✴️✴️ কোণার্কের সূর্য মন্দির ও সূর্য ঘড়ির রহস্য ✴️✴️

 


✴️✴️ ⭕ কোণার্ক সূর্য মন্দির মধ্যযুগের এক বিস্ময়কর স্থাপত্যশৈলী। বৈদিক দর্শন, পৌরাণিক শাস্ত্র, সনাতনী স্থাপত্যশৈলী ও বিজ্ঞানের এক অনন্য সমন্বয় হয়েছে কোণার্কের সূর্য মন্দিরে। ⭕ উড়িষ্যার কোণার্কে এই মন্দির অবস্থিত। ১২৫০ সালে পূর্ববঙ্গ রাজবংশের প্রথম নরসিংহদেব এই বিস্ময়কর স্থাপনাটি নির্মাণ করেছেন বলে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদদের মান্যতা। ⭕ সেখানেই রয়েছে আশ্চর্য এক সূর্য ঘড়ি। সূর্যের আলোতেই সেই ঘড়ির কাটা নিখুঁত সময় দেয়। নাম তার কোণার্ক সূর্য মন্দির। এই মন্দিরের নাম কোণার্ক হয়েছে কোণ ও অর্কের মিলিত রূপে। কোণ অর্থ কোণা বা অ্যাঙ্গেল। আর অর্ক মানে সূর্য। সূর্যের আলো দিনের বিভিন্ন সময় এই মন্দিরের বিভিন্ন কোণে পড়ে সময়ের নিখুঁত হিসাব দিতে পারে ঘড়ি। সাত ঘোড়ায় টানা ২৪ চাকার একটি রথের আদলে গড়া হয় মন্দিরটি। মন্দিরের সাতটি ঘোড়া সূর্যের সপ্তরশ্মির প্রতীক। সপ্ত সূর্যস্ব রশময়ঃ(অথর্ব৭/১০৭/১) অর্থ্যাৎ, সূর্যের সাত রশ্মি বেদে আরও আছে সপ্ত অশ্বে (রশ্মি) চালিত সোনালী (সূর্যের সোনালী আলো) রথে সূর্য সমগ্র বিশ্বে প্রকাশিত।





⭕ পৌরাণিক শাস্ত্রে সেই বৈদিক মান্যতাকে রূপদান করা হত সূর্য দেব সাত অশ্ব (ঘোড়া) বিশিষ্ট রথে চড়ে দ্যুলোক, ভূলোক, অন্তরীক্ষ আলোকিত করে। সেই আলোকেই এই সূর্য মন্দির নির্মিত হয়েছিল। দূর থেকে দেখলে মনে হত সাত অশ্ব বিশিষ্ট এক বিশাল রথ আকাশে উড়ে যাচ্ছে কারন মন্দিরটি ভুমি থেকে অনেক উপরে (আনুমানিক ২০০ ফুট) অবস্থিত ছিল।। ⭕ ২৪ চাকার মধ্যে এক পাশের ১২টি ১২ মাসের আর অন্য ১২টি ১২ রাশির প্রতীক। প্রতিটি চাকায় সাতটি নকশা করা দাঁড়ে (স্পোক) আছে সাত দিনের হিসাব। আর আটটি লাঠিতে পাওয়া যায় অষ্ট প্রহরের (অষ্ট প্রহর = ১ দিন) হিসাব। চাকার মধ্য দাঁড়টির ছায়া কোথায় পড়ছে সে হিসেবে পাওয়া যায় সময়ের নিখুঁত হিসাব। তার আগে বুঝে নিতে হবে উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়নের হিসাব। অর্থাৎ এই ঘড়ি দিয়ে সময়, দিন, মাস, ঋতু ও বছরের হিসেব নির্ণয় করা যেত একদম নিখুঁতভাবে। মোটকথা গাণিতিক আর জ্যামিতিক অদ্ভুত সব জটিল আবার সহজ হিসাবে ভরপুর এই মন্দির। তবে একটি চাকা বাদে অন্য চাকাগুলোতে এখন আর সময়টা দেখা যায় না। চাকাগুলোর ব্যস ৯ ফুট।


⭕ এই মন্দিরের বিশেষত্ব ছিল সূর্যদয়ের প্রথম কিরণ মন্দিরে গর্ভগৃহে অবস্থিত দেবতার ওপর এসে প্রথম পড়ত। অতীতে এই মন্দিরের উপরিভাগে একটি ভারী ম্যাগনেট (৫০ টন ওজনের বলে বলা হয়) লাগানো ছিল। মন্দিরটির পাথরগুলোকে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল লোহার ক্লামের সাহায্যে। মন্দিরের চূড়ায় রাখা এই ম্যাগনেটটি মন্দিরের কাঠামোর ব্যালেন্স বজায় রাখত। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মধ্যে প্রশ্ন ছিল, নদী তীরে অবস্থিত পাথরের তৈরি হয় এই বিশাল রথটি কার? যদিও সময় পরিক্রমায় মন্দির থেকে এখন অনেক দূরে চলে গেছে চন্দ্রভাগা নদী। ১২৩৮ সালে কলিঙ্গের রাজা নরসিংহ দেব মন্দিরটির কাজ শুরু করেন। সেখানে ১২ একর জায়গার ওপর কোণার্ক সূর্য মন্দির তৈরি করা হয়। প্রায় ১০ হাজার শ্রমিকের সাহায্যে, ১২ বছরের মধ্যে এই অদ্ভুত মন্দিরটি নির্মাণ করেন।



⭕ উড়িষ্যা ও দ্রাবিড় স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে নির্মিত মন্দিরটি ধূসর বেলে পাথরে বিশাল একটি রথের আকারে গড়া হয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হত সমুদ্র থেকে উঠে আসা সূর্যদেবের বিশাল রথ, তার সামনে রয়েছে সাতটি ঘোড়া। বারো জোড়া বিশাল চাকার ওপর পুরো মন্দিরটি নির্মিত। চাকার কারুকার্য দর্শকদের জন্য একটি প্রধান আকর্ষণ। মন্দিরে প্রবেশ পথেই রয়েছে বিশাল দু’টি সিংহের মূর্তি যারা লড়াই করছে দু’টি রণহস্তীর সঙ্গে। বেদী থেকে শুরু করে চূড়া পর্যন্ত প্রতি ইঞ্চি জায়গায় পাথরের ভাস্কর্য ও কারুকার্য রয়েছে। দেবতা, অপ্সরা, কিন্নর, যক্ষ, গন্ধর্ব, নাগ, মানুষ, বালিকা বধূ বিয়ের শোভাযাত্রা, সমকামিতা, রাজার যুদ্ধ প্রস্তুতি, মৃদঙ্গকরতাল বীণা, মোহিনী, মিঠুন মূর্তি, ছয় হাতের শিব, রাজদরবারের নানান দৃশ্য। যদিও বলা হয়ে থাকে মূলমন্দিরটি ছিল রথটির পেছনে আর এই রথটি সম্ভবত নাটমন্দির। ⭕ মন্দিরের গায়ে রয়েছে এক হাজার ৭০০-এরও বেশি হাতির ভাস্কর্য। কলিঙ্গ রীতিতে নির্মিত মন্দিরের চূড়াগুলো পিরামিড আকৃতির। মন্দিরের সামনে রয়েছে আরও একটি নাটমন্দির। এখানে একসময় দেবদাসীরা দেবতার উদ্দেশ্যে পূজানৃত্য পরিবেশন করতেন। মন্দিরের ভিতরেও রয়েছে নাটমন্দির, ভোগমন্দির ও গর্ভগৃহ। মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৮৫৭ ফুট। তবে মন্দিরের অনেক অংশ এখনো বালিতে দেবে গেছে। মন্দিরের দেউল এখনো ২০০ ফুট উঁচু।


⭕ বলা হয় থাকে পঞ্চদশ শতকে কালা পাহাড়ের (মরু দস্যু) আক্রমণে মন্দিরটি ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে ১৬০০ শতাব্দীতে যখন পর্তুগালের ব্যাপারী জাহাজগুলো এই মন্দিরের পাস দিয়ে গেলেই বিপত্তির সম্মুখীণ হত। এই চুম্বকের আকর্ষণে জাহাজের কম্পাসগুলো ভুল দিক নির্দেশ করত। যার কারণে জাহাজগুলো ভুল দিকে চলে যেত। অতঃপর প্রাকৃতিক দূর্যোগের কবলে পড়ে জাহাজগুলো ডুবে যেত। আর এই কারণেই পর্তুগালের নাবিকরা এই মন্দিরটিকে "ব্ল্যাক প্যাগোডা" বলতে শুরু করে। পরবর্তীতে যখন মন্দিরের চুম্বকটির কথা সবার সামনে প্রকাশিত হয়। তখন পর্তুগীজরা এই মন্দিরের চূড়ায় রাখা চুম্বকটিকে খুলে ফেলে। যার কারণে মন্দিরের দেয়ালগুলো ভেঙে পড়ে। ⭕ পরবর্তীতে সূর্যদেবের বিগ্রহটি পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি পৃথক মন্দিরে সূর্য ও চন্দ্র দেবতার বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। শুধু বিগ্রহই নয় কোণার্ক মন্দির থেকে কারুকার্য করা অনেক পাথর পুরীর মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এমনকি নবগ্রহ পথ নামে একটি বিশাল প্রস্তর খন্ডও পুরীতে নেওয়া হয়। অর্থাৎ এই মূহুর্তে কোণার্কে মূল সূর্য মন্দিরের অংশবিশেষই অবশিষ্ট আছে।


⭕ মারাঠা শাসনামলে কোণার্ক মন্দির থেকে অনেক ভাস্কর্য ও প্রস্তরখন্ড পুরীতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৭৭৯ সালে মন্দির থেকে অরুণ কুম্ভ নামে বিশাল একটি স্তম্ভ নিয়ে পুরীর সিংহদ্বারের সামনে স্থাপন করা হয়। এই সময় মারাঠা প্রশাসন কোণার্কের প্রধান মন্ডপটি অপ্রয়োজনীয় মনে করে ভেঙ্গে ফেলে কারন ম্যাগনেটটি নিয়ে যাওয়ার পর মন্দিরটি ইতোমধ্যেই ভেঙে যায়। সূর্যদেবের বিগ্রহ অপসারণের পর কোণার্কে পূজা ও আরতি বন্ধ হয়ে যায়। পর্তুগীজ জলদস্যুদের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে কোণার্ক বন্দর বন্ধ করে দেয়া হয়। আঠারশ’শতক নাগাদ মন্দিরটি তার সমস্ত গৌরব হারিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। ব্রিটিশ আমলেও মন্দিরটি কয়েকবার লুন্ঠিত হয়। এই মন্দিরের বিভিন্ন ভাস্কর্য এখনও ইউরোপের বিভিন্ন মিউজিয়ামে শোভা পায়। মন্দিরের অনেক অংশ বালির নিচে চাপা পড়ে যায়। এছাড়া প্রাকৃতিক কারণেও এই মন্দিরটির অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৩০০ বছর ধরে তো মন্দিরটি সমুদ্রের বালির তলায় চাপা পড়েছিল।


⭕ এরপর ১৯০৩ সালে এই মন্দির (মূলত রথটি কারন মূল মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি) পুনরাবিষ্কৃত হয়। খননের মাধ্যমে তোলে আনা হয় বালির প্রলেপ খুঁড়ে। উন্মোচন করা হয় মানুষের জন্য। পরবর্তীতে এই মন্দির ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যেও জায়গা করে নেয়।



©স্টিমন অনিক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ