ষ্ম বুদ্ধি দ্বারা পরমাত্মাকে দর্শন করেন।"

-------------©স্টিমন অনিক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ