শূন্য ও পূর্ণ


 

💠 শূন্য পূর্ণ।

শূন্য কি কেবল জিরো নাকি বিশাল শূন্যতার মধ্যে নিহিত আছে বিশাল পূর্ণতা?

উত্তরঃ

🔲 পূর্ণতম সত্তাকে পেতে হলে নিজেকে শুণ্য হতেই হয়; সবদিক থেকে, সবকিছু থেকে, সব থেকে। প্রশ্ন উঠবে, জগতে মানবের মধ্যে শুভাশুভ উভয়ই থাকে; চারিত্রিক গুণ-দোষ, বৈধ-অবৈধ, সৎ-অসৎ ইত্যাদি। এসবের মধ্যে অশুভ সবকিছু হতে শুণ্য হতে পারাটা যথার্থই শুণ্য হওয়ার পথে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু মানবকে সম্পূর্ণ শুণ্য হবার জন্য কি তার মধ্যে থাকা শুভত্বগুলো ত্যাগ করতে হবে? যদি তাই হয়, তাহলে তো মানবের মধ্যে কোন শুভত্বই থাকবে না। তখন সেই মানবের বেঁচে থাকার উপযোগিতাটাই বা কী? কোন মানবের মধ্যে শুভাশুভ কোনটিই না থাকলে সে কি শুধুমাত্র প্রাণযুক্ত একটা জড় সত্ত্বাতে পরিণত হবে না? একবার ভাবুন তো, একজন মানুষ সত্যও বলেনা, মিথ্যাও বলেনা, এমনটা হলে তো বাকশক্তি থাকা সত্ত্বেও সে ব্যক্তি মূক হতে বাধ্য। কেউ ভালো কাজও করে না, খারাপ কাজও করেনা, সে ব্যক্তি কি নিষ্কর্মা নয়? তাই একইসাথে শুভাশুভ বিষয় ত্যাগ করাটা চরম নিরর্থক। তাহলে শুভত্ব ত্যাগ না করলে মানব পুরোপুরি শুণ্য হবে কিভাবে? আসলে অশুভত্বকে ত্যাগ করলে শুণ্য হবার পথে প্রায় বেশিরভাগটুকুই এগুনো হয়ে যায়। আর পুরোপুরি শুণ্য হবার পথে শুরুতেই অশুভত্বকেই ত্যাগ করতে হয়, শুভত্বকে নয়। কিন্তু শুভত্বটুকু থাকলে যে পুরোপুরি শুণ্য হওয়া যায়না!

প্রশ্ন হলো, শুণ্য হতে হলে কি শুভত্বও অবশ্যই ত্যাগ করতে হয়?

উত্তরঃ

🔲 'না' সকল অশুভত্ব ত্যাগ করে সকল শুভত্বকে ধারণ করলেই শুণ্য হওয়া যায়। তবে এক শর্তে, শুভত্বের থেকেও উৎপন্ন হওয়া কিছু বিকার থেকে মুক্ত হতে হবে যেহেতু শুভত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার অর্থ হলো শুভত্ব থেকে উদ্ভূত কিছু বিকার হতে মুক্তি। উদাহরণস্বরূপ, মানব সাত্ত্বিক গুণ বা শুভত্ব অর্জন করলে সে কোন রকমের প্রযত্ন ছাড়াই নিজের অজান্তেই জ্ঞানী হয়ে যায়। তখন সে জ্ঞানসুখ ভোগ করে এক ধরণের ভোগী হয়ে তাতে আসক্তি দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে। আবার তার মধ্যে শুভ কর্মফলও যোগ হতে থাকে। ফলে সে পুরোপুরি শুণ্য হতে পারেনা। কিন্তু শুভত্ব অর্জন করে সেসব গুণ দ্বারা কৃত কর্ম কর্মফলও যদি সে স্রষ্টাকে সমর্পণ করে দিতে পারে, তাতেই তার শুভত্ব ত্যাগ হয়ে যায়। শুধুমাত্র তখনই কেউ পুরোপুরি শুণ্য হতে পারে। আর পুরোপুরি শুণ্য হতে পারলেই মানব পূর্ণকে অর্থাৎ পরমেশ্বরকে লাভ করতে পারে।

🔳 জগতে পূর্ণ সত্ত্বা একজনই, পরমেশ্বর। মানবের পক্ষে যেহেতু পূর্ণ হওয়া কখনোই সম্ভব নয়, সেহেতু মানবের পক্ষে একেবারে শুণ্য হয়েই পূর্ণকে লাভ করার চেষ্টা করা উচিত। সকলের সাথে ভালোবাসা কর্তব্যবোধে অন্বিত থেকেও মানব হবে সম্পর্কে মোহশুণ্য, সকল ধরণের কর্তব্যকর্ম করেও সে হবে কর্মফলে ফলাকাঙ্ক্ষাশুণ্য, জ্ঞানী সদগুণাবলীর অধিকারী হয়েও সে হবে জ্ঞানের অহংশুণ্য, বৈষয়িকতার মধ্যে থাকলেও সে হবে আসক্তিশুণ্য, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়ভোগ করবে ত্যাগী হয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে মানব যেন তার সকল বিষয়াশয় থেকে আসক্তিশুণ্য হয়ে মুক্ত হয়, তার অধিকারে যেন একটা ফুটোকড়িও না থাকে। সে জন্মের সময় যেমন শুণ্য হাতে এসেছিলো, মৃত্যুর সময়েও সে যদি সবদিক থেকে শুণ্য হয়ে যায়, তাহলেই সে পূর্ণকে পেতে পারবে। যেহেতু মৃত্যুক্ষণ আমাদের অজানা সেহেতু জীবিত থাকা অবস্থাতেই আমাদের শুণ্য হওয়া উচিত এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

🔳 আধ্যাত্মিক দিক থেকে যথেষ্ট পরিণত একজন বুঝতে পারলেন যে, পূর্ণকে পেতে হলে শুণ্য হতে হয়। তখন তিনি নিজেকে সবকিছু থেকে শুণ্য করার চেষ্টা করলেন; বৈষয়িকতা থেকে, সকল ধরণের জাগতিক পরলৌকিক সুখভোগের কামনা-বাসনা থেকে, সম্পর্কগুলির মোহ হতে, সব থেকে, সব থেকে। তখন তিনি প্রথমে তার সকল বৈষয়িক সম্পত্তি সৎকাজে দান করে দিলেন, দেহরক্ষার জন্য সামান্য কিছুই অর্থোপার্জন করতে লাগলেন কিন্তু অর্থ সঞ্চয় করা ত্যাগ করলেন। তিনি সমাজের সকলের সাথে মোহহীন হয়ে সম্পর্কযুক্ত হলেন, ভোগাসক্তি, সমাজে প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি, সুনাম ইত্যাদি লাভের আকাঙ্খ্যা ত্যাগ করলেন। কিন্তু তার মনে একটা সূক্ষ্ম প্রশ্ন এলো--তিনি তার জন্মজন্মান্তরের শুভাশুভ কর্ম ত্যাগ করবেন কিভাবে? সেগুলোও তো তিনি যুগযুগান্তর ধরে বহন করছেন। সম্পূর্ণ শুণ্য হতে হলে তো তাকে তার শুভাশুভ কর্মফল হতেও মুক্ত হতে হবে, তাই না?

🔳 তিনি তার শুভ কর্মফলটুকু পরমেশ্বরে সমর্পণ করে দিলেন। কারণ সেসব কর্মফল ভোগ করতেও তো অনেকটা সময় লাগবে, ইহকালে পর্যাপ্ত আয়ু না পেলে পরকালে। তাতে করে পুণরায় ইহকালে ফিরে আসতে হবে পুণরায় শুণ্য হবার চেষ্টার জন্য। অর্থাৎ বর্তমান জন্মে যে, পুরোপুরি শুণ্য হওয়া যাচ্ছে না সেটা নিশ্চিত যদি অসংখ্য জন্মের শুভ কর্মফল ভোগ করতে হয়। তাই তিনি তার শুভ কর্মফলটুকু ভোগ করতে না চেয়ে সেটা পরমেশ্বরে সমর্পণ করে দিলেন। কিন্তু তিনি তার অশুভ কর্মফলটুকু পরমেশ্বরকে সমর্পণ করতে পারলেন না, তাতে প্রচণ্ড কুন্ঠাবোধ কাজ করলো তার মনে। চোর কি কখনো চুরি করার আগে নিষ্কাম কর্ম করার ছলনায় পরমেশ্বরকে বলতে পারে যে, প্রভু, তোমার কর্ম তুমি আমাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছ, চৌর্য্যকর্মের ফলও তোমাকে সমর্পণ করলাম!? না, সেটা কখনোই নিষ্কাম কর্মের স্বরূপ হতেই পারেনা। ইচ্ছাকৃত অশুভকর্ম করা নিষ্কাম কর্মের প্রথম শর্তকেই পুরণ করে না। কারণ অশুভ কর্ম তো কর্মের সংজ্ঞার মধ্যেই পড়ে না, সেটা নিষ্কাম কর্মের মধ্যে গণ্য হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠেনা। তাই সে ব্যক্তি অশুভ কর্মফল পরমেশ্বরে সমর্পণ করতে পারলেন না। 'ভোগ ব্যতীত কর্মফল ক্ষয় হয়না'--প্রকৃতির এই অমোঘ বিধি তিনি শুধু তার সঞ্চিত অশুভ কর্মফলের জন্যই বিবেচনা করলেন। তখন সে ব্যক্তি তার অশুভ কর্মগুলোর ফলস্বরূপ নিদারুণ দুঃখকষ্ট নিজেই ভোগ করতে চাইলেন এবং পরমেশ্বরের কাছে সেজন্য প্রার্থনা করতেন।

এখন প্রশ্ন হলোঃ

) ব্যক্তিটির চেতনার স্বরূপ কেমন?

) পরমেশ্বর কি তাকে বর্তমান জন্মেই তার পূর্বসঞ্চিত অশুভ কর্মফল ভোগ করিয়ে নিঃশেষ করাবেন?

) যিনি তার শুভকর্মফল পরমেশ্বরে সমর্পণ করার সাহস রাখেন, পরমেশ্বরের কি উচিত সেজন্য তার অশুভ কর্মফলকেও গ্রহণ করা?

ডা. শৈবাল

৬ই ভাদ্র, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ, ১৪৪১ হিজরি, ১৯৪১ শকাব্দ, ২৪শে আগস্ট, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ