✴️ পরমেশ্বরের আবির্ভাবের দিনটি।।

 


সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রাণের পুরুষ নরনারায়ণ শ্রীকৃষ্ণ। যদিও তিনি ভিন্ন ভিন্ন নামে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পুজিত হয়ে আসছেন হাজার বছর ধরে। যিনি ভারত তথা এ সমগ্র পৃথিবীর জন্য ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে অপ্রতীম অর্থাৎ যাহার কোন তুলনা নেই। একজন আস্তিক, নাস্তিক, নিরাকারবাদী, সাকারবাদী যেই হোক না কেন শ্রীকৃষ্ণকে যদি সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে অবশ্যই তাঁর প্রতি নিজেকে সমর্পন করে ভক্তে পরিণত হবেন। যদি দেখি শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের সেই দিনটি। কি হয়েছিল সেই দিনটিতে?

★ হ্যাঁ, একবার ভাবুন; কংসের মত দুরাচারী রাজার অত্যাচারে মথুরাসহ আশেপাশের সমস্ত অঞ্চলগুলি ভীতসন্ত্রস্ত, নিজের পুত্র নিজের পিতাকে ক্ষমতালোভীর মত কারাগারে বন্দি রেখে জোর করে সিংহাসনচ্যুত করে রাখা হয়েছে। ধর্মকে নির্মমতার জাতাকলে পিষ্ট করে অধর্ম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জরাসন্ধ সহ অন্যান্য পাপাচারী রাজার প্রাদুর্ভাবে ভারত সহ সমগ্র পৃথিবী জর্জরিত।
ঠিক তখনই ভক্তকুলের পরিত্রাণ হেতু, জগতের ভারসাম্য রক্ষার্থে ধরণীমাতাকে নির্ভার করতে কারাগারের মধ্যে দূরাবস্থায় জর্জরিত অত্যাচারিত বসুদেব ও মাতা দেবকীর কোলে এসেছিলেন পাপীদের হরনকর্তা তথা জগতের সর্বেশ্বর বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ।
★ সেই ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীর দিনটি যেন সাধারণ কোন দিনের মত নয়, প্রকৃতি মাতা যেন অন্যভাবে স্বাগত জানিয়েছিলেন স্বয়ং শিশুরুপী পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে।সেদিনের সূর্যও যেন প্রতিদিনের মত ছিল না। উদীয়মান সূর্যের মধ্যে ছিল যেন অস্বাভাবিক উজ্জলতা। যেমন অন্ধকারের মধ্যে সামান্য আলোও ভরসার প্রতীক হয়ে উঠে তেমনিভাবে সেদিন অষ্টমী তিথিতে উঠেছিল নব সূর্য। সেদিন পৃথিবীর পশুপাখিদের মধ্যেও দেখা গিয়েছিল চঞ্চলতা।মুনীঋষিগণসহ সমগ্র উদ্ভিদকূল, পশু পাখি যেন উদগ্রীব হয়ে সেদিনকার ঝলমলে সূর্যটার অস্তমিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। মুনি ঋষিগণের সেদিনের প্রাতঃকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত যেন চিত্ত ছিল অস্থির। আজ রাতে যে প্রভু আসবেন ধরণী মাঝে। সকল অমনীশা সকল দুরাশা, সকল ভয় দূর করে ধরাধামে হৃষিকেশের আগমন ধ্বনি যেন জগতের প্রতিটি কণায় কণায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
অবশেষে পশ্চিমাকাশে রক্তিম ভানু অস্তমিত হয়ে ঘোর অন্ধকারের আগমন ঘটল। গোধুলী লগ্নে ধেণু গো-বৎসগণের মধ্যে উৎফুল্লতা যেন রাখালগণকে মোহিত করল। কেন এই উৎফুল্লতা?
★মথুরার বিশাল অট্টালিকায় সন্ধ্যালগ্নে রাজকক্ষে ঘীয়ের প্রদীপ জ্বলছে। দুরাচারী কংস কক্ষে বসে মদ্যপান করছেন।আজ যেন তার নেশাটা হচ্ছেনা। আজকের আবহাওয়াটাই কেমন যেন গুরুগম্ভীর। মাঝে মাঝে দক্ষিণ জানালা দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে। বায়ুপ্রবাহ যেন একধরনের মূর্ছনা তৈরি করছে। সেই মূর্ছনা কংসের কর্নে যাতনা তৈরি করছে। বায়ুর মূর্ছনা যেন বলছে,
"কংস তোমার দিন শেষ!
কংস তোমার দিন শেষ!
কংস তোমার দিন শেষ!"
প্রহরীকে বলে সবকয়টি জানালা বন্ধের নির্দেশ দিলেন কংস। দাসীকে দিয়ে আরো একপাত্র মদ নিলেন।
★সেই সন্ধ্যা হতে দেবকীর মধ্যে স্নিগ্ধতা ও শান্তির ভাব পর্যবেক্ষন করছেন বসুদেব। এর আগে প্রতিটি সন্তান হওয়ার আগে যে কস্ট ব্যাথা অনুভব করতেন তেমন কিছুই মনে হচ্ছেনা। আজ দেবকী যেন অত্যন্ত প্রফুল্ল। এছাড়াও বসুদেব ও দেবকীর যেন কোন ক্ষুধা তৃষ্ণা নেই, কি যেন হবে। সেই কবেই কারাগারে রুদ্ধ হয়েছিলেন, আলো বাতাসের দেখা নেই কিন্ত আজ যেন কারাগারের মধ্যেই ভাদ্রমাসের হিমেল হাওয়া বইছে। জরাজীর্ণ সেই ভয়ংকর কারাগারে যেন স্নিগ্ধতার পরশ বইছে। দেবকীর সন্তানধারণের যে ব্যাথাটা পূর্বে ছিল সে ব্যাথাটাই নেই। বসুদেব যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না।

★ মদ্যপানরত অবস্থায় কংস আজ অতি বিচলিত বোধ করছেন। আজ কংস যেন নিজেকে অনিরাপদ মনে করছে। তিনি রাজ দরবারে ছাড়া রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিজকক্ষে আলোচনা করেন না। কিন্তু আজ প্রহরীকে দিয়ে নিজ কক্ষে রাজমন্ত্রীকে তৎক্ষনাৎ তলব করলেন। মন্ত্রী উপস্থিত হলে মথুরার কঠোর নিরাপত্তা জারি করার নির্দেশ দিলেন।
★বাইরে তুমুলবর্ষন, মেঘের ঘনঘটা চলছে। আকাশে অষ্টমীর চাঁদ কাল মেঘের আবরণে ঢেকে গেছে। সমস্ত মথুরা যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রতিরাতের ন্যায় ঝিঁঝি পোকা ডাকছে না, মানুষের মধ্যে হট্টগোল শোনা যাচ্ছেনা। মহামায়ার প্রভাবে প্রাসাদের প্রহরী দ্বাররক্ষক সকলেই যেন মৃত্যু ঘুমে পর্যদুস্ত। অর্থাৎ প্রকৃতি মাতা যেন পরমেশ্বরের আগমনের সকল ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
ইন্দ্রদেব যখন প্রবল বেগে ধরণীতলে মেঘবর্ষণ করছেন, সমস্ত মথুরা যখন ঘোর অন্ধকারাছন্ন, ঘুমন্ত, সমগ্র দেবগণ, ঋষিগণ, গান্ধর্বগণ, বৃক্ষকূল পশুকূল সেই অন্ধকারে মহাজাগতিক আলোর অপেক্ষায় ছিলেন, তখনই পরব্রহ্ম নারায়ণ মা দেবকী ও পিতা বসুদেবের সকাশে জগৎরক্ষার্থে অবতীর্ণ হইলেন। সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে যেন শান্তির পরশ ছুয়ে গেল, হিংস্র বাঘ ভয়ার্ত মহিষ যেন সবভূলে গিয়ে সহাবস্থান করল, মুনিঋষিগন, দেবগণ সকলে জয়ধ্বনি দিতে লাগিলেন। সেই ফুটফুটে শিশু কি তাহার অপার রূপ, একখন্ড তারা যেন স্বমহিমায় সেই তমসাচ্ছন্ন কারাগারে জ্বলিতে লাগিল!
তাই কবি গাহিয়াছেন,
"আজি উদিল ভাগ্য তপন, এসেছেন দয়াল পরমপিতা
করিছেন প্রেম বিতরন।
তার রাতুল চরণে লভিয়া স্মরণ,
ধন্য হল প্রাণ মন!"
হতাশা তমসাছন্ন পৃথিবীকূলের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাত থেকে রক্ষা করতে ও অধর্মের বেড়ী হতে জগৎকে মুক্ত করিতেই জগতে প্রেমের বাণী বিস্তার করতেই যেন ঈশ্বর অবতীর্ণ হইলেন।
জয় শ্রীকৃষ্ণ
জয় সনাতন!
অংকন ভট্টাচার্য

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ