🔱 বোস-আইন্সটাইন তত্ত্ব ও একজন সনাতন বিজ্ঞানীর গল্প।

উনবিংশ শতাব্দীতে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে বোস-আইন্সটাইন তত্ত্ব৷ পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নতুন তারকার উদয় হয় উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। নাম তার স্যার আইনস্টাইন। সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে আইনস্টাইনের কীর্তি।

কিন্তু একই সময়ে জন্ম নিয়েছিল আরেকজন কিংবদন্তি। যে জন্ম না নিলে হয়ত আইন্সটাইনের অনেক তত্ত্বই আলোর মুখ দেখত না এবং আমরা পেতাম না বিখ্যাত বোস-আইন্সটাইন তত্ত্ব। সেই কিংবদন্তী ছিলেন একজন সনাতনী।

উপেন্দ্রনাথ বক্সী ছিলেন একজন গণিতের শিক্ষক। তাঁর শিক্ষকতা জীবনে এমন ঘটনা আর কখনোই ঘটেনি। ছাত্রটি সবকটি অঙ্কই নির্ভুল ভাবে সমাধান করেছে বটে, কিন্তু জ্যামিতির প্রত্যেকটি সমাধানই একাধিক ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সবাইকে। তাঁর এই উদ্ভাবনী পদ্ধতি, যা তার নিজস্ব আবিষ্কার। জীবনে এমন চমৎকার সমাধান যে করা যায়, তা সেই শিক্ষকের কাছেই অজানা। কি করা যায়! অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে ভাবতে শেষমেশ ছাত্রের উত্তর পত্রে ফুল মার্কসের সাথে অতিরিক্ত ১০ নাম্বার বেশী দিয়ে দিলেন।

★কে ছিল সেই ১০ নম্বর বেশী পাওয়া ছাত্রটি?

সেদিনের সেই ছাত্রটির নাম ছিল সত্যেন্দ্রনাথ (সত্যেন) বোস। পরবর্তীতে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে যিনি হয়ে উঠেন একজন কিংবদন্তী। সেসময় কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে দুনিয়া জুড়ে চলছে জোর গবেষণা। তাঁর ও আগ্রহ বিপুল। একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এই বিষয় নিয়ে পড়তে পড়াতে তিনি এক ভুল করে বসলেন। আর সেই ভুলটাই কিনা মিলিয়ে দিল সমাধান! সেই তত্বটা পাঠিয়ে দিলেন আইনস্টাইনের কাছে।

তিনি আইনস্টাইনকে লিখলেন,

"Respected Sir, I have ventured to send you the accompanying article for your perusal and opinion."

আইনস্টাইন রীতিমতো মোহিত হয়ে গেলেন বোসের তত্ত্ব পড়ে। আরও গবেষণার জন্য আমন্ত্রণ করলে সত্যেন বোসকে।

দুজনের মিলিত প্রচেষ্টায় আবিস্কৃত হল "বোস আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স"।

বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে অনেকের কপালেই নোবেল জুটল কিন্তু বোসের ভাগ্যে জুটল "বোসন কণার" সন্মান।

নোবেল তিনি পান নি তবে অন্যরা পুরস্কার জয় করলেও তিনি জয় করলেন ইতিহাস।।

এই সময়কালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করলে ১৯১৫ সালে তিনি সেখানে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। সেখানে তিনি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সঙ্গে মিশ্র গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সেখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রিডার হিসাবে যোগ দেন।

১৯২৪ খৃষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালীন সময়ে সত্যেন বোস প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম তেজস্ক্রিয়তা নীতি ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়াই প্রতিপাদন করে একটি গবেষনা প্রবন্ধ রচনা করেন এবং সদৃশ কনার সাহায্যে দশার সংখ্যা গণনার একটি চমৎকার উপায় উদ্ভাবন করেন। এই নিবন্ধটি ছিল মৌলিক এবং কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের ভিত্তি রচনাকারী। প্রবন্ধটি প্রকাশ করবার প্রাথমিক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বসু তা সরাসরি আলবার্ট আইনস্টাইনের নিকট প্রেরণ করেন, যিনি প্রবন্ধটির গুরুত্ব অনুধাবন করে নিজেই তা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন এবং বসুর পক্ষে তা প্রকাশ করেন "Zeits fur physik" সাময়িকীতে।

[http://scholar.google.com/scholar?q=bose+theory+in+%22Zeits+fur+physik%22&hl=en&as_sdt=0&as_vis=1&oi=scholart]

সত্যেন বোসের এই প্রবন্ধের ব্যাপারে আইন্সটাইন বলেছিলেন,

"আমার মতে বোস কর্তৃক প্ল্যাঙ্কের সূত্র নির্ধারন পদ্ধতি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।"

এ স্বীকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে বসু ভারতের বাইরে গবেষণার সুযোগ লাভ করেন এবং দু' বছর ইউরোপে অবস্থান করে লুই ডি ব্রগলি, মেরি কুরি, এবং আইনস্টাইনের সাথে কাজ করার সুযোগ লাভ করেন।

১৯২৭ খৃষ্টাব্দে ইউরোপ সফর শেষে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন। বসু ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেন এবং দেশবিভাগ আসন্ন হলে তিনি কলকাতায় ফিরে যান এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৫৬ খৃষ্টাব্দে সেখান থেকে অবসর গ্রহণের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এমেরিটাস অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ করে। ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি বিশ্বভারতীতে উপাচার্য হিসাবে যোগ দেন এবং ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ খৃষ্টাব্দে পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ভারত সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত করেন ১৯৫৯ খৃষ্টাব্দে।

সত্যেন্দ্রনাথ বসুর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল গাণিতিক পদার্থবিদ্যা। ছাত্রজীবনে অদম্য মেধাবী সত্যেন্দ্রনাথ কর্মজীবনে সম্পৃক্ত ছিলেন বৃহত্তর বাংলার তিন শ্রেষ্ঠ শিক্ষায়তন কলকাতা, ঢাকা ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। সান্নিধ্য পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মাদাম কুরী প্রমুখ মণীষীর। আবার অনুশীলন সমিতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগও রাখতেন দেশব্রতী সত্যেন্দ্রনাথ। কলকাতায় জাত সত্যেন্দ্রনাথ শুধুমাত্র বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রবল সমর্থকই ছিলেন না, সারা জীবন ধরে তিনি বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ধারাটিকেও পুষ্ট করে গেছেন।

এই প্রসঙ্গে তাঁর অমর উক্তি,

“যাঁরা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান হয় না, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না।”

বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের উদ্দেশ্যে "বিজ্ঞান পরিচয়" নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন তিনি। ব্যক্তিজীবনে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন নিরলস, কর্মঠ ও মানবদরদী মণীষী। বিজ্ঞানের পাশাপাশি সঙ্গীত ও সাহিত্যেও ছিল তাঁর আন্তরিক আগ্রহ ও বিশেষ প্রীতি। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিজের বিশ্বপরিচয় বিজ্ঞানগ্রন্থ, অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর জাপানে ভ্রমণরচনা ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর অর্কেস্ট্রা কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন,

"A man of genius with a taste for literature and who is a scientist aa well."

বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান, বসু-আইনস্টাইন ঘনীভবন, বোসনের উপর গবেষণা করে ১৯৮৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন Carlo Rubbia এবং Simon van der Meer, ১৯৯৬ সালে David M. Lee, Douglas D. Osheroff, Robert C. Richardson, ১৯৯৯ সালে Martinus J. G. Veltman ও Gerardus 't Hooft, ২০০১ সালে Eric Allin Cornell, Carl Edwin Wieman এবং Wolfgang Ketterle) নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বোসকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়নি।

ঈশ্বরকণা নামে সম্প্রতি যে কণাটি আবিস্কার হয় তার আরেক নাম হিগস-বোসন কণা, যার নামকরণ করা হয় সত্যেন বোসের নামে। ঈশ্বরকণা নিয়ে গবেষণা করার জন্য ২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগস ও বেলজিয়ামের ফ্রাঁসোয়া আগলার। বসুর প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তারা কণাটির নাম দেন হিগস-বোস কণা।

পশ্চিমাদের অনুসরণ করা সাম্প্রতিক কালের সনাতনীরা আইন্সটাইনকে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জনক মানে, আইন্সটাইনের জয়জয়কার করে কিন্তু অদম্য মেধাবী আমাদের সনাতনী পরিবারের সন্তান সত্যেন বোসকে কতটুকু জানে কিংবা মূল্যায়ন করে?

©স্টিমন অনিক।